বাবার হাসি

বাবার হাসি

একটু আগেই ঝুম বৃষ্টি হয়েছিলো অথচ তার রেশ একটুও বুঝার উপায় নেই। শুধুমাত্র পথঘাটের দিকে তাকালেই কেবল বুঝা যায় একটু আগে খুব বৃষ্টি হয়েছিলো। আকাশটা একদম ঝরঝরে লাগছে। কোথাও মেঘের চিহ্নটুকুও নেই। পুরো আকাশ জুরো রোদের লুটোপুটি খেলা চলছে। মাঠের ঘাসগুলোর প্রতিটা ডগায় জমে আছে বিন্দু বিন্দু পানির কণা। হালকা মৃদু বাতাসে ঘাসগুলো তরতর করে নড়ছে। যেন ঘাসগুলো বেজায় খুশি। হাওয়ার তালে তালে মন দুলিয়ে নাচছে! আর গানের ছন্দ তুলছে! এক ফালি সূর্যের কিরণ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ঘাসের ওপর উঁকি দিতেই ঘাসের ডগায় জমে থাকা পানির বিন্দু কণাগুলো হীরের মতো জ্বলজ্বল করে উঠলো। মানুষ কত অর্থ ব্যয় করে শুধুমাত্র সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য। এ দেশ ছেড়ে বিদেশ যায়! অথচ চোখের সামনেই যে এত মনোরোম দৃশ্য তা আধেও কী তাদের চোখে পরে না? চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো মৃদুর! উফ কী মুগ্ধকর দৃশ্য!

–কিরে মৃদু এখানে দাঁড়িয়ে কী ভাবছিস?”
কারও কথায় ভাবনায় ছেদ পরলো মৃদুর। একটু হেসে জবাব দিলো,
–সৌন্দর্য দেখছি। দেখবি তুই?”
মৃদুর প্রশ্নে বিরক্তবোধ করলো পাশে দাঁড়িয়ে থাকা নেহা। তার কপালে সুক্ষ্ম বিরক্তিকর ভাঁজ।
–মৃদু সৌন্দর্য দেখার টাইম নাই। চল ফরম ফিলাপটা সেরে নেই। আজই লাস্ট ডেট।”
মৃদুর দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসলো। ঘাসের ডগার সৌন্দর্য ঠিকভাবে চোখে ধারণ করতে পারছে না। চোখের পাপড়িগুলো বড্ড কাঁপছে। মৃদু সুক্ষ্ম গলায় বললো,
–জানিস নেহা খুব আফসোস লাগছে আমার। কেন যে ঘাস হলাম না!”
–মৃদু তোর হয়েছেটা কী? ফাজলামো না করে চল না।”
–সত্যিই একবার তাকিয়ে দেখ ওদের, কোনো দুঃখ নেই! কতটা সুখী ওরা! কী সুন্দর হাওয়ায় গা ভাসিয়ে নাচছে!”
নেহা এবার হাত ধরে টানতে লাগলো মৃদুর!
–বহু উদ্ভট কথাবার্তা হয়েছে, এখন চল। আগে ফরম ফিলাপট করি পরে না হয় তোর এই আবোলতাবোল বক্তব্য শুনবো।”
মৃদু শক্ত হয়ে দাঁড়ালো। মুখ থেকে যেন কথা বের হওয়ার শক্তি নেই ওর! কোনোরকম অধরা গলায় বললো,
–আমার আর ইন্টার পরীক্ষা দেওয়া হবে না রে নেহা। বাবা টাকাটা ম্যানেজ করতে পারেনি রে। কী বা আর কারার আছে বাবার। মহাজনরে এত বার করে বললো তবুও মহাজন তার কথায় অটল!
” জাবের, তুমি দৈনিক মজুরী হিসেবে কাম করো। তোমারে বাড়তি টাকা দিলে তুমি তা শোধ দিতে পারবা না। এত মাইয়্যা পড়ানের কী আছে? ডাক্তার বানাইবা নাকি? না মাস্টর বানাইবা? সেই তো কয়দিন পর মাইনষের বাড়ি গিয়া চুলাই গুঁতাইতে হইবো। এত পড়ানের কী দরকার? মাইয়্যা মানুষ। তার উপ্রে বয়সও তো আর কম হইলো না এইবার বিয়া সাদি দিয়া দাও। ঝামেলা বিদায় হোক।”

মৃদু কথাগুলো বলতে বলতেই ডুকরে কেঁদে ফেললো। নেহার স্বান্তনা দেবার মতো কোনো ভাষা নেই। তারও চোখ ভিজে উঠেছে। সহসাই চির পরিচিত কণ্ঠ কানে বাজলো।
–আমার মৃদু মায়রে চিনেন আমনে? এই কলেজেই পড়ে। ফর্সা কইরা আমার মায়। ভালা ছাত্রী।”

মৃদু পিছু ফিরলো। একজন ছাত্র ওর বাবাকে দেখেই নাক সিটকে দূরে সরে গেল। যেন কোনো পাগল তার বুলি বলছে! পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই। পা ভর্তি কাদা, হাঁটুর একটু নিচে করে লুঙ্গি পরনে, গায়ে একটা ঘামে ভেজা বহু পুরনো শার্ট, গলায় একটা আধাপুরনো লাল গামছা। মুখ ভর্তি বড় বড় দাড়ি, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, বয়সের ছাপ চোখে-মুখে বিরাজমান তবে ঠোঁটের কোণে একটা প্রাপ্তির হাসি। মৃদু দৌড়ে গেল বাবার কাছে,
–বাবা তুমি এখন?”
উনি একরকম অস্থির হয়ে পকেট থেকে কতগুলো টাকা বের করলেন। মেয়ের হাতে টাকাগুলো গুঁজে দিতে দিতে বললেন,
–গুনে দেখ তো ঠিক আছে কি না? মহাজন তো কইলো পুরা সাড়ে পাঁচ হাজার টিয়াই আছে।”
কথাটা শেষ করেই আলগোছে নিজের কপালের ঘাম মুছলেন তিনি। সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসেরও আভাস মৃদুর চোখে ধরা পড়লো। বাবার চোখগুলো যেন খুশিতে জ্বলে উঠেছে। কেমন হীরের মতো চকচক করছে।
মৃদু টাকাগুলো গুনলো না। তার চোখ ভিজে উঠেছে। চোখের কী আজকাল কোনো রোগ হলো নাকি? সময় নেই- গময় নেই যখন-তখনই ভিজে উঠে! এটা মোটেও ঠিক না!
–বাবা উনি তো বলে ছিলেন টাকাটা দেবেন না। তাহলে?”
–তোমারে ওসব নিয়া চিন্তা করতে হইবো না মা। তুমি মন দিয়া পড়ালেহা করো। যতদিন এই বাপ বাঁইচ্যা আছে তোমার অত চিন্তা করোন লাগবো না। আমি যাই। মেলা কাম মহাজনের ঘরে।”
কথা শেষ করেই ঘুরে দাঁড়ালেন মৃদুর বাবা। কী একটা ভেবে যেন আবারও পিছু ফিরলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হেসে বললেন,
–মা ঠাওরে ঠাওরে বাইত যাইয়ো। আইজকাইল যা হুনি মন টাইঙ্গা থায়ে কহন বাড়ি ফিরবা। দিনকাল ভালা না মা। তড়াতড়ি কাম সাইরা বাড়ি চইল্যা যাইয়ো।”

মৃদু কথা বলতে পারলো না। তার গলা কাঁপছে। হাত-পা ঝিনঝিন করছে। বুকের কোথাও যেন চিনচিন ব্যথা করছে। এত কষ্ট কেন লাগছে মৃদুর! শুধু মাথা নেড়ে সায় দিলো। তার বাবা ঢুলুঢুলু পা ফেলে চলে যাচ্ছে। গায়ে যেন কোনো শক্তি নেই। সারাটা পিজের রাস্তা দিয়ে এইভাবেই খালি পায়ে হেঁটে যাবে মানুষটা। ইশ! পায়ে ইটের খোয়ার গুঁতো লাগবে। কতদিন হয়ে গেল এক জোড়া স্যান্ডেলও নেই বাবার। চোখের কার্নিশ উপচে উষ্ণ নোনাজলের তীব্র স্রোতধারা বইতে লাগলো মৃদুর। বাবারা কেন এত ভালো হয়? নির্ঘাত বাবা রাত জেগেও কাজ করবেন শুধুমাত্র এই ঋণের টাকা শোধ করার জন্য। কত ভারী ভারী বোঝা মাথায় টানতে হয় এখন কষ্টটা আরও দ্বিগুণ হয়ে গেল! নেহা এসে ডাকলো,
–মৃদু চল। তাড়াতাড়ি ফরম ফিলাপটা সেরে নেই।”
–নেহা বাবাকে আর কষ্ট দিতে মন চায় না রে। সারাজীবন বাবাকে কষ্ট করতেই দেখলাম। মাকে, আমাকে, ভাইকে সবাইকে এই মানুষটা খুশি রাখে অথচ নিজের খুশির কথা একবারও ভাবে না। সব বাবাগুলোই কী এমন হয় রে?”
নেহা কিচ্ছু বললো না। অবশ্য মৃদুর এই প্রশ্নের সে নিজেই কোনো উত্তর চায় না। একটা জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেললো মৃদু!
–জানিস নেহা, একদিন আমি বাবাকে আর কষ্ট পেতে দেব না। বাবার সব ইচ্ছাগুলো পূরণ করবো আমি। আমার এই নিজের হাতে। বাবা না কখনো আমি মেয়ে বলে হেলাফেলা করেনি। সবসময় যা চেয়েছি বাবা নিজের সাধ্যের মধ্যে হলে কখনো না করেননি। আমার সব চাওয়াগুলো পূর্ণ করেন নির্দিধায়। আমিও বাবার সব চাওয়াগুলো পূর্ণ করবো। মানুষটা কখনো মুখ ফুটে কিচ্ছু বলেন না। তবে আমি বুঝি বাবারও যে একটা মন আছে কিন্তু সবার চাওয়া-পাওয়ার মাঝে নিজের চাওয়া-পাওয়াগুলো অনায়াসেই লুকিয়ে রাখেন! আমি একদিন ঠিক পারবো! আমাকে পারতেই হবে!”

ওড়নায় চোখ মুছে ঘুরে দাঁড়ালো মৃদু আগে যে তাকে বড় হতে হবে। তবেই না সে পারবে বাবার চাওয়া-পাওয়াগুলো পূর্ণ করতে। নতুন স্বপ্নকে বুনতে সামনে এগিয়ে চললো মৃদু! পেছনে ফেলে রাখলো কিছু উষ্ণ নোনাজল আর সঙ্গে নিলো বাবার মুখের ঝলকানো হাসি! এত মিষ্টি করে মানুষটা হাসে কী করে? একদম বুকে গিয়ে তীব্রভাবে লাগে! ভেতরটায় তখন কী যে একটা হয়! এই হাসির মাঝে যেন লুকিয়ে থাকে কত না অব্যক্ত ভাষা! এই ভাষা আদৌও কী একদিন বুঝবে মৃদু?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত