হাফক্লাস করে মাত্র স্কুল থেকে বাসায় ফিরলাম ।আজকে হঠাৎ মামা আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসলো।এসে দেখলাম বাসায় বেশ আয়োজন চলছে। কিন্তুু আমি জানিনা কিছু, তবে আয়োজন দেখে কিছুটা না পুরটায় আন্দাজ করতে পারছি। ক্লাশ এইটে পড়া একটা মেয়ে আজকাল ছোট থাকে না বড় হয়ে যায়। একটা বিয়ে বাড়ির আয়োজন চলছে। কিন্তুু বিয়েটা কার???
সারাবাড়ি তন্নতন্ন করে কনে কে খুজে পেলাম না। তারপর চিলেকুঠার ঘরে দেখলাম মা চুপচাপ বসে আছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম মা বিয়েটা কার?? মা আমার দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এমনি পাশ থেকে আমার এক দূরসম্পর্কের ফুফু এসে বল্লো ঝুমু মা চল, ব্যাগ গুছিয়ে নাও তুমি আজকে থেকে আমাদের বাসায় থাকবে। পরে জানতে পারলাম আমার মায়ের বিয়ে হচ্ছে, অবশ্য এই নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নাই। ফুফু আস্তে আস্তে বলছে দেখো মা ঝুমু আজকে তোমার মায়ের বিশেষ একটা দিন। তুমি থেকো না থাকলে মন খারাপ হবে। আমি চুপ করে শুনছি, মুচকি হেসে বল্লাম আমার খারাপ লাগবে না ফুফু।
আমি ঝুমু, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিলাম,এখন একজনের সন্তান, শুধু আমার মায়ের।পারিবারিক ভাবেই বিয়েটা হয়েছিল বেশ কয়েকবছর আগে। মায়ের অমতে,বিয়েটা টিকেছিল মাত্র ২ বছর তাও অনেক ঝড় ঝামেলার মধ্যে । তাদের স্ট্যাটাস, ইগো সবচেয়ে বেশি কাজ করতো।সবকিছু মিলিয়ে তাদের একসাথে থাকা হলো না। বাবা আমাকে নিতে চায় নি তাই দয়া করে নানুবাড়িতে আমাকে রেখে দিলো। তারাই আমার সব খরচ বহন করছে, মায়ের সাথে আমার কিন্তুু সেইরকম কোন ভাব ছিলো না দরকার ছাড়া আমরা কখনো কথা বলতাম না।আমার দূরসম্পর্কে একটা ফুফু আছে ওনি আমাকে সপ্তাহে ৩ দিন দেখতে আসে গল্প করে। তার কোন মেয়ে নেই। আমাকে মেয়ের মতোই ভালোবাসে। ফুফুকে আমার বেশ লাগে,ফুফুর জন্য আমার মায়া হয়।
মায়ের বিয়ে নাকি বিরাট বড় বাড়িতে হচ্ছে। আমি যে একটা মেয়ে আছি ওই বাড়ির কেউ জানেনা,তাই আমাকে লুকাতে চাচ্ছে। কিছুক্ষন পর নানু এসে আমাকে বলছে ঝুমু শোন তুই এখন বড় হয়েছিস নতুন করে কিছু বলার নাই, তুই তো সব দেখছিস,তোর আর তোর মায়ের ভবিষ্যৎ এর কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নিলাম। তুই এখন থেকে তোর ফুফুর বাড়িতে থাকবি।ও তোকে মেয়ের মতো ভালোবাসবে। আমি চুপ থাকলেও প্রশ্ন ছিলো আমার ভবিষ্যৎ কি এখানে আছে?? না পেলাম বাবাকে না মাকে।
বিকেলে বাড়িতে অনেক মেহমান আসছে, তারা সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখছে, আমি আমার রুমে চুপ করে বসে আছি। কয়েকজন আমার রুমে গিয়ে জানতে চাইলো আমি কনের কি হই?? বল্লাম আন্টি হয়(শিখানো কথা)। ভালো ধুমধামেই বিয়েটা হচ্ছে আমি চুপচাপ ব্যাগ গুচাচ্ছি। তার মধ্যে নানুকে একবার বল্লাম মায়ের সাথে দেখা করা যাবে কিনা?? নানু ধমকের সুরে বলেন পাগল হয়েছিস?? চুপ করে রুমে থাক। বিপদ ডেকে আনিস না বলে দিলাম।
কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজ করছি। কিছুক্ষন পর কান্নার শব্দ শুনছি নানু কান্না করছে, বিয়েটা হয়ে গেছে। মায়ের সাথে দেখা হয়নি।হয়তো আর হবে না।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা মায়ের সাথে আমারও বিদায় এর ঘন্টা বেজে গেছে, আজ আমিও চলে যাচ্ছি। ফুফু কিছু বলবে ভাবছে তখন আমি ব্যাগ হাতে নিয়ে বল্লাম ফুফু চলো। ফুফু অবাক হলো, চোখ মুখ উজ্জল হয়ে গেছে। আমার আসলে রাগ অভিমান কিছু ছিলো না। নিরবে বের হয়ে আসলাম। ১৮ বছর পর, আমার আজ চাকরির প্রথম দিন, আমি একজন সরকারি নার্স হিসাবে জয়েন করলাম। একজন রোগির প্রেসক্রিপশন হাতে আসলো নাম জাহানারা সুলতানা, যিনি দীর্ঘ ২ বছর এই হাসপাতালে প্যারালাইজড হয়ে পরে আছেন। তেমন কেউ দেখতে আসে না।
রোগির কাছে গিয়ে দেখলাম আমার খুব পরিচিত। মনে পড়ে গেলো ১৮ বছর আগে শেষ দেখা মানুষটির কথা।আমার মা জাহানারা। এই আঠারো বছরে তার সাথে একবারও কথা হয়নি।আমার আর নানুবাড়িতে যাওয়া হয়নি। তারাও আমার খুজ নেয়নি। ফুফুই আমাকে মানুষ করেছে, মাতৃস্নেহে বড় করেছে। কিন্তুু বরাবরই আমি চুপচাপ ছিলাম,তাই কখনো তাকে আর মা ডাকা হয়নি। সে কতোবার যে চেয়েছিলা আমি মা ডাকি। জাহানারা সুলতানার দায়িত্ব পরলো আমার উপর। আমার কাছে তিনি এখন কেবলই একজন প্যাসেন্ট।
সন্ধ্যা নাগাত বাসায় ফিরে মা মা বলে ডাকছি। ফুফু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো দরজার কাছে, আমি বল্লাম মা খেতে দাও কিছু, অনেক কাজ করেছি খিদা পেয়েছে বেশ। কাগজপত্রগুলো হাতে দিয়ে ব্যাস্ততা দেখিয়ে চলে যাওয়ার ভান করলেও দরজার ফাকে দিয়া দেখছি আনন্দে কাদঁছে মানুষটা।