গল্পের শেষটা

গল্পের শেষটা

–কনসিভ করেছেন যে কতদিন হলো ? হতভম্ব হয়ে ডাক্তার রুমার দিকে তাকালাম।ডাক্তার রুমা ছিলেন আমাদের পরিচিত ডাক্তার। পাশে রুপম বসে আছে । অবশ্য ও কেবল বসে বসে ফোন টিপছে । আমি একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে ডাক্তারকে বললাম,

–মাস দু’য়েক হবে ।

–তাহলে এখন থেকে আপনাকে অনেক সচেতন থাকতে হবে।বাচ্চার দিকে খেয়াল..

–আমি বাচ্চাটা এবরশন করাতে চাই।
কথাটা বলার সময় গলাটা আটকে আসছিলো।চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছিলো ।

–কিন্তু এভাবে একটা বাচ্চার অস্তিত্ব শেষ করে ফেলবেন ? আরেকবার ভেবে দেখুন । রুপম সাহেব আপনার স্ত্রীকে বোঝান । কিছু মানুষ হাজার চেষ্টা করেও মা হতে পারেনা।আর উনি…

— এবরশন কবে করাতে পারবেন সেটা বলেন ? আর আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি। সুতরাং আমাদের সময়টা বলুন ।

–ঠিক আছে । আজ আমার হাতে একটু কাজ আছে।আপনারা বরং কাল আসুন। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে দু’জনে হাঁটছি। রুপম আগে আগে হাঁটছিলো আর আমি ওর পিছনে । ভাবতে পারছিনা, আমি আমার বাচ্চাকে খুন করতে এখানে এসেছি ! আমি কি আসলেই মা হওয়ার যোগ্য ! এতটুকু একটা অস্তিত্ব পৃথিবীর মুখ দেখার আগেই কি পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে ? আচ্ছা, আমি চাইলে কি আমার সন্তানকে পৃথিবীর মুখ দেখাতে পারি না ? আমি যে ওর মা !

–কি হলো ? আসো । রুপম পিছনে ফিরে ডাক দিলো আমায়। বাসায় গিয়ে ফ্রেস হয়ে রুপমের পাশে বসলাম।

–রুপম, বাচ্চাটা এবরশন না করালে হয় না ? অশ্রুভেজা দৃষ্টি নিয়ে রুপমকে প্রশ্নটা করলাম।

–দেখো , আমার এখন বাচ্চা কাচ্চা চাইনা । তাছাড়া বিয়ে হতে না হতে কিসের বাচ্চা ? লাইফটা এনজয় কর নীলা।ব্যাকডেটেড মহিলাদের মত বাচ্চা বাচ্চা করো কেন ? একবার নিজেকে দেখেছো ? বিয়ের মাত্র কয়েকমাস হলো।আর এখনি দেখতে তোমাকে বুড়ির মত লাগছে ! পেটের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে তোমার।বাচ্চা হলে তো তোমাকে দেখতে ৫০ বছরের বুড়ির মত লাগবে।

–তুমি খুব নিষ্ঠুর !

–নীলা, ফালতু কথা বলবা না।তুমি যদি বাচ্চাটা এবরশন না করাও তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।

–কি করবে তুমি ? বাচ্চাটা একা তোমার না । তোমার একার সিদ্ধান্ত কেন আমি মেনে নিবো ? তাছাড়া এই নিষ্পাপ শিশুটার কি দোষ ? কেন ওকে মারতে হবে ?

–তুমি যদি বাচ্চাটা এবরশন না করাও তাহলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো।

–কি ! তোমার এই কথাটা বলতে একটুও মুখে আটকালো না ? তোমার চিন্তাভাবনা এতটা নিচু ধরনের ! ডিভোর্স দিবা আমাকে ! কিন্তু এই বাচ্চাটাতো তোমারও। কেন এমন করছো রুপম ?

–তামাশা করবানা । কাল যদি এবরশন না করাও তাহলে কাল ই আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো।এটাই আমার শেষ কথা।

আমি আর কিছুই বললাম না রুপমকে।চুপচাপ শুয়ে পড়লাম। কি করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।কিন্তু আমি মা হয়ে পারবোনা আমার বাচ্চাটাকে খুন করতে। পরেরদিন যথারীতি রুপম এসেছে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যাই নি।ওর সাথে কথা বাড়াবাড়ি করলাম।পরবর্তীতে ও আমাকে একটা চড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয় । চলে আসলাম বাবার বাড়িতে। ক্রমশ মাসগুলো অতিবাহিত হতে লাগলো আর আমার মাঝে বেড়ে উঠতে লাগলো একটা নিষ্পাপ অস্তিত্ব।

ইদানিং আমি ওর নড়াচড়া বুঝতে পারি।খুব কষ্ট হয় ও যখন নড়াচড়া করে।কিন্তু খুব স্বস্তি পাই এটা ভেবে যে আমার বাচ্চাটা আমার মাঝে সুস্থ আছে।এই কয়েকমাসে রুপম আমাকে একটা ফোনও দেয় নি।বরং আমি কয়েকবার ফোন দিয়েছি রুপমকে।আমার অনুভূতির কথাগুলো ওকে বলতে খুব ইচ্ছে করছিলো।কিন্তু পারিনি।পরবর্তীতে ও আমার ফোন নম্বর ব্লকলিস্টে ফেলে দেয়।

