ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত প্রায় তিনটা ছুঁই ছুঁই । রেল ষ্টেশনের বড় ঘড়িটা টিক টিক করছে । ট্রেন এখনই আসার কথা । কান পেতে রইলাম । কিন্তু ট্রেন আসার কোন নামগন্ধ-ই নেই । একটুপর ষ্টেশনের গার্ড বলল, যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য ট্রেন আসতে আধঘণ্টা দেরি হবে ।
তারমানে আরও আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে । চারপাশে তাকালাম । যাত্রী তেমন একটা বেশি নেই । আমারও অবশ্য এত রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না । কিন্তু অফিসের জরুরী কাজ পড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই রাতের ট্রেনেই যেতে হচ্ছে । ষ্টেশনের দোকান থেকে সিগারেট কিনে বেঞ্চে বসে উদাসীন দৃষ্টিতে রেল লাইনের দিকে তাকিয়ে সিগারেটে টান দিলাম । হঠাৎ কানে আসলো ট্রেনের হুইশেলের শব্দ আর চাকার খটখট শব্দ । একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম ট্রেনটা ষ্টেশনের আগেই এসে থেমেছে । দৌঁড়ে ট্রেনের কাছে গেলাম । একটা লোক ট্রেনে উঠতে ছিল।
তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,”ভাই ট্রেন নাকি আধঘণ্টা পরে আসবে ? এত তাড়াতাড়ি চলে আসলো যে ?” আমি জানি না , বিরক্তি নিয়ে লোকটা উত্তর দিল । আবার জিজ্ঞাসা করলাম, ষ্টেশনের অন্য কোন যাত্রী এই ট্রেনে উঠছে না কেন ? এটা চট্টগ্রাম যাবে তো ?” ” হ্যা এটা চট্টগ্রামই যাবে । যার যে ট্রেনে উঠার সে তো সে ট্রেনেই যাবে”, বলে লোকটা ট্রেনে উঠে গেল । লোকটার আচরণে অবাক হলাম । তবে আমার অতশত ভেবে লাভ নেই । আমি চট্টগ্রাম যেতে পারলেই হল । ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়লাম ।
বগিটাতে যাত্রী ছিল চার পাঁচ জন । বাকি সব সিট গুলোই ফাঁকা । জানালার পাশে একটা সিটে বসে পড়লাম । আমার সামনের সিটে দুইজন লোক ঘুমে ঢলুঢুলু করছে । আবছা অন্ধকার পুরো বগি জুড়ে । ট্রেন আবার হুইশেল দিয়ে চলতে শুরু করলো । ষ্টেশনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ষ্টেশনটা কেমন যেন পুরানো লাগছে । একটু অবাক হলাম কিছুক্ষণ আগে দেখা ষ্টেশনটার এত অদ্ভুত পরিবর্তন কি করে হল । নাকি আমিই অন্ধকারে ভুলভাল দেখছি । মাথা থেকে অহেতুক চিন্তা দূর করে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম । একটু তন্দ্রাভাব আসতেই কারো ডাকে ঘুম ভেঙ্গে গেল । চোখ খুলে দেখি সামনের সিটে বসা একটা লোক আমাকে জিজ্ঞাসা করছে,
– কি ভাই ঘুমিয়ে পড়েছেন নাকি ? আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, হ্যা । লোকটা অস্পষ্ট স্বরে বলল,
– ঘুমের রাজ্যে এসে ঘুমানো যায় না । আমি বুঝতে না পেরে বললাম,” কী বললেন ভাই বুঝতে পারি নি ? লোকটা কথা ঘুরিয়ে বলল,”আপনি চট্টগ্রাম যাবেন ?”
– হ্যা
– রাতের ট্রেনে কেন? দিনেই তো যেতে পারতেন ।
– আসলে অফিসের জরুরী কাজ পড়ে গেছে ।
– আমারও সেদিন অফিসের কাজ ছিল । বউ সকালের নাস্তাও দিয়েছিল । কিন্তু খেতেই পারলাম না ।
– কেন ?
– মৃত মানুষ খেতে পারে নাকি !!
– মানে !! অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ।
লোকটা আমার কথার উত্তর না দিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করলো । ঢাকনাটা খুলে আমার দিকে বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল,”খাবেন ?” বক্সটার দিকে তাকাতেই আমার বমি চলে আসলো । বক্সের খাবারগুলো পঁচে গলে গেছে । তাতে পোকা কিলবিল করছে । আমি ধাক্কা দিয়ে খাবার গুলো ফেলে দিলাম । রাগে চেচিঁয়ে বললাম,”পাগল নাকি আপনি !” লোকটা হেসে বলল,”এই রাজ্যে রাগ বলে কিছু নেই ।”
লোকটাকে পাগল ভেবে আমি অন্য একটা সিটে গিয়ে বসলাম ।এখানেও আমার সামনের সিটে আরেকজন লোক বসা ।চোখ বন্ধ করে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম । হঠাৎ কিছুর শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল । চোখ খুলে তাকিয়ে দেখি আমার সামনে বসা লোকটার মাথা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে । আমি দ্রুত চেঁচিয়ে বললাম,”আরে ভাই আপনার মাথা থেকে তো রক্ত ঝরছে ।” লোকটা হেসে বলল,” কই রক্ত ! এতদিনে তো রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার কথা । এখনও ঝরছে নাকি !!”
পাগল নাকি এই বগির সবাই নাকি ঠিকমত ঘুম হচ্ছে না বলে আমিই উল্টাপাল্টা দেখছি আর শুনছি । চোখ কচলে বগির দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম । হঠাৎ শুনতে পেলাম বগির ভেতর থেকে আর্তনাদ ভেসে আসছে । ট্রেনটাও তখন থেমে গেল । একটা লোক চেঁচিয়ে বলল,” ট্রেনে ডাকাত উঠেছে । যে যেদিকে পারো পালাও ।”
আমি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড় দিলাম । রেললাইনের উপর দিয়ে দশমিনিট দৌঁড়ানোর পর একটা রেল ষ্টেশনে গিয়ে পৌঁছালাম । গার্ড আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো,” কী ব্যাপার দৌঁড়াচ্ছেন কেন ?” আমি হাঁফাতে হাঁফাতে কোনরকমে বললাম.”ডাকাত !! ডাকাত ! গার্ড আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,”আসুন আমার সাথে ।” তিনি তার রুমে নিয়ে আমাকে পানি খেতে দিলেন । তারপর বললেন,”এখন ঠান্ডা মাথায় বলুন কি হয়েছে ?”
আমি ট্রেনে ঘটা সব ঘটনা বিস্তারি বললাম তাকে । গার্ড সব শুনে বলল,”আমি এই ষ্টেশন বার বছর ধরে চাকরি করি । আট বছর আগে এই রুটে একটা ট্রেন দূর্ঘটনা হয় । চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে ঐ ট্রেনে একদল ডাকাত উঠে । তারা ট্রেনচালককে হুমকি দেয় । তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে চালকের গলায় ছুরি চালিয়ে দেয় ডাকাতরা । ট্রেন তখন লাইন বিচ্যুত হয়ে খালে পড়ে যায় । সব যাত্রী মারা যায় । ঐ ট্রেনে সেদিন আমিও ছিলাম । ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলাম সেদিন । তারপর থেকে প্রতি বছর ঐ দূর্ঘটনার তারিখে কেউ না কেউ ছুটে এখানে ডাকাত ডাকাত বলে ছুটে আসে । আজ যেমন আপনি আসলেন ।
– তার মানে আজকের এই তারিখেই আট বছর আগে সেই ট্রেন দূর্ঘটনা হয়েছিল?
– হ্যা । প্রতিবছর এই তারিখেই ঐ ট্রেনটা ফিরে আসে । আর কোন না কোন যাত্রীকে দেখা দেয় এবং তাকে ট্রেনে উঠায় ।আপনার যে ট্রেনে উঠার কথা ছিল সেটা কিছুক্ষণপর এই ষ্টেশনে আসবে ।
আমি কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম । আমার কাছে সবকিছু দুঃস্বপ্নের মত মনে হল । বিশ মিনিট পর ট্রেন আসলো । গার্ডের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ট্রেনে উঠে বসলাম । চোখে তখনও ভাসছে অদ্ভুত সেই ট্রেনে কাটানো সময়গুলো । হয়তো এক বছর পর এই তারিখেই অন্য কেউ পৈশাচিক আর ভয়ংকর সেই ট্রেনের কবলে পড়বে এটা ভাবতেই বুক কেঁপে উঠলো আমার ।