কলেজ বান্ধবী’র ফেইসবুকে ছবি দেখছিলাম। অনেক অনেক ছবি, প্রায়ই স্বামী স্ত্রী’র জড়াজড়ি টাইপ । একবছর হয় বিয়ে হলো তাদের । প্রেমের বিয়ে।
আমারও প্রেমের, তবে বছর হতে এখনো তিন মাস বাকি। ও আমার বিয়েতে আসেনি, তাই একটু অভিমানও আছে তার উপর। অথচ তাদের দু’জনের সাথেই আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো। সিয়ামের সাথে অবশ্য হাই, হ্যালো টাইপ কথা হতো।
ওর বিয়ের পর প্রায়ই ওকে অনলাইনে দেখি। কিন্তু কথা হয়না। একবার নক করেছিলাম। ম্যাসেঞ্জারের কথোপকথনটা ছিল এমন–
-হাই রাত্রি..
রাত্রি আমার বান্ধবী
-হাই
-কেমন আছিস?
-খুব ভালো।
-ব্যস্ত?
-একটু…
মনে হলো ও আমাকে এভয়েট করছে , আবারও ওর প্রতি রাগ অভিমান দু’টোই জমলো। একবার জিজ্ঞেসও করলোনা আমি কেমন আছি। তাই নিজে থেকে আর কখনো মেসেজ করিনি।
তাও ছয় সাত মাস আগের কথা। অথচ ওর বিয়ের আগে প্রায়ই মেসেজ দেয়া দেয়ি হতো আমাদের। ছবিগুলো খুব খুঁটিয়ে দেখছিলাম। বারবার দেখছিলাম। জড়াজড়ি করা তবে কেমন যেন প্রাণহীন মনে হলো রাত্রিকে ।
আবার দেখলাম সব। ওর ঠোঁটে হাসির রেখা কান পর্যন্ত যায়নি, যেমনটি আগে হাসতো। ওর চোখগুলো কেমন চকচক করছে, যেন টপ করে এক বিন্দু পানি পড়বে টোকা দিলেই।
ঐ চকচক খুশির নয় কিছুতেই, ও তে হয়তো এক ঝর্ণা কান্না লুকিয়ে আছে। আর কিছু ছবিতে জোর করে হাসার চেষ্টা প্রবল, তবে তাও কান্নার মতো। আর ওর হাত কোথাও বর সিয়ামকে জড়িয়ে ধরে নেই। সিয়ামই যেন জোর করে ধরে রেখেছে। আর প্রাণ খুলে হাসছে সে, কেমন যেন অহংকারী জয়ী হাসি।
এতকিছু ভাবতে পারছি, কারণ রাত্রিকে আমি খুব ভালো ভাবে জানি। হাসি খুশি মেয়ে, প্রানোজ্জ্বল সে।
সাথে সাথে ওকে মেসেজ দিলাম,
-ভালো আছিস?
অনেক্ষণ পর জবাব লিখল ,
-হুম।
-মনে তো হয়না..
-মানে! দু:খিত বন্ধু, এখন কোনো মেসেজ দিসনা। আমি যখন কিছু লিখব, তখনই উত্তর দিস।
মনের মধ্যে অজানা আশংকা যেন সত্যি হতে চলল। কিন্তু আমি বেশি ভাবতে চাইনা। আমার প্রেগন্যান্সির চার মাস চলছে। এতদিন খুব বাজে অবস্থা ছিল, বমি, খেতে না পারা, ক্লান্তি। তবে এখন ভালো আছি। এরপরও ডাক্তার কোনো টেনশন নিতে মানা করেছেন।
দু’দিন হয়ে গেলো ওর পাত্তা নাই। অনলাইনেই আছে সে। তবে নিজে থেকে প্রবল ইচ্ছে সত্ত্বেও মেসেজ বা কল দিইনা। নিশ্চয়ই কোনো যুক্তিসংগত কারণে বারণ করেছে সে। তারপর ৩য় দিন মেসেজ নয় ওর কল আসে।
ফোনে কান্নায় ভেঙে পড়ে রাত্রি। ওর এক বছর জীবনের গল্প বলে সে।
বাসর রাত। রাত্রি খুশি খুশি প্রেমিক বর সিয়ামের অপেক্ষায়। সিয়াম আসে। রাত্রি কিছু দুষ্টুমি করবে চিন্তা করে।
কিন্তু সিয়াম এসে বলে,
-এখনো ঘুমাওনি!
-বারে, তোমার জন্য ওয়েট করবনা?
-ঢং করতে হবেনা। ওয়েট কিসের?
-মানে! আজকের দিনে ওয়েট করা ঢং!
-হ্যাঁ, ঢং। নতুন কি পাবো তোমার থেকে? সব তো দেখা জানা…
-এসব কি বলছো!
-সত্যি কথা।
-তাহলে বিয়ে করবেনা বললেই হতো।
-তোমার আমার সম্পর্ক সবাই জানে, বিয়ে না করে উপায় আছে!
-তো এসব কেন বলছো?
-কারণ, নষ্ট মেয়ের সাথে প্রেম করা যায়। কিন্তু ছেলেদের বিয়ের স্বপ্ন ভার্জিন মেয়ে।
-আমার ভার্জিন কে নষ্ট করলো? বল।
-আমি। তো?
-তো তুমি যাকে নষ্ট করছো তাকে বউ হিসেবে মানতে রাজি নও কেনো। তুমিও তো ভার্জিন নও।
-এতো কথার দরকার নেই। ছেলেদের কোনো দাগ পড়েনা। আর তুমি আমার সাথে বিয়ের আগে শুয়েছো, আর কারো সাথেও যে পরবর্তীতে শুবেনা, তার কি গ্যারান্টি?
-ছি: সিয়াম, তুমিই আমাকে বাধ্য করেছ তখন। ফুসলিয়ে, ভালবেসে, বিয়ের কথা বলে।
-সবাই তাই করে, আমিও করেছি।
-তুমি একটা শুকর, শয়তান…
ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়েছিলো রাত্রি’র গালে। এরপর থেকে সবসময় । তারপর শাস্তি দেয়ার জন্যই হয়তো সিয়াম বাসর রাত বানায় জোর করে।
সেদিন থেকে এখনো অনেক রকম অত্যাচার করে আসছে সিয়াম। কোনো বন্ধু বান্ধবী’র সাথে মিশতে দেয়না, তাদের কোনো দাওয়াতে যেতে দেয়না। কাজ করতে দিচ্ছেনা, তাতে নাকি কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হবে।
মোট কথা ঘরবন্ধি, জবানবন্ধি। ওর মোবাইলও চেক করে প্রায়ই।
-তুই ঐ জাহান্নামে আছিস কেনো? আংকেল আন্টিকে বলিস নি?
-কোন মুখে বলবো?
-এখন তো তোকে আমারই থাপড়াইতে ইচ্ছে করছে.. কোন মুখে বলবি মানে কি!
-বিয়েটা আমার পছন্দে হয়েছে রুমা, তুই তো জানিস। এখন আমি যদি ফেরত যাই, তবে সমাজ পরিবার ..কে কি বলবে , আন্দাজ করতে পারিস!
-তাহলে তুই মর! রাগ উঠে ওর কথা শুনে।
-তাও ট্রাই করেছিলাম, জানিস?
ক’টা ঘুমের ওষুধ খেয়ে তিন দিন, তিন রাত ঘুমিয়ে কাটিয়েছি, মরি নাই….হা হা হা…
টেলিফোনে হাসে ও। হাসিটা কান্নার মতো শুনায়, গভীর কষ্টের কান্না।
-মজা লাগছে কেনো ? মরিস নাই , তাই!
-নারে, সিয়াম বলেছে, ঘুমের ট্যাবলেটে কাজ হয়নি তো, এবার কোন পদ্ধতি বের করতে না পারলে ওর থেকে হেল্প নিতে।
-ভালো বলেছে, তোর মরাই দরকার।
শোন , সিয়াম কই?
-ও অফিসের কাজে বাইরে গেছে ।
-তুই কাল সকালে তোদের বাসায় চলে যা। এই অসম্মানের জীবন নরকে না থেকে , আংকেলকে সব খুলে বল। ভালো একজন উকিলের সাথে পরামর্শ কর। তুই শিক্ষিতা, কাজের অভাব হবেনা। কাজ করবি।
-দেখি..
-দেখি না, অবশ্যই তাই ই করবি।
-হুম।
-তুই কি জানিস, আমি প্রেগন্যান্ট?
-না তো ! কংরাচুলেসন্স।
-থ্যাংকস ..
-সিয়ামও চাচ্ছে বেবি
কিন্তু আমি এই নরকে বাসিন্দা বাড়াতে চাইনারে। তাই ও না জানে মতো ইন্জ্যাকশন নিয়েছি।
-ভালো করেছিস।
-হুম।
-রাখিরে, আসিফ আসার সময় হলো।
-তুই কি সুখি রুমা? তোরও তো প্রেমের বিয়ে!
-আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।
-হুম। রাখছি, হাল্কা লাগছে তোর সাথে কথা বলে।
-রাখলাম, যা বলেছি, মনে রাখিস।
-হুম।
আসিফ আসে, ওকে কিছু বলিনা আমি। আগে রাত্রিদের সবকিছু সমাধান হোক, তারপর বলবো। রাতে শুতে যাই আমরা। আসিফে’র ঘুম পায় মনে হয়। আমার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়েছে। শোবার আগে আমাকে জোর করে দুধ খাইয়েছে আর ওষুধ ।
হঠাৎ মনে হয়, কত্ত সুখি আমি ! তখনই খুব করে ওর পিঠে জড়িয়ে ধরি ।
-কি , খারাপ লাগছে রুমা?
-না
ও আমার দিকে ফিরে।
-আমার ছোট্ট বেবিটা তাহলে মিস করছে পাপাকে?
-হুম
আসিফ আমরা মা সন্তান দু’জনকে আরো সুখি করে আদর করতে থাকে। আমার তখনই রাত্রি’র জন্য মন খারাপ হয়ে যায়। বেচারী ভালোবাসার মানুষটা থেকে কত কষ্ট পাচ্ছে, আর আমি কত সুখি!
পরদিন ডাক্তার দেখানো, শপিং সব করে ক্লান্ত , ফেইসবুক চেক করা হয়না, পুরা দিন রাত। সকালে আসিফের কাছে একটা ফোন আসে কারো। আমাকে ডাকে,
-রুমা, তোমার বন্ধু রাত্রি সুইসাইড করেছে।
-কি বলছো! হতেই পারেনা, পরশু কথা হলো।
আসিফের কথাটা আমার বিশ্বাস করতে মন চাইনা কিছুতেই।
-তুমি যাবে ওখানে?
-কোথায় যাবো, রাত্রি কোথায়?
-মেডিকেলে, লাশ এখনো দেয়নি, ময়নাদতন্ত হবে । তারপর দিবে।
-না, আমি কখনোই যাবোনা।
আমার বুকটা ছিঁড়ে পড়তে চায়। আমি কিভাবে ওর কাটা ছিঁড়া শরীরটা দেখব! এমন হাস্যময়ী প্রাণ চঞ্চল মেয়েটা মৃত্যু কেনো বেঁচে নিলো!
হঠাৎ মোবাইলে চোখ পড়ে। ম্যাসেঞ্জারে ওকে এখনো অনলাইন দেখি, সবুজ আলো জ্বলে আছে, কিন্তু সে নেই। আমার বুকটা হাহাকার করে উঠে….
২৫.০৪.১৭