সুখনীড়

সুখনীড়

হালকা গরম পানি দেওয়ার কথা ছিল। আমি ফুটন্ত গরম পানি আর তাতে এক চিমটি লবণ দিয়ে এগিয়ে দিলাম। হাতে নিয়ে হালকা আর্তনাদ করলেও কিছু বলে নি। আমি রান্নাঘরে গিয়ে মা’য়ের সাথে টুকাটাক কাজ করছি। ততক্ষণে ভাইয়া মুখ ধুয়ে টেবিলে এসে গেছে। মা নাস্তা নিয়ে গেল আমি চা নিয়ে গেলাম একটু পরে। চা খেয়ে বেশ শান্ত ভাবে ভাইয়া বলল, বেশ ভালো হয়েছে আজকের চা।

আমি চোখ বড় বড় করে দাড়িয়ে আছি এককাপ চায়ে সাড়ে চার চামচ চিনি দিলে কিভাবে গলা দিয়ে নেমে ভালো হয় বুঝতে পারলাম না। ভাইয়া চলে গেল। রাতে ভাইয়ার বিছানাটা আমি ঝেড়ে পরিষ্কার করে রাখি কিন্তু আজ যা পারলাম যত ময়লা কাপড়, বই সব বিছানায় এনে রেখে দিলাম। একটা আবদার ই তো করেছি তাতেও এত মানা। যাও কর নিজের কাজ সব। এসব ভাবতে ভাবতে আমি আমার রুমে চলে এলাম। তখনি মা পেছন পেছন এসে বললেন,

— তুই কি পাগলামি শুরু করেছিস? রিহান যখন চাইছে না তুই এসব তোদের কি পার্টি না কি পিকনিকে না যাস এত জেদ করছিস কেন। জানিস তো সংসারটা ও ই চালাচ্ছে তোর ভাইয়ের উপর এত প্রেসার দেওয়া কি ঠিক। বড় হয়েছিস বুঝিস না! মা আমি তো প্রতিবার যাই না। এই লাস্ট সবাই যাচ্ছে তাই বলছি। কলেজ শেষ আর এমনিতে যাওয়া হবে না। ভাইয়াও তো কলেজে পড়ার সময় গিয়েছে। আমি যেতে গেলেই যত সমস্যা। তখন তোর বাবা ছিলেন। এখনের অবস্থা আর আগের অবস্থা সমান না। আমি রাগ করে কিছু না বলে বসে আছি। মা চলে গেলেন।

সন্ধ্যায় ভাইয়া ঘরের টুকটাক জিনিষ আনল। সাথে হালিমের প্যাকেট আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে মা’কে বলল,, অনেক দিন হল কারো হাতের হালিম খাই নি আজ ইচ্ছা করছে। আমি দরজার সামনে দাড়িয়ে শুনছি। নাহ পারব না হালিম রান্না করতে। চা সামনে নিয়ে যেতে ই শুনলাম মা ভাইয়াকে বলছে পরসু ফুপু আসবে ডাক্তার দেখাতে এখানে দু একদিন থাকবে। বাসায় তেমন বাজার নেই। ভাইয়া নিমষে ই চুপসে গিয়ে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বললাম না হালিম খেতে ইচ্ছে করছে।

আমি চলে এলাম। মা রান্নাঘরে আসতে ই বললেন, দেখছিস তো কত কি ঘরে লাগবে এসব জেদ ছাড়। ৬০০ টাকা তো কম নয়। চাকরিও করে না কি করে সব করবে.! আমি নিরব হয়ে গেলাম। আর কিছু বললাম না। শুধু খারাপ লাগছিল যা ভাবলাম কিছু ই হল না। আমার কাছে অল্প আছে তাতে তো হবে না । পরদিন ফুপু এসে একদিন থাকলেন। ভাইয়া সবার সাথে হাসিমুখে কথা বললেও খেয়াল করলাম খেতে গিয়ে ভাইয়া ভালো করে না খেয়ে উঠে যায়। এই দু দিনে ভাইয়াকে টাকার বিষয়ে আর কিছু বলিনি।

হয়ত কোনো বান্ধবির কাছ থেকে ধার নিতে হবে। রাত ঠিক আটটা সাড়ে আটটার দিকে ভাইয়া সব সময় বাসায় ফিরে আসে কিন্তু দুদিন হল রাত প্রায় দশটা বেজে যায়। আমি আর মা রাতের খাবার নিয়ে অপেক্ষা করি । ঠিক দশটা পাঁচ মিনিটে ভাইয়া আসল। বেশ হাসিমুখে আমাকে ডেকে কলেজের জন্য ৬০০ টাকা হাতে তুলে দিল। মায়ের ঔষুধ, গ্যাস বিল জমা হয়ে ছিল তা মাকে বুঝিয়ে দিল। মা অবাক হয়ে বললেন, মাসের মাঝখানে টাকা!

এত চিন্তা কর কেন মা। নতুন একটা টিউশনি নিয়েছি। এই পাগলিটা তো জেদ করেছে কলেজ থেকে কোথায় যাবে না দেই কিভাবে। কলেজ শেষ আর তো পাবে না। তাই নতুন টিউশনিটার বেতন অগ্রিম নিয়ে নিলাম। আমি তাকিয়ে আছি ভাইয়ার ঐ ক্লান্ত মুখটার দিকে । যেন হাজার না বলা ব্যথার কষ্টগুলো লুকিয়ে রেখেছে এই হাসির আড়ালে। মা চোখ মুছতে মুছতে খাবার গরম করতে গেলেন ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেকটা।

আমি পরদিন সকালে বাইরে গিয়ে ঠিক সেই দোকানটায় গেলাম। সন্ধ্যায় ভাইয়া একবার বাসায় এসে চা খেয়ে আবার বাইরে যায়। আমি চায়ের সাথে টেবিলে প্যাকেট টা রাখলাম। ভাইয়া চা খেতে এসে ই দেখে মাকে ডাক দিল। মা কিছু ই জানে না আমি বললাম, আমি রেখেছি কালকে না তোমার বন্ধুর বিয়ে এই মেরুন রঙ এর পানজাবি পরে বিয়েতে যাবে।

— তুই এত টাকা পেলি কোথায়..?

ভাইয়া তুমি যেদিন আমাকে নিয়ে বই কিনে দিতে গিয়েছিলে সেদিন একটা দোকানে এই পানজাবি টা দেখেছিলে। বার বার ঘুরে ফিরে দেখছিলে কিন্তু দাম দেখে ই আর অমুখো হওনি। তখন আমার খুব ইচ্ছে করছিল যদি আমার কাছে টাকা থাকত আমি এক্ষুনি কিনে দিতাম তোমায়।

— ধূর পাগলি। এমনি দেখছিলাম কে বলেছে? কালারটাও আমার পছন্দ হয়নি। না হলে কিনে নিতাম।

হ্যা, টাকা না থাকলে কালার কেন কাপড়ে সুতাও পছন্দ হয় না জানি। আর তুমি কিনবে! সেই দুবছর হল বাবা মারা যাওয়ার আগে একটা ভালো শার্ট কিনে ছিলে সেটা পরে ই এখনো যে কোনো অনুষ্টানে যাও দেখি তো। কত কেন তুমি! আর টাকা.. আসলে আমি অনেক দিন জমা করতে করতে ৮০০ টাকা হয়েছে আর লাগে ৪০০ টাকা। বান্ধবি কারো কাছ থেকে নিব কিন্তু পরে দিব কি করে তাই তোমার কাছ থেকে তোমার জামা কিনতে ই টাকা নিয়েছি। ওসব পিকনিক কিছু না। সবসময় ই তো বল কিনবে কিনবে কিনেছ নিজের জন্য কিছু কিনেছ এই দু বছরে..! জানি তো।

বাবা চলে যাওয়ার পর কিভাবে একটা ছেলে মুখ বুঝে নিজের সব আনন্দ শখ বিসর্জন দিয়ে পরিবারকে আগলে রেখেছে তা আমি ভাইয়াকে দেখে বুঝেছি। হ্যা এরাই মধ্যবিত্ত পরিবারের সেই ছেলে আর এরাই পারে হাসিমুখে সব দায়িত্ব পালন করতে। কাউকে বলে দিতে বা শিখিয়ে দিতে হয় না। বাস্তবতা সব কিছু এদের শিখিয়ে দেয়। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এত খেয়াল রাখিস আমার। বারে রাখতে হবে না। ফুটন্ত গরম পানি, চার চামচ চিনির চা এগুলো খেয়াল রেখে করেছি বলে ই তো আজ এটা দিতে পেরেছি। না হলে পারতাম!

ভাইয়া হাসছিল আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল মা’য়েরও। মধ্যবিত্তের সুখের হাসিটা হয়ত এরকম ই হয়। হাসি সাথে সেই সুখের অনুভূতি তারা যে মনের গভীর থেকে অনুভব করে তা চোখের জলে পূর্ণতা পায়। কারণ এইটুকু সুখ কিনে নিতে যে অনেক কষ্ট করতে হয় তাদের।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত