বিয়ের তিন বছর পর লুবনার সাথে বরের ডিভোর্স হয়ে গেল। কারণ খুবই কমন, বর মাদকাসক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া থেকেই প্রেম ছিল সোহেলের সাথে।
তখন সোহেলের সামান্য ট্যাবলেট, মদ, গাজার নেশা আছে বলে জানলেও, এই পরিমাণ অ্যাডিক্টেড সেটি লুবনা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল সংসার শুরুর পর সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু হলো উল্টো। বর পাল্টা বাড়ির ভেতরেই মাদক নেওয়া শুরু করলো। এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করলে লুবনার ওপর মারধর হতে লাগলো।
লুবনার বাবা মারা গেছেন তার জন্মের একমাসের মধ্যেই। মা বেঁচেছিলেন বিয়ের পর মাত্র ছয়মাস। ভাইটা বিদেশ থাকে, সেখানেই এক অস্ট্রিয়ান মেয়েকে বিয়ে করে দিব্যি ভালোই আছে। যোগাযোগ আছে লুবনার সাথে। টাকা পয়সাও পাঠায় খুব নিয়ম করে।
লুবনা ঠিক করলো বাচ্চা নিবে, কিন্তু সেই বাচ্চাও ছয়মাস চলার সময়ে পেটেই নষ্ট হয়ে গেল। স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল ও চিকিৎসকের সাথে কথা বলে লুবনা যা বুঝলো, তাতে জামাইয়ের অতিরিক্ত মাদকমুখিতাই, বাচ্চা নেওয়ার প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে। কি রক্ত! কি কষ্ট! শারীরিক কষ্ট আসলে তুচ্ছ। অর্ধবাচ্চার মা হওয়াটা মানসিকভাবে কীরকম কষ্টদায়ক তা লুবনা জানে। বাচ্চাটা তো পেটে অর্ধেকেরো বেশি হয়ে গিয়েছিল! এই সময়টাতেও সোহেল নেশায় বুঁদ হয়ে থাকলো।বাবা ছাড়া বড় হওয়া লুবনা লড়াই করতে অভ্যস্ত। রাতারাতি সোহেলকে ডিভোর্স দিয়ে ফিরে এলো নিজ গ্রামে। ওদিকে সোহেল করলো দ্বিতীয় বিয়ে। লুবনার অবশ্য তাতে কিছু যায় আসে না।
গ্রামে এসে নিজেদের বাড়িঘর ঠিক করলো লুবনা। ফার্মেসিতে পড়েছিল। কাজেই একটা ওষুধ কোম্পানির সেলস এর চাকরি পেতে দেরি হলো না। এতোকিছুর পর নিজের স্বপ্ন হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলো একটা লাইব্রেরি। টাকা-পয়সা জমায় না সে। বাড়তি যা আয়-টায় হয়, সবদিয়ে মাস শেষে পাগলের মতো বই কিনে। বইয়ের ভেতর কাটায়।
বই পড়ার কারণেই হোক, আর মফস্বল শহরের নারী সেলসকর্মী হিসেবেই হোক, খুব দ্রুত ওষুধের দোকান আর চিকিৎসকদের সাথে ভালো সম্পর্ক হয়ে ওঠে লুবনার। অনেকেই পেছনে আজেবাজে কথা বললেও, ধীরে ধীরে সমীহ আদায় করে নেয় লুবনা। টানা চার বছর সেরা সেলসকর্মী হিসেবে কোম্পানি থেকে পুরস্কার পায় সে।
রাত-দিন খেটে, বাড়িতে অবসর সময়টুকু নিজের লাইব্রেরি গড়া আর বই পড়ার কাজে লাগায়। ডিভোর্সের পরের পাঁচবছরে লুবনার লাইব্রেরিটা হয়ে ওঠে বেশ বড়ো। ইদানিং লোকজন বিভিন্ন জায়গা থেকে লাইব্রেরির জন্য বই পাঠান কিংবা বই নিয়ে আসতে বলেন। ফার্মেসি আর ডাক্তারের চেম্বার ঘুরে ঘুরে কাজ শেষ করে লুবনা সেই বইগুলো নিয়ে আসে।
ওষুধ কোম্পানির কাজ করতে গিয়ে লুবনা প্রথমেই আবিষ্কার করেছিল, তার কোম্পানির ওষুধের দাম অনেক বেশি। একই ধরনের অন্য দেশিয় কোম্পানির ওষুধের দাম কম। সে গরীব মানুষকে নিজের কোম্পানি বাদে অন্য কোম্পানির কমদামী একই ওষুধ সাজেস্ট করে। গ্রামের লোক প্রথম প্রথম শুনতে চাইতো না, পরে দেখলো লুবনার দেওয়া অল্টার ওষুধ বেশ কাজ করছে। ফলে তার নাম দ্রুত বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। লোকজন পরামর্শ নিতে আসে।
কোনও স্বীকৃত চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়া লুবনা কোনও ওষুধ সাজেস্ট করেনা কাউকে। ওষুধের জেনেরিক নাম দেখে ওই একই ওষুধ কাদের কম দামে আছে কেবল সেটাই বলে দেয়। মানুষের মধ্যে এটুকুই স্বস্তি নিয়ে আসে। সন্ধ্যার পর নিজের লাইব্রেরি ঘরে বসে সে এই পরামর্শ দেয়। লাইব্রেরি তিল তিল করে গড়ে উঠে। অনেকে আছেন বিভিন্ন জায়গা থেকে বই নিয়ে আসেন লাইব্রেরিতে দিবেন বলে। লাইব্রেরি যদিও এখনো সবার জন্য উন্মুক্ত না।
লুবনা লাইব্রেরির নাম রেখেছে তার পেটেই নষ্ট হয়ে যাওয়া সন্তানের জন্য ঠিক করা নামে। সে জানতো না পেটের সন্তান মেয়ে হবে, না ছেলে! কিন্তু সে একটা মেয়ের নাম ঠিক করে রেখেছিল নিজের অনাগত সন্তানের জন্য। তার কেন যেন মনে হতো পেটের বাচ্চাটা একটা মেয়েই। লাইব্রেরিটাই এখন সেই কন্যার রূপ পাচ্ছে। লুবনার ইচ্ছা নভেম্বরের পাঁচ তারিখ যেদিন তার মিসক্যারিজ হয়েছিল, সেদিনই লাইব্রেরি সবার জন্য খুলে দিবে। ছোট একটা অনুষ্ঠান করবে। শীত পড়বে পড়বে করছে, এরকম এক ছুটিরদিনে লুবনার জীবনে দুইটি ঘটনা ঘটলো।