গত পরশু আমার বাচ্চাটা পৃথিবীতে এসেছে।আমার একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়েছে । বাবাকে বলেছি রুপমকে খবরটা দেওয়ার জন্য।যাই হোক,ওর সন্তান পৃথিবীতে এসেছে এটা শুনলে নিশ্চয় দৌড়ে আসবে ওর মেয়েকে দেখার জন্য । সপ্তাহখানেক হলো আমার মেয়েটার বয়স।কিন্তু রুপম মেয়েটাকে দেখতে আসেনি।ও মেয়েকে দেখতে না এসে আমার জন্য একটা পার্সেল পাঠিয়েছে । আমি পার্সেলটা দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলাম।ও হয়তো অনুতপ্ত তাই মেয়েকে দেখতে আসতে লজ্জা পাচ্ছে।ও পার্সেলে হয়তো মেয়ের জন্য কিছু পাঠিয়েছে, এটা ভেবে আমি পার্সেলটা খুলতে লাগলাম।

পার্সেলটা খুলে আমি হতবাক হয়ে গেলাম ! এই সময়টার জন্য প্রস্তুতি সত্যি ছিল না।ভাবতেই পারিনি রুপম আমায় ডিভোর্স দিয়ে দিবে ! কিন্তু ও সত্যি আমার জন্য ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে । তার সাথে একটা চুক্তিপত্রও ছিলো।আমার মেয়ের কোনো দায়িত্ব ও নিতে পারবেনা। আমার তো কোনো অপরাধ নেই তাহলে কেন আমায় এতবড় শাস্তি পেতে হলো ! হায়রে জীবন ! এইটুকু একটা বাচ্চাকে নিয়ে এত কথা ! সেদিনই প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলাম আল্লাহর ভরসায় মেয়েকে নিয়ে পথ চলার।মেয়েকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ।

তিতলির বয়স ৩বছর । শুনেছি রুপম আবার বিয়ে করেছে। বউটা নাকি অনেক সুন্দর ! আমার থেকেও বেশি সুন্দর ! কষ্ট পাই নি তবে আফসোস হয়েছে রুপমের জন্য ! তিতলির মত একটা মেয়েকে হারিয়ে ফেললো ও।আমার কেবল মনে হত ওর মত হতভাগা আর কেউ নেই এই দুনিয়াতে ! রুপমের ব্যাপারে আর তেমন ইন্টারেস্ট দেখায় নি।কি দরকার ইন্টারেস্ট দেখানোর ? সে তো এখন অন্য কারোর বর। যে আমার নয় তাকে নিয়ে বড়াই করারও কি দরকার ? আমার তিতলি আমার সব। আমার তিতলি আজ অনেক বড় হয়ে গেছে ।দেখতে অবিকল ওর বাবার মত হয়েছে মেয়েটা । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হাসছি নিজেকে দেখে ! বয়সটা বুঝি ফুরিয়ে এলো ! চুলে পাক ধরেছে।মাথাভর্তি সাদা চুল, মাঝে হাতেগুণা দু’একটা কালো চুল।গায়ের চামড়াও প্রায় কুঁচকে গেছে ! তিতলি এসে বললো,

–মা, এখনো শাড়িটা পরো নি ? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কি ভাবছো ? তৈরি হতে হবে তো মা । তিতলির সাথে ওর হসপিটালে যাবো । ইদানিং শরীরটাও খুব একটা ভালো না।

আজ খুব বড় মুখ করে বলতে ইচ্ছে করছে রুপমকে যে আমার মেয়েটা ডাক্তার হয়েছে।কিন্তু জানিনা, রুপম কেমন আছে বা কোথায় আছে ? আর নতুন বউ কি এখনো নতুন ই আছে ? নাকি আমার মত বৃদ্ধ হয়ে গেছে ! আচ্ছা ও কি ওর নতুন বউকে প্রথম বাচ্চা এবরশন করতে বলেছে ? আসলে আমি বোকা ! কেবল অহেতুক প্রশ্ন ভাবি ! তিতলির সাথে হসপিটালে গেলাম।চেম্বারে যেতেই অবাক হলাম ডাক্তার রুমাকে দেখে । তিতলি যখন আমার গর্ভে আসলো তারপর থেকেই আমি ডাক্তার রুমার ট্রিটমেন্টে ছিলাম। উনার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই বললো,

–নীলা ?

–জ্বি, নীলা। ও আমার মেয়ে তিতলি ।

–তোমার মেয়ে ! বেশ অবাক হয়ে ডাক্তার রুমা আমাকে বললো।

–জ্বি , আমার মেয়ে।

তারপর তিতলির সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো উনি।তিতলি চেম্বার থেকে কোনো একটা জরুরী কাজে বেরিয়ে গেলো।তখন ডাক্তার রুমা আমার পাশে এসে বললো,

–রুপমের কথা কিছু জানো ?

–না।কেন ?

–নতুন বউকে নিয়ে বিয়ের বছর দু’য়েক পরে আমার চেম্বারে আসে।

–কেন ? এবরশনের জন্য ?

–না । বাচ্চা কেন কনসিভ হয়না সেটা জানার জন্য ।

–মানে ?

–রুপমের কোনো সন্তান হয় নি।

কিছুই বললাম না ডাক্তার রুমাকে।বেশ অবাক হয়ে দেখছি তাকে।আর উনি আমাকে দেখছে ! এটাই কি নিয়তি ! এটাই কি রুপমের শাস্তি ? আজও সেদিনের মত চুপচাপ চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসলাম।কিন্তু আজ পাশে রুপম নামের কোনো ব্যক্তি নেই।আজ আমার হাত ধরে হাঁটছে আমার তিতলি। সেদিনও আমার সাথে (গর্ভে)আমার তিতলি ছিল, আজও আমার সাথে আমার তিতলি হাঁটছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত