নম্রতা বেশ মিষ্টি মেয়ে। কথা বলার ঢং আরও সুন্দর। নম্রতার সঙ্গে যেদিন আবিরের কথা হয় সেদিন ছিল জ্যোৎস্না রাত। জ্যোৎস্নাজলে নম্রতার রূপে মুগ্ধ আবিরের বুকে এখনো নম্রতা-স্মৃতির ছোপ ছোপ দাগ। রোদ–বৃষ্টি–জলে ঘুরে ঘুরে কেটেছে তাদের সময়। টিএসসির নরম ঘাসে মধুর আড্ডার কথা মনে হলে এখনো আবিরের চোখেমুখে ফুটে ওঠে অন্য রকম ভালো লাগা।
আবির বেশ ভালো ছাত্র। তার কাছে পড়াশোনার বাইরে আর কিছু ছিল না। অনেক ভালো কিছু করতে হবে এটাই ছিল নেশা। প্রথম দেখায়ই নম্রতাকে আবিরের খুব ভালো লেগেছিল। ফার্স্ট সাইট লাভ হলে যা হয়। তবে আবিরের সব সময় মনে হতো, ভালোবাসা–প্রেম তার জন্য নয়। আবির সব সময় ভাবত তাকে অনেক কিছু করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণই ছিল তার ব্রত। নম্রতাকে খুব ভালো লাগলেও আবির সচেতন মনে তা লুকিয়ে রেখেছিল। নম্রতা আবিরের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারত। সে ভেবেছিল আবির হয়তো একদিন তার জীবনে চলে আসবে। তবে ভয়ও ছিল নম্রতার মধ্যে। দুজনের ধর্মীয় পরিচয় আলাদা হওয়ার কারণে নম্রতা জানত, এ সম্পর্কের হয়তো কোনো গন্তব্য নেই।
নম্রতা ও আবিরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দিনগুলো বেশ চলছিল। যদিও কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু পরস্পরের প্রতি তাদের অগাধ মায়া তারা বুঝতে পারত। নম্রতা ও আবির ধর্ম–গোত্রবর্ণের অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে প্রায়ই কথা বলত। তারা দুজনেই বিশ্বাস করত ধর্মীয় পরিচয় দুজন মানুষের ভালোবাসার জন্য বাধা হতে পারে না। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হতো সমাজ ও রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তনে মানুষের ভূমিকা। সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নিয়ে তাদের যুক্তিতর্ক চলত। মনের দিক থেকে তাদের মিল ছিল অসাধারণ। সবকিছুতেই তারা প্রায় একই রকম উপসংহারে পৌঁছতে পারত। নম্রতার তাই আবিরের ব্যাপারে সব সময় একটা পজিটিভ ধারণা ছিল। তার সত্তাজুড়ে থাকত আবির। এ রকম করে তাদের কেটে গেল পুরো অনার্স লাইফ। আবির অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছে। গবেষণা তার প্রাণ। তাই বাইরে যাওয়ার জন্য আবির চেষ্টা করছে।
এদিকে মাস্টার্স ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আবির গবেষণা আর জিআরই পড়ে সারা দিন। হঠাৎ একদিন নম্রতার ফোন, আবির তুমি কই?, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। বিকেলেই নম্রতার সঙ্গে আবির দেখা করতে যায় হল গেটে। নম্রতার মন খুব খারাপ। নম্রতা অ্যানথ্রোপলজিতে মাস্টার্স করার জন্য আমেরিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিল। আজই সেই কনফর্মেশন পেয়েছে।
আবির তো অনেক খুশি নম্রতার খবর শুনে। আবির যতই নম্রতাকে বলছে আমেরিকার গবেষণার মান অনেক ভালো, ওখানে গেলে সে অনেক ভালো করবে, কিন্তু নম্রতার মন পড়ে আছে আবিরের কাছে। নম্রতা খুব করে চাইছে আবির তাকে কিছু বলুক। মুখবন্দী ভালোবাসার ভার যে নম্রতা আর বইতে পারছে না। আবির আজ চিৎকার করে বলুক, নম্রতাই তার জীবন। নম্রতা অনেক ভাবেই আবিরকে বলতে চাইল, বোঝাতে চাইল। আবির যেন বুঝেও না বোঝার ভান করে নম্রতাকে জোর করতে থাকল আমেরিকায় চলে যেতে।
নম্রতা চলে যাওয়ার পর আবিরের সঙ্গে খুব বেশি যোগাযোগ হয় না। মাঝেমধ্যে তাদের মধ্যে ই–মেইলে কথা হয়। নম্রতার জন্য নতুন পরিবেশ, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়। আবিরও ব্যস্ত হয়ে যায় পড়াশোনায়। সব মিলে যোগাযোগে ভাটা পড়তে থাকে। একসময় নম্রতা আবিরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হারিয়ে যায় সময়ের ব্যস্ততায়। আবির মনে মনে খুব কষ্ট পাচ্ছিল। নম্রতার কাছ থেকে কোনো ধরনের সাড়া না পেয়ে আবিরের ধারণা পোক্ত হতে থাকে নম্রতা তাকে ভুলে গেছে।
এদিকে আবির বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে। আবিরের বাসা থেকে অনেক চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য। কিন্তু আবিরের সাফ জবাব পিএইচডি শেষ না করে আবির বিয়ে করবে না। তাই পরিবারও মেনে নিয়েছে। আবিরের ইচ্ছে ছিল স্ট্যানফোর্ডে পিএইচডি করবে। তার স্বপ্ন একদিন সত্যি হলো। আবির আমেরিকার স্ট্যানফোর্ডে এসে ভালো গবেষণা করছে। কিন্তু তার মন খুঁজতে থাকে নম্রতাকে। নম্রতা কেন না বলে হারিয়ে গেল এটা আবির মানতে পারছে না।
আবিরের এক স্কুলবন্ধু পিটসবার্গে থাকে। মাঝে অনেক দিন ওদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। ফেসবুকে একদিন দেখা হয় দুজনের। বন্ধু লিখনের চাপাচাপিতে আবির আসে পিটসবার্গে বেড়াতে। দুজনের বহুকাল পরে দেখা। খুব খুনসুটিতে ওরা মজা করছিল। দুই বন্ধু মিলে কথার ছলে অনেক কথা বলে। লিখন এক মেয়েকে পছন্দ করত। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। লিখন এরপর থেকে আর কাউকে বিশ্বাস করে না বলছিল। আবির খুব চাপা স্বভাবের হলেও লিখনকে নম্রতার কথা বলে। লিখনের নামটি পরিচিত মনে হয়। সে ফোন করে তার বন্ধু আসিফকে। নম্রতা নামে তাদের তো এক কমন ফ্রেন্ড ছিল, জিজ্ঞেস করে আসিফকে। আসিফ নম্রতাকে খুব ভালো করে চিনতে পারে। লিখন আসিফকে তার বাসায় আসতে বলে।
নম্রতার সঙ্গে আবার দেখা হবে ভেবে আবিরের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। আবির অনেক কিছু ভাবতে থাকে। নম্রতার সঙ্গে আবার দেখা হলে তার সঙ্গে অনেক অভিমান করবে। সহজে কথা বলবে না। আবার মনের ভেতর ভালোবাসার টান অনুভব করতে থাকে। আবিরের আর তর সইছে না। কখন আসিফ আসবে। নম্রতার কথা শুনবে। নম্রতার সঙ্গে দেখা হলে এবার আর মিস করবে না এমন ভাবতে থাকে। সে এবার মনের ভেতর লুকিয়ে থাকা সবকিছু বলেই দেবে।
রাতে আসিফ লিখনের বাসায় আসার পর বেশ গল্প হচ্ছে। লিখন রান্না করছে। এদিকে আবিরের আর ভালো লাগছে না। ডিনারের টেবিলে বসে লিখন আসিফকে বলল, নম্রতা আবিরের খুব ভালো বন্ধু। নম্রতা কোথায় আছে দোস্ত বল তো? নম্রতাকে বোধ হয় মাস্টার্সের প্রথম দিকে আমাদের সঙ্গে দেখেছিলাম। তারপর বোধ হয় ভার্সিটি পরিবর্তন করেছিল। তুই নম্রতার ফোন নম্বর বা ঠিকানা থাকলে বল, চল নম্রতার সঙ্গে আমরা কাল সকালে আড্ডা দিই।
আসিফ চুপ হয়ে যায়। কিছু বলে না। আবির ভাবে হয়তো নম্রতার বিয়ে হয়ে গেছে। এখন হয়তো নম্রতার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। লিখন আসিফকে বলে, কী ব্যাপার বল? কী হলো? আসিফ লিখনের দিকে তাকিয়ে থাকে। লিখনকে আসিফ বলে, তুই বোধ হয় গত সাত দিনের নিউজ পেপার পড়িসনি। পিটসবার্গ থেকে ওয়াশিংটন যাওয়ার পথে…আসিফ থেমে যায়।
লিখন বলে কী তারপর? আসিফ বলল, আবির এমন সময়ে এল, যখন নম্রতার চলে যাওয়ার সময় হলো। নম্রতা আজই ফ্লাইট ধরবে দেশের উদ্দেশে। কিন্তু তার নিথর দেহ পড়ে আছে হিমঘরে। চার দিন আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে নম্রতা।
আবির শুধু শুনছিল। কোনো শব্দই আর ওর মুখ থেকে বের হলো না। ছলছল করছিল আবিরের চোখ। নীরবে গড়িয়ে পড়া চোখের জলে ভেসে গেল ওর লালিত স্বপ্ন।