প্রথমটি হলো, সেদিন সকালে তার লাইব্রেরির জন্য এক সেল্ফ ভর্তি পুরানো বই ভ্যানে নিয়ে হাজির হলেন এক ব্যক্তি। বইগুলো তার বাবার। তারা মফস্বলের বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাচ্ছে রাজধানীতে, তাই সেগুলো লুবনার লাইব্রেরিতে দিতে এসেছেন। ভদ্রলোকের আনা বইগুলো ছিল পুরনো আর পোকায় কাটা। তবু প্রচুর বই। লুবনা খুব খুশি হয়ে গেল। সেগুলো লাইব্রেরিতে রেখে দিল। পরিচিত এক কাঠের মিস্ত্রিকে দিয়ে বার্নিশ আর প্রয়োজনীয় জিনিস আনালো দুপুরের আগেই, ঘূণে খাওয়া সেল্ফগুলো মেরামত করবে বলে। লাইব্রেরি সর্বসাধারণের জন্য চালুর সময় ঘনিয়ে আসছে।
দ্বিতীয়টি হলো, সেদিন দুপুরেই লুবনার সাবেক বর সোহেল এক ছোট্ট মেয়ে নিয়ে হাজির। দুইবছর বয়সী মেয়েটা কি মিষ্টি! প্রথমে সোহেলকে সে ঘরেই ঢুকতে দিচ্ছিলো না, কিন্তু বাইরে সেদিন অসময়ের বৃষ্টি শুরু হলো। সম্ভবত এই বৃষ্টি শীত টেনে আনবে। সোহেলকে ফিরিয়ে দেওয়া কোনও ব্যাপার না। কিন্তু পিচ্চিটাকে সে কীভাবে ফেরাবে!সোহেলের চেহারা আরও খারাপ হয়েছে। লুবনার মনে হলো এ লোক বাঁচবে না বেশিদিন। তারা ঘরের মধ্যে এসে বসলো। পিচ্চি আধো আধো কথা বলতে পারে, কেন যেন লুবনাকে মা, মা করছে। লুবনার খুব কষ্ট হচ্ছে। তার মনে পড়ছে, সে একটা আধাবাচ্চার মা ছিলো, যে পৃথিবীতে আসেনি।
লুবনা সোহেলের কাছে কিছুই শুনতে না চাইলেও, সোহেল গড়গড় করে গত কয়েকবছরে লুবনাকে ছেড়ে নতুন বিয়ে করায় কী সমস্যা হয়েছে, তার বিস্তারিত বিবরণ দিল। তার থেকে জানা গেল, বছর দুই আগে এই বাচ্চাটা হয়। মেয়েটার নাম নায়েলি রেখেছে। নায়েলিকে রেখে তার মা মাসখানেক আগে সোহেলকে ছেড়ে এক পাকিস্তানি গার্মেন্ট ব্যবসায়ীর কাছে আমিরাত চলে গেছে। লুবনার পৃথিবীতে না আসা আধা বাচ্চাটার নাম হিসেবে ঠিক করা ছিল নায়েলি নামটি। তার লাইব্রেরির নামও নায়েলি। সোহেল তাহলে তার দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীর বাচ্চার নাম রাখার সময় সে কথা ভোলেনি!
বাচ্চাটার নাম শুনে সোহেলের প্রতি মনে মনে কিছুটা নরম হলেও তার উদ্দেশ্য বোঝার চেষ্টা করে লুবনা। অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, সোহেল কিছু টাকা সাহায্য চায়। বলে, মেয়েটা এতোদিন নানাবাড়ি ছিল। সে ভালো হয়ে যাবে। মেয়েকে নিজের কাছে রাখবে। কিছু ঋণ আছে শোধ করে ভালো হয়ে যাবে। আর সেদিন রাতে থাকার অনুমতি চায়। লুবনা খুব কঠোর হয়। সে ঠিক করে সোহেলকে একটি টাকাও দিবে না। আর বাসায় রাখার তো প্রশ্নই আসে না! গ্রামের লোকে কী বলবে?
সে সোহেলকে জানায়, বাচ্চাটাকে সে রাখবে একরাতের জন্য। আর সোহেলকে হোটেলে থাকার টাকা দিচ্ছে, সেটা নিয়ে যেন সে কোনও হোটেলে থাকে। পরদিন এসে বাচ্চাটা যেন নিয়ে যায়। সোহেল রাজি হয়না, সে অজুহাত দেখায় বৃষ্টির, বাচ্চার। লুবনা কিছুতেই তাকে ঘরে থাকতে দেবে না। শেষে সোহেল প্রস্তাব দেয় সে বাইরের লাইব্রেরি ঘরে থাকলে তো ক্ষতি নেই। লুবনা ভাবে প্রস্তাবটা খারাপ না। বাইরের লাইব্রেরি ঘরের অবস্থা যদিও ভালো না, কিন্তু সোহেলের জন্য সেই ঢের। বিকালে বৃষ্টি থেমে যায়। সোহেল লুবনার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে বাজারের দিকে যায়।
এসময়টা লুবনা আর নায়েলি একা হয়ে পড়ে। পিচ্চি কি সুন্দর হাসে! গোটা গোটা হাত, গা দিয়ে ভুর ভুর করে আসন্ন শীতের গন্ধ। পুরোটা বিকাল আর সন্ধ্যা লুবনার বাড়িতে আলো জ্বললো যেন! সন্ধ্যার পর শিশুটা যেন জোনাক হয়ে ছুটে বেড়াতে লাগলো উঠোনে। এমন মধুর সময় শেষ কবে এসেছিল লুবনার জীবনে! সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সোহেলকে সে টাকা দিবে, বিনিময়ে নায়েলিকে রেখে দিবে। সোহেল বেশিদিন জ্বালাতে পারবে না। তার যা স্বাস্থ্যের অবস্থা, অচিরেই মারা যাবে। লুবনা ভাবে সকালে এই প্রস্তাব দিবে।
রাতে খাওয়ার পর সোহেলের থাকার ব্যবস্থা হলো লাইব্রেরিতে। সোহেল ঘুমাতে গেল। মধ্যরাতে তীব্র আলোয় ঘুম ভেঙে গেল লুবনার। লাইব্রেরিতে আগুন ধরেছে। সেকি আগুন! দুপুরের বৃষ্টির কারণে বাড়িটায় আগুন ছড়ালো না, কিন্তু লাইব্রেরি পুরোটা পুড়ে গেল। পরদিন পুলিশ আর ফায়ার সার্ভিসের লোক এসে সোহেলের কয়লা হয়ে যাওয়া লাশ উদ্ধার করলো। তারাই জানলো, আগুন সম্ভবত লেগেছে কয়েল বা সিগারেট থেকে, ভেতরে বার্নিশ আর বইয়ের মতো দাহ্য পদার্থ থাকায় মুহূর্তে ছড়িয়ে গেছে।
লুবনা খুব কাঁদলো তার লাইব্রেরির জন্য। এসময় নায়েলি তার ছোট হাত দিয়ে লুবনার চোখ মুছে দিতে লাগলো। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে, লুবনা ভাবলো, আসলে নিজের সন্তান ছিলো না বলেই তো সন্তানের নামে লাইব্রেরিটা করা। ভাগ্য তাকে মৃত আধাবাচ্চার জায়গায় একটা পুরো জ্যান্ত টগবগে বাচ্চা দিয়েছেন। একেই মানুষ করা তার ব্রত হওয়া উচিত। না, সোহেল মরে গিয়ে বরং ভালোই হয়েছে, লাইব্রেরি পুড়ে যাওয়ায় হয়তো আল্লাহর ইশারা রয়েছে। পরের কয়েকদিনে বাচ্চা মানুষের জন্য সে চাকরি ছেড়ে দিলো, বাবার কিছু জমি বিক্রি করে দিলো, একটা দোকান কিনলো আর পুরোটা মনোযোগ দিলো নায়েলিকে নিয়ে ভবিষ্যত পরিকল্পনায়।
মাস ছয়েক পর সব থিতু হলে একদিন বাড়িতে পুলিশ এলো। তাদের সাথে এক দম্পতি। জানা গেল, সোহেল এদের বাসায় সাব্লেট থাকতো, আর বাচ্চাটা আসলে তাদের সোহেলের নয়। বাচ্চাটার নামও নায়েলি নয়, রুকাইয়া। সে বাচ্চা চুরি করে নিয়ে লুবনার কাছে এসে ছিল সিম্প্যাথি আদায় করে টাকা নেয়ার জন্য। তার দ্বিতীয় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে গেছে সত্যি, আর সেটাও মাদকাসক্তির কারণেই। তারা নিয়ে গেল নিজেদের বাচ্চাকে। যাবার সময় খুব কাঁদছিলো নায়েলি। লুবনা অনাগত আধাবাচ্চার মা হিসেবেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছিল।