খুব অসহায়

খুব অসহায়

সন্ধ্যাবেলা হাসপাতালের মূল ফটক দিয়ে ঢুকে ডান পাশের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন,
“বাবা কেমন আছো?”
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম উনি আমার পূর্ব পরিচিত কিনা। এর আগে কখনো দেখা হয়েছে বলে মনে পড়ল না। সাদা পাঞ্জাবী-পাজামা, মাথায় গোল টুপি, মন খারাপের একটা ছাপ তাঁর পুরো মুখমন্ডলে লেগে আছে। আমি বললাম,
“জ্বী ভাল আছি। আপনি কেমন আছেন?”
–“ভাল নেই বাবা। কিছুক্ষণ সময় হবে তোমার?”
–“কেন বলুন তো?”
–“একটু কথা বলতাম আর কি, একা একা আর কতক্ষণ ভাল লাগে বল?”
ভদ্রলোকের কথা শুনে বেশ মায়া লাগল। সত্যি তো একা একা কতক্ষণ থাকা যায়? বাবার কেবিমে কেউ একজন না থাকলে বাবা অস্থির হয়ে ওঠেন। উনার হয় তো কথা বলার মতন তেমন কেউ হাসপাতালে নাই।
উত্তরের অপেক্ষায় উনি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি বললাম,
“জি বলুন।”
–“বাবা চল আমরা ঐ গাছটার নিচে গিয়ে বসি। তুমি করে বলছি, কিছু মনে করছ না তো?”
–“না না আংকেল ঠিক আছে, আপনি আমাকে তুমি করেই বলুন।”
–“বাবা নাম কি তোমার?”
–“আমি জিহাদ।”
–“হাসপাতালে কেন?”
–“বাবা কিছুদিন থেকে হাসপাতালে ভর্তি তো তাই।”
–“ও আচ্ছা। তোমার কি খুব তাড়া আছে?”
–“তেমন কোন তাড়া নেই। বাবার কেবিনে ভাইয়া, আম্মু আছে প্রয়োজন পড়লে ফোন করবে।”
ভদ্রলোক খানিক সময় চুপ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
–“তোমাকে একটা গল্প বলি?”
–“কিসের গল্প আংকেল?”
–“জীবন-সংসারের গল্প।”
–“আচ্ছা।”
উনি বলতে শুরু করলেন।
“পুরুষ মানুষের প্রকৃত জীবন শুরু হয় কখন জানো তো? সংসার জীবন শুরুর পর থেকে, মানে বিয়ে-শাদীর পর থেকে।”
–“হ্যাঁ।”
–“বিয়ের আগ পর্যন্ত সংসারের প্রতি দায়িত্ব-বোধ পুরুষ মানুষের খুব কম থাকে, যা ইচ্ছা তাঁরা করে বেড়ায়, ইচ্ছা হল তো গোসল-আসল করল নয়ত ঘুমিয়ে থাকল, খেতে ইচ্ছা করলে খেল নইলে বাইরে চলে গেল, বাড়িতে ফেরার নির্দিষ্ট কোন সময় তাদের থাকে না। আড্ডা-বাজি, গল্প-গুজব ঘুরে বেড়ানো এসব করেই তাঁরা দিন কাটায়। পড়াশোনা শেষে আমিও অন্যান্যদের মতন একজন দায়িত্ব-কর্মহীন যুবক ছিলাম। কোন কাজ-কর্ম ছিল না, দিনে স্ট্রীট রোডে বার কয়েক পদধুলি রাখা, মহল্লার চায়ের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে বন্ধুদের সাথে গাল-গল্প করে সময় খুব সুখেই কাটছিল। চাকরি খোঁজার কোন তাড়া ছিল না। বাবা মাঝে মাঝে বলতেন, ‘সংসারের হাল টা এবার ধর, আমার বিশ্রামের প্রয়োজন।’ বাবার ওসব কথা শুনে মনটা খানিক খারাপ হত, ব্যাস এতটুকুই। চাকরি মানেই যে জীবনের ষোল আনা স্বাধীনতার বিসর্জন তা আমি বেশ ভালোই বুঝতাম, ভাবতাম—সবে মাত্র পড়শোনা শেষ করেছি, যাক না কিছুদিন এরপর চাকরি নিয়ে ভাবা যাবে। কিন্তু ছন্নছাড়া জীবনের খুব দ্রুতই অবসান ঘটল, বাবা হঠাৎ একদিন অসুস্থ পড়লেন। ডাক্তার দেখানোর পর জানা গেল, তাঁর এই ব্যামো আর নিরাময় যোগ্য নয়। তারপরও চেষ্টার কমতি আমরা রাখিনি, শহরের বড় বড় নামকরা ডাক্তার দেখিয়েও কোন লাভ হল না। সকলের একই কথা, স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ব্যতীত তাকে কারও পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব না।

বাবাকে দেখে কখনো মনে হত না তাঁর পশমের গোড়ায় গোড়ায় মৃত্যুর ডাক প্রস্ফুটিত হচ্ছে, মুখে অসুস্থতার কোন ছাপই ছিলো না। হয়ত তিনি শরীরের সব যন্ত্রণা দাঁত চেপে সয়ে গেছেন।

বাবা অসুস্থ হবার পর থেকে নিজেকে খুবই দায়িত্বহীন, অপদার্থ বলে মনে হচ্ছিল। পরিবারের জন্য কখনো কিছু করার দায়িত্ববোধ আমার মধ্যে কাজ করেনি। আমি হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজতে শুরু করলাম। একদিন বিকেল বেলা বাবা আমাকে তাঁর ঘরে ডেকে পাঠালেন। আমি বাবার ঘরে গিয়ে বললাম,
“বাবা ডেকেছো?”
–“হ্যাঁরে, ডাকছিলাম। চল বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসি।”
–“কোথায় যাবে?
–“এই একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি। তোর কি কোন কাজ আছে? কাজ থাকলে থাক।”
আমি বললাম,
“নাহ বাবা কোন কাজ নেই, চল।”
লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবা বললেন,
“জাফর!”
–“বল বাবা।”
–“আসলে হাঁটতে আসাটা মূল উদ্দেশ্য ছিল না, তোকে কিছু কথা বলতে বাইরে আসা। ব্যক্তিগত কথা কি না। বলব?”
–“বল বাবা।”
–“তোর কি কাউকে পছন্দ আছে? মানে কাউকে পছন্দ-টছন্দ করিস কি না?”
–“নাহ বাবা, তেমন কেউ নাই। কেন বল তো?”
–“শরীরটা বেশি ভাল যাচ্ছে না বুঝলি, তোদের তো কোন গতি করে দিয়ে যেতে পারলাম না। কখন না কখন চলে যাই তার তো আর ঠিক-ঠাকানা নাই, যদি পছন্দ থাকে তবে বলতে পারিস।”
–“নাহ বাবা নাই।”
–“আমাদের রিমিকে তোর কেমন লাগে?”
–“ভালোই তো।”
–“কেন জিজ্ঞাসা করলাম, বুঝতে পারছিস তো?”
–“হ্যাঁ বাবা।”
–“যদি ওর সাথে তোর বিয়ে দেই, তোর কি কোন আপত্তি আছে?”
–“না, বাবা।”
–“তুই কি সবকিছুতে আমার অসুস্থতার কারণে পজেটিভ উত্তর দিচ্ছিস? দেখ তোকে যে বিয়েটা করতেই হবে এমন কোন বাধ্যবাদকতা নাই। ইচ্ছা হয় তোর বিয়েটা দেখে যাই। কোন জোর-জবরদস্তি নেই, আজ বাসায় গিয়ে ভাববি। সত্যিই যদি তোর মন সাড়া দেয় তাহলে কাল আমায় জানাস।”
–“আচ্ছা”

গল্পের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল সবকিছু আমার চোখের সামনে ঘটছে। বাস্তবে ফিরলাম জাফর আংকেল ডাক দেবার পর। আংকেল বললেন,
“কফিওয়ালা এসেছে, তুমি কি কফি খাবে? যদি খাও তাহলে বিল কিন্তু তোমাকেই দিতে হবে, আমার কাছে কোন টাকা-পয়সা নাই।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
–“আপনি খাবেন না?”
–“নাহ বাবা আমি কফি বিশেষ পছন্দ করি না।”
আমি কফি নিলাম। কফির কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞাস করলাম,
“এরপর কি হল?”
পারিবারিক ভাবে রিমির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর কিছুদিন খুব আনন্দ-হৈচৈ এর মধ্য দিয়ে কেটে গেল। বাবার উজ্জ্বল-হাসিমুখ দেখে মনে হত একটা মিরাকল ঘটে গেছে, সৃষ্টিকর্তা বুঝি বাবাকে পুরোপুরি সুস্থ করে দিয়েছেন। সকাল থেকে তিনি সারাদিন হৈ-হুল্লোড় করে সময় কাটাচ্ছেন। রিমির সাথে খোশ-গল্প, মাকে যত ভাবে রাগানো যায় তিনি রাগাচ্ছেন। জীবনের সবথেকে সুখের দিনগুলো কাটছিল।

এমনই এক হৈচৈ এর সন্ধ্যায় ডাইনিংয়ে চা খেতে খেতে আমরা গল্প করছিলাম। গল্পের মাঝে হঠাৎ চায়ের কাপ হাতে বাবা চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন, আমি এগিয়ে গিয়ে বাবাকে ধরে তুললাম, মুহূর্তেই সবার মুখের হাসি মুছে গেল। বাবাকে আমরা ঘরে নিয়ে গেলাম। আমি ডাক্তার নিয়ে আসতে যাচ্ছিলাম, বাবা যেতে দিলেন না। আমাকে বললেন, “পাশে বসতে।” আমি বসলাম। বাবা এরপর রিমিকে ডেকে রিমির হাত আমার হাতে রেখে বললেন,
“মেয়েটা খুব সহজ-সরল, মেয়েটাকে সবসময় দেখে রাখবি। কখনো কষ্ট দিস নারে।”
ঘরের পরিবেশ হাঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। বাবা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন।

বিয়ের পর চার মাস পর্যন্ত বেকার জীবন কেটেছে এরপর যেই চাকরিটা পেলাম তার বেতন খুব বেশি ছিল না কিন্তু চাকরিটা করতে আমি বাধ্য ছিলাম। বাবা যতদিন বেঁচে ছিল মাথার উপর একটা ছায়া ছিল। বিয়ের পর রিমির ভরণপোষণ, মার দেখাশোনা- সংসারের সব চাপ মাথায় এসে ভর করছিল।

মাঝে মধ্যে অফিসের কাজের মধ্যে স্মৃতির পাতা খুলে বসতাম। ছন্নছাড়া জীবনের পতন মনটাকে বিষন্ন করে তুলত, যেই আমি কিনা স্ট্রীট রোড, চায়ের দোকানে সারাদিন পড়ে থাকতাম, সেই আমিই তখন মাসেও একবার স্ট্রীট রোডে যেতাম না৷ সকাল থেকে সন্ধ্যা আমার অফিসেই কেটে যেতো, মাঝখানে কেবল একবার লাঞ্চ ব্রেকে আধাঘন্টার জন্য নিচে যাওয়া। ছন্নছাড়া জীবনে ছন্দ এসেছে পাড়ার অনেকে বলত। জীবনের এই ছন্দই প্রত্যেক পুরুষের জীবনকে সীমাবদ্ধ করে দেয়। পুরুষ জীবনে ছন্দ আসা মানে, রোজ সকালে স্নান সেড়ে গাড়িতে চেপে অফিসে যাওয়া, সারাদিন অফিসে কাটিয়ে সন্ধ্যাবেলা আবারও গাড়িতে চেপে বাড়ি ফেরা, ভাগ্য ভাল হলে মাঝে মধ্যে সিট পাওয়া যায়, না হলে পুরো রাস্তা দাঁড়িয়ে আসা। গাড়ি থেকে নেমে বাজারে একটু উঁকিঝুকি মেরে বাসায় ফিরে কাপড়-চোপড় ছেড়ে মুখ-হাত ধুয়ে এক কাপ চা হাতে বারান্দায় অথবা ছাদে গিয়ে কিছু সময় কাটানো, এরপর রাতের খাবার শেষ করে দু’চার দশমিনিট টেলিভিশনে চোখ বুলিয়ে নিয়ে রাতকে বিদায় জানানো। এই ছন্দেই পুরুষদের জীবন অতিবাহিত হয়। একেই পুরুষ জীবনের ছন্দ বলা হয়।

আমাদের ঘরে প্রথম সন্তানের জন্ম হল বিয়ের দুই বছর পর।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
“ছেলে নাকি মেয়ে?”
–“ছেলে।”
–“এরপর?”
ছেলের জন্মের পর সংসারের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে গেল, অথচ আমার তখনও বেতন বাড়েনি। অসংখ্যদিন আমি-রিমি খাবারের যন্ত্রণা সয়েছি তবে ছেলেকে কখনো খাবারের কষ্ট সহ্য করতে হয়নি।

আমাদের ঘরে ফাহিমের পর ফাহাদ, ফয়সাল একে একে জন্ম নিল। ততদিনে চাকরি বদলে অন্য অফিসে ঢুকেছি, মাইনে বেশ ভাল পেতাম। সংসারে তিন ছেলের খরচ, বাজার-সদাই করেও কিছু অবশিষ্ট টাকা থেকে যেত। সেই টাকা ফাহিমদের ভবিষ্যতের জন্যে ব্যাংক ডিপোজিটে জমাতাম।

ফাহিমরা দেখতে দেখতে একে একে বড় হল। মা ঘুমের মধ্যেই একদিন ওপারে পাড়ি জমালেন। মাকে হারিয়ে বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। রিমিকে প্রায় রাতেই কান্নাকাটি করতে শুনতাম। মায়ের অনুপস্থিতি যেন আমার চেয়ে তাকেই বেশি কষ্ট দিচ্ছিল, মাকে সে খুব আপন করে নিয়েছিল, তাঁর মা তাকে সেই ছোট বেলা ছেড়ে চলে গিয়েছিল কিনা, এজন্যই হয়ত মায়ের মর্ম বুঝত। কিন্তু আমি? বাবার বিয়োগান্তের এক বিশাল পাথর বুকে চেপে কতগুলো বছর কাটিয়ে দিয়েছি এবার যোগ হল মায়ের। রোজ ঘরে ঢুকতেই মনে পড়ত, ডাইনিং এর ঐ চেয়ারটায় বাবা পদ্মআসনে বসে মাকে রাগিয়ে যাচ্ছেন, মা’ও রাগে মুখ ভার করে রেখেছেন। আমিও কাঁদতাম, খুব কাঁদতাম, কাঁদতে কাঁদতে আমার অন্তর-আত্না বের হয়ে আসতে চাইত, তবে আমার কান্নায় কোন শব্দ হত না।

পুরুষ মানুষের খুব বেশিদিন শোকের ছাপ মুখে রাখতে নেই। আমি খুব দ্রুত শোক কাটিয়ে উঠলাম। আমাদের সোনালী সুখের সেই দিনগুলো হারিয়ে তিনছেলেকে জাপটে ধরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম।

ফাহিম বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে বিদেশ পাড়ি দিল। এরপর ফাহাদ, ফয়সালও একে একে আমাদের ছেড়ে চলে গেল। পুরো বাড়িটা ফাঁকা হয়ে গেল। কখনো ভাবিনি ছেলেরা সব আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। ফাহিম-ফাহাদকে বিদেশ যাবার সময় আমি বারণ করিনি, ওদের মা খুব করে নিষেধ করেছিল। মায়ের মায়া উপেক্ষা করে এটা সেটা বুঝ দিয়ে ওরা চলে গেছে। ভাইদের মধ্যে ফয়সাল ছোট। ফয়সালও যখন ফাহিমদের মতন বিদেশ যাবার সিদ্ধান্ত নিল, বুকের ভেতরটা শূণ্যতার দহনে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিল। তিন ছেলের মধ্যে কেবল ফয়সালকেই বলেছিলাম,
“তুইও যদি চলে যাস তবে আমরা থাকব কি করে বলত?”
ফয়সাল বলেছিল,
“বাবা এই তো কয়টা বছর পরেই ফিরে আসব। দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।”
দেখতে দেখতেই যে সময় কেটে যায় সে আমার জানা হয়ে গেছে। ফাহিম, ফাহাদ সেই যে গেল আর ফিরে এলো না। কয়টা বছর বুঝি আজও কাটেনি? প্রথম প্রথম ওদের সাথে কিছুদিন বেশ যোগাযোগ হত, ধীরে ধীরে বাপ-মাকে ভুলে যেতে ওরা ভুল করেনি।

ফয়সাল চলে যাবার পর থেকে রিমি সারাক্ষণ থেমে থেমে কাঁদে, মনমরা হয়ে থাকে। আমি রিমিকে নিয়ে পার্কে যাই, ছুটিতে দেশের এক যায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যাই কিন্তু রিমির সেই কান্না আর থামে না। রিমির মতন আমি কাঁদতে পারতাম না ঠিকই কিন্তু কে জানে আমার মনে কত ঝড়-বৃষ্টি, টর্নেডো বয়ে যেত?

রিমির কান্নাও একদিন থেমে গিয়েছে। একরাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরে দেখি রিমি বিছানার পাশে মেঝেতে শুয়ে আছে। আমি ডাকলাম,
“রিমি! এখানে শুয়ে আছো কেন? উঠ, উঠ এখুনি উঠ।”
রিমি উঠল না, কাছে গিয়ে রিমির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম,
“এত রাত করে মেঝেতে কেউ শুয়ে থাকে? ঠান্ডা লেগে যাবে তো উঠ।”
রিমি একবিন্দু নড়ল না। মনে খটকা লাগল, বুকটা ধড়ফড় করতে লাগল। ভয়ে ভয়ে গায়ে হাত দিলাম। রিমির শরীর বরফের মতন ঠান্ডা, আমার রিমি শ্বাস নিচ্ছে না। গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে শুকিয়ে গেছে, চোখ থেকে থুঁতনি পর্যন্ত চোখের জলের দুটো রেখার স্পষ্ট দাগ এখনো রয়ে গেছে। বাবা মৃত্যুশয্যায় রিমির হাত আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন,
“মেয়েটা খুব সহজ-সরল, দেখে রাখিস, কখনো কষ্ট দিস না।”
বাবার কথা আর রাখতে পারলাম কোথায়?
রিমির মৃত্যুর খবর ছেলেদেরকে জানানোর ইচ্ছে হচ্ছিল না। যেই ছেলেরা সকল মায়া ত্যাগ করে মা-বাবাকে একলা ফেলে চলে গেছে, মায়ের মৃত্যু সংবাদ কতটুকুই বা তাদের মনে দাগ কাটবে? তারপরও জানালাম।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
–“উনারা কি এসেছিল?”
–“নাহ, ওদের এত সময় কোথায়? তিনজনই জানাল, বাবা এখান থেকে চাইলেই তো আর চলে আসা যায় না, বেশ সময়ের ব্যাপার।”
মায়ের মুখ শেষবারের জন্যে দেখার ইচ্ছা ওদের কারই হলনা। রিমির লাশের খাট কাঁধে নিয়ে ছুটলাম গোরস্থানের দিকে। পৃথিবীতে এই একটা মানুষই ছিল, যে সুখে-দুঃখে সবসময় পাশে থেকেছে, কখনো ছেড়ে যায় নি। রিমিকে হারিয়ে আমি একা হয়ে গেলাম, ভীষণ একা।
আমার চোখ থেকে অঝর ধারায় জল পড়ছে, অথচ আমি একবারও কাঁদিনি এই কান্নাকে কেমন কান্না বলে? চোখ মুছতে মুছতে আমি জাফর আংকেলকে জিজ্ঞাসা করলাম,
–“আপনার ছেলেরা আর কখনো দেশে ফিরেনি?”
জাফর আংকেল ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“একবার তিন ছেলেকেই ডেকেছিলাম। বয়স হয়ে গেছে, যে কোন সময় আমার যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে। বিষয় সম্পত্তি তিনজনকে বুঝিয়ে দিয়ে জীবনের শেষ দায়িত্ব পূরণ করতে পারলেই বাঁচি। ছেলেরা বড় হয়েছে যে যে যার যার মতন বিদেশ গিয়ে বিয়ে-শাদী করেছে, বাবা হয়েছে। নাতি-নাতনিদের কখনো কাছে পাইনি, ওসব নিয়ে আমার কোন আক্ষেপ নাই। পৃথিবীতে যেমনি একা এসেছি তেমনি একাই যেতে হবে। শেষ টা ওদেরকে বুঝিয়ে দিতে পারলেই রক্ষা পাই কিন্তু ওরা আর এলো না। আজ ওদের টাকা-পয়সার কোন কমতি নেই। ভিটে-মাটি, অল্পকিছু পেনশনের টাকা এসব দিয়ে কি হবে ওদের? সেদিনের সেই ছোট্ট ফাহিম যে কিনা গুড়ো দুধ ছাড়া ভাত-টা পর্যন্ত খেত না, তাকে সেই গুড়ো দুধ কিনে দিতে বাবা-মাকে কত-শত বেলা উপোস থাকতে হয়েছে এসব ওরা জানে না। বাবা-মায়েরা সন্তানদের জন্য শত-সহস্র রাত উপোস কাটাতে পারে, কিন্তু তাদেরকে বড় করতে কত কি উৎসর্গ করেছে, কত রাত উপোস থেকে কাটিয়েছে, ভাল একটা জামা না কিনে সন্তানদের জন্য খেলনা কিনেছে, এসব প্রকাশ করতে জানে না। আমার বাবা-মাও কখনো প্রকাশ করেনি, আমরাও করিনি, হয়ত ফাহিমরাও করবে না।

জাফর আংকেল খানিক সময় চুপ থেকে জড়ানো গলায় বললেন,
বাড়িটা এখন বৃদ্ধাশ্রম। পৃথিবীতে কেবল আমিই তো একা নই। আমার মত অসংখ্য বাবা-মায়েরা একা, খুব একা। পেনশনের টাকা তুলে ব্যাংকে রেখে দিয়েছি। প্রতিমাসে যা লাভ আসে তাই দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের খরচ চলে।
জাফর আংকেলের চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। আমি নিস্তব্ধ-বাকরুদ্ধ হয়ে বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছি। বলার মতো কোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।

জাফর আংকেল চোখ মুছে আমার মাথার চুলে আঙ্গুল বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
“গল্পটা এখানেই শেষ। বাবা-মাকে কখনো ছেড়ে যেয়ো না বাবা। সন্তানদের ছাড়া তাঁরা খুব একা, খুব অসহায়। আজ তাহলে উঠি।” —বলে জাফর আংকেল হাসপাতালের লাশ সংরক্ষণ ঘরের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি নিশ্চুপ চোখে তাঁর চলে যাবার দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম।

বাবা সপ্তাহ-খানেকের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠলেন। বাড়ি ফেরার কিছুদিন পর সকালে নাস্তার টেবিলে বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। পাতা উল্টোতে উল্টোতে হঠাৎ একটা সাদাকালো পাসপোর্ট সাইজের ছবিতে চোখ আটকে গেল। ছবির পাশে লেখা,
“মৃত্যুর সাতমাস পর ‘জাফর শিকদার’ নামের এক বৃদ্ধকে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।”
পুরো খবর পড়ে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। জাফর আংকেল যিনি নিজে আমার পাশে বসে তাঁর জীবনের গল্প বলেছিলেন তিনি দীর্ঘদিন থেকে মৃত? তাঁর আত্নাই কি তবে তাঁর দুঃখের কথা প্রকাশ করে গিয়েছিল আমার কাছে? এইজন্যেই কি তিনি লাশ সংরক্ষণ ঘরের দিকে গিয়েছিলেন? কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পেরেছি, তিনি আমাকে কখনো বাবা-মাকে ছেড়ে যেতে বারণ করেছেন, বুঝাতে চেয়েছেন,
“সন্তানদের ছাড়া বাবা-মায়েরা জাফর আংকেলের মতনই খুব একা, খুব অসহায়।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত