পঞ্চাশ টাকা

পঞ্চাশ টাকা

অনেকক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি ল্যাম্পপোষ্টের গোড়ায়। আজ রোদেলার সাথে দেখা করার কথা। রোদেলা হচ্ছে আমার ফেসবুকের বন্ধু। কিছুদিন আগেই আমাদের পরিচয় হয় ফেসবুকে। তারপর গতকাল রোদেলা জানায় আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমিও না করিনি, রোদেলাকে আমি ঠিকানা বলে দিলাম। রোদেলা থাকে চাষাড়া আর আমি আদমজী। দুরত্বটা বেশি নয়, তাই কিভাবে কিভাবে আসতে হবে তা বলার প্রয়োজন হয়নি।

আমি অপেক্ষায় আছি রোদেলার। তবে মাথায় শুধু রোদেলার ব্যাপারটা ঘুরছে না, সাথে অন্য আরেকটা ব্যাপার মাথায় লাটিমের মত ঘুরছে। আর তা হচ্ছে আমার মানিব্যাগে শুধু পঞ্চাশ টাকা আছে। আজ একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি, কিন্তু আমার পকেটে মাত্র পঞ্চাশ টাকা আছে। ব্যাপারটা হরর মুভির চেয়েও ভয়ংকর। বর্তমানে একটা চায়ের দোকানে বসলেও একশো টাকা খরচ হয়ে যায় সেখানে একটা মেয়ের সাথে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে দেখা করতে চলে এলাম আমি? বোধহয় আমার মাথার মগজটা কেউ খুলে রেখে দিয়েছে। তাই পকেটের অবস্থা খারাপ থাকার পরেও রোদেলার সাথে দেখা করতে চলে এসেছি।

— আপনি আবির রায়হান না? এসব কথা ভাবতে ভাবতেই পেছন থেকে একজন মেয়ে কথাটা বলে উঠলো। আমি চমকে গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালাম। তারপর কিছুক্ষন মনের মধ্যে হিন্দি রোমান্টিক সিনেমার গান বাজতে লাগলো, আবার কিছুক্ষন বেদের মেয়ে জোসনা ছবির গান বাজতে লাগলো। এই গান বাজার একটাই মানে। তা হচ্ছে আমি তাহার প্রেমে পড়িয়া গিয়াছি।

— জ্বী আমিই আবির, তুমি নিশ্চয়ই রোদেলা। আমি এবার তাহাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। রমনী হালকা দাঁত বাহির করিয়া হাসিয়া কহিলেন,

— হ্যা আমিই রোদেলা জাহান। কেমন আছেন আপনি?
— ফেসবুকে চ্যাটিং করার সময় তুমি কিন্তু আমাকে কখনোই আপনি করে বলোনি। তবে আজ কেন?
— আসলে ওই সময় তো আপনাকে দেখিনি, মনে করেছিলাম আপনি আমার সমবয়সীই হবেন। কিন্তু এখন দেখছি আপনি!
— এখন দেখছো আমি একটা বুইড়া খাটাশ, তাইনা?
— আরে নাহ নাহ, আমি তা বুঝাতে চাইনি। আচ্ছা চলুন কোথায় বসে কথা বলি?

এতক্ষন তো কথা ভালই চলছিলো। হঠাৎ করেই যখন রোদেলা কোথাও বসার কথা বললো তখনই বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম, নিশ্চয়ই এটা গ্যাস্ট্রিকের ব্যাথা। বর্তমানে মেয়েদের নিয়ে কোথায় বসা মানেই ভাল কোন রেস্টুরেন্ট বা ভাল কোন ফাস্টফুডের দোকানে বসা। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে এখন রেস্টুরেন্টে এক বোতল পানি পাওয়া যায়না সেখানে রেস্টুরেন্টে বসা তো বিলাসীতা।

— ঠিক আছে চলো কোথাও বসা যাক।

রোদেলাকে নিয়ে সমানের দিকে হাঁটতে লাগলাম। আর চারদিকে চোখ রাখলাম, যদি পরিচিত কারো সাথে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, কেউ আজ চোখের সামনে পড়েনি। হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল রানা মিয়ার দোকানের দিকে। আমাদের অত্র নারায়নগঞ্জে আমার জানামতে রানা মিয়ার মত ভাল ঝালমুড়ি কেউ বানাতে পারে না।
যেহেতু রোদেলা আমার গার্লফ্রেন্ড না শুধুই ফেসবুক ফ্রেন্ড, তাই আর দেরী না করে আমি রোদেলাকে বললাম,

— আচ্ছা রোদেলা চলো ঝালমুড়ি খাই, রানা ভাইয়ের ঝালমুড়ি খেলে জীবনেও এই স্বাদ ভুলতে পারবে না।

আমার এই প্রস্তাবে রোদেলা ভ্রু কুঁচকে তাকালো আমার দিকে। একটা সুন্দরী মেয়ে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে আর আমি তাকে কোন ভাল রেস্টুরেন্টে না নিয়ে গিয়ে ঝালমুড়ি অফার করছি, এই কারণেই হয়তো সে কিছুটা অবাক হয়েছে। আমি রোদেলার অবাক হওয়াকে তোয়াক্কা না করে হনহন করে রানা মিয়ার ছাপড়া হোটেলে ঢুকে পড়লাম। উপায় না থাকার ফলে রোদেলা নিজেও আমার সাথে এই নোংরা ছাপড়া হোটেলো ঢুকে নড়বড়ে বেঞ্চে বসে পড়লো।

— রানা ভায়া দুইটা ঝালমুড়ি দিয়ো। একটায় ঝাল দাও বেশি করে আরেকটায় এইখানে এসে আমি থেকে গেলাম। রোদেলার দিকে তাকালাম, এখনো ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এবারো তার এই ভ্রু কুঁচকানো দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে প্রশ্ন করলাম,

— রোদেলা ঝাল কি বেশি দিতে বলবো? নাকি কম দিতে বলবো?

রোদেলা কোন উত্তর দিলো না। সে চোখ বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি রোদেলার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। চোখ সরিয়ে নিয়ে রানা মিয়াকে ঝাল কম দিয়ে মুড়ি বানাতে বললাম। তারপর হোটেলের চারদিকে দৃষ্টি দিলাম। কয়েকটা ছোকরা টাইপের ছেলে আমাদের দুজনের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।
একটা ছেলে আর একটা মেয়ে ছাপড়া হোটেলে বসে ঝালমুড়ি সামনে আসার অপেক্ষা করছে। দৃশ্যটা খুবই অদ্ভুত বর্তমানের ছেলেমেয়েদের কাছে।

— তা রোদেলা, এখানে আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো?
— আমি অন্য কোন বিভাগ থেকে এখানে আসিনি, সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়।

ঝাঁঝালে কন্ঠে কথাটা বললো রোদেলা। বুঝতে পারলাম আজকের পর থেকে হয়তো রোদেলার সাথে আর দেখা হবেনা। হয়তো এখান থেকে গিয়েই আমাকে ফেসবুকে ব্লক করবে, যা হবে ফেসবুকে কোন মেয়ের কাছথেকে প্রথম ব্লক। ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।

— এইযে ভাই আপনাগো মুড়ি। পোকায় খাওয়া দাঁত বের করে একটা হাসি দিয়ে রাজু আমাদের সামনে মুড়ির বাটি রেখে চলে গেল। রাজু হচ্ছে রানা মিয়ার ছেলে।

— রোদেলা খেয়ে দেখো, অনেক মজা লাগবে। এই ঝালমুড়ি খাওয়ার পর অন্য কোথাও ঝালমুড়ি খাওয়ার ইচ্ছে হবেনা কখনো।

আমার কথায় রোদেলা অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। এই প্রথম খেয়াল করলাম রোদেলার নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হোটেলের ভেতরের বাতির আলোয় বিন্দু বিন্দু ঘামকে জ্বলতে থাকা মুক্তার মত মনে হচ্ছে।

— আচ্ছা তাহলে আসি, ভাল থাকবেন। হোটেল থেকে বেরিয়েই রোদেলা আমাকে কথাটা বললো। আমি বলার মত কিছু পেলাম না। মেয়েটাকে টাকার অভাবে ঝালমুড়ি খাওয়ালাম। আমাকে যে রাগের বশে দুই চারটা চড় থাপ্পড় মারেনি এইটাই শুকরিয়া।

— আচ্ছা ঠিক আছে, চলো তোমাকে বাসে উঠিয়ে দিই।
— না লাগবে না, আমি রিক্সায় চলে যেতে পারবো।

রোদেলার কথাটা মনের ভেতর খচ করে বিঁধে গেল। আমার পকেটে বিশ টাকা আছে, তা দিয়ে বড়জোর বাসে করে রোদেলাদের এলাকায় যাওয়া যায়। তাই আমি বাসের কথাই বলেছিলাম। কিন্তু রোদেলা রিক্সার কথা বলে আমাকে লজ্জায় ফেলে দিলো।

— আচ্ছা ঠিক আছে যাও তাহলে। রাতে কথা হবে।
— আচ্ছা।

রোদেলা মুখে আচ্ছা বললেও বুঝতে বাকি নেই যে ইতিমধ্যে আমাকে ব্লক করার প্ল্যান সেরে ফেলেছে।
আমি হাঁটছি আর ভাবছি, ভাবছি আর হাঁটছি। আমাকে দিয়ে আর যাই হোক মেয়েদের সাথে ভাব জমানো হয়ে উঠবে না। ফাঁকা পকেটে এসব বিলাসিতা চলে না। তারচেয়ে বরং একটা চাকরির খোঁজ করা জরুরি। ইদানিং বাবার শরীরটা খুব খারাপ যাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে আমার এক বন্ধুর বাসার সামনে চলে আসলাম। এখানে বন্ধুর কল্যানে ফ্রি ওয়াইফাই ব্যবহারের সুযোগ আছে। তাই মোবাইলের ওয়াইফাই অন করলাম। সাথে সাথে টুং টুং টুং করে মোবাইলে শব্দ হলো। রোদলার মেসেজ এসেছে।

— ০১৭৯৪১৪****, এইটা আমার নাম্বার। এখন থেকে ফেসবুক ছাড়াও মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনার রানা মিয়ার ঝালমুড়িটা আমার কাছে খুবই ভাল লেগেছে। আগামী শুক্রবার আবার কি দেখা করতে পারি আপনার সাথে? না মানে আপনার রানা মিয়ার ঝালমুড়ির প্রেমে পড়ে গেছি। তবে এবার কিন্তু বিল আমি দেবো। রোদলার মেসেজ পড়ে কিছুক্ষন হাসলাম। মোবাইলে টাইপ করলাম,

— শোনো সুন্দরী ললনা, বিলটা তুমি দিলে আমি খুশির ঠেলায় হার্টঅ্যাটাক করে বসতে পারি।

মেসেজটা পাঠাতে গিয়েও আমি ব্যাকস্পেস দিয়ে পুরোটা মুছে দিলাম। মেয়েটা শুক্রবারে ঝালমুড়ি খেতে চায়, আর আমি শুক্রবারের আগে ব্লক খেতে চাই না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত