সানজিদাকে বললাম, চলো আজ আমরা বিয়ে করে নেই। সানজিদা তো এক পায়ে রাজি হয়ে গলো। ওর এই বিয়ে নিয়ে হাজারো আশা স্বপ্ন। অনেক ভালো ভালো জায়গা থেকে প্রস্তাব আসছে, কিন্তু ও শুধু আমাকেই বিয়ে করবে। এত করে বললাম, আমি বেকার মূর্খ একটা ছেলে আমাকে বিয়ে করতে হবে না। তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করে নেও সুখী হতে পারবা। আর যাকে বিয়ে করবা সে যদি তোমাকে সময় না দিতে পারে তাহলে তো আমি আছি পার্ট টাইম করার জন্য। কে শোনে কার কথা, ও আমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করবেই না। প্রয়োজন হলে চিরকুমারী হয়ে থাকবে।
কিন্তু আমার পক্ষে সানজিদাকে আসলেই বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। কারণ আমার আব্বাজান। আব্বাজান এর ছোট বেলা থেকে একটাই স্বপ্ন তার ছেলে হলে কুলসুম আন্টির মেয়ের সাথে আমাকে বিয়ে দিবে। দুনিয়াতে এত মানুষ থাকতে কুলসুম আন্টির মেয়ের সাথে কেন আমাকে বিয়ে দিবে এটা নিয়ে আমি অনেক চিন্তা ভাবনা করতে থাকি। একসময় এর মূল রহস্য খুঁজে পাই আমার আব্বাজান এর ডায়রিতে। অবশ্য ডায়রিটা খুঁজতে আমার একটু কষ্ট হয়েছে তবুও হাল ছাড়ার পাত্র আমি না। আমি আবার এসব জিনিস খুঁজে পেতে খুব পটু। আর এই কারণে বাসায় আমার একটা নিকনেম আছে “বাইত্তা ইঁন্দুর”।
তো ডায়রিটা খুলে দেখলাম, আমার আব্বাজান ক্লাস ফাইভে পড়া কালীন কুলসুম আন্টির প্রেমের সাগরে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছেন। আব্বাজান কুলসুম আন্টির হাতে হাত রেখে পুকুরপাড় বসে পুকুরের সব মাছকে সাক্ষী রেখে ওয়াদা করেছিলেন, যদি তারা কোনোদিন এক হতে না পারে, তাহলে কুলসুম আন্টির মেয়ে হলে, সেই মেয়ের সাথে আব্বাজান তার ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দিবে। আর সেই ভাগ্যবান ছেলেটি আমি। কিন্তু এতকিছু থাকতে পুকুর এর মাছকে কেন সাক্ষী রাখলেন এটাই বুঝতে পারছি না। তখন তো তাদের মন কচি ছিলো, তাই হয়তো এমন অদ্ভুত সাক্ষী রেখেছিল।
কিন্তু আফসোস আমার আব্বাজানের কপালে বেশিদিন আর সেই প্রেম রইলো না। কুলসুম আন্টিরা বদলী হয়ে অন্য জেলায় চলে যায়। আর এই দিকে আব্বাজান পুকুরপাড় বসে বসে ভাবনার সাগরে চুবনি খেতে থাকে। আব্বাজানের কাপাল ভালো যে, আব্বাজান ছ্যাঁকা খাওয়ার জ্বালা কমানোর জন্য পুকুরে ঢুব দেয়নি। তাহলে আর আজ আমি এখানে থাকতাম না। কাপাল মনে হয় আমারই ভালো। তিন মাস হতে যাচ্ছে, আমার আব্বাজানের প্রাক্তন কুলসুম আন্টি তার জামাই এবং মেয়ে নিয়ে আমাদের পাশের ফ্লাটে উঠছে। আমার আব্বাজানকে ইদানীং একটু অন্যরকম দেখা যাচ্ছে। হয়তো দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর এর প্রেম জেগে উঠেছে মনে।
কিন্তু আমার কী উপায় হবে এটা ভেবে পাচ্ছি না। একদিকে সানজিদা আর অন্যদিকে আমার আব্বাজনের দেওয়া ওয়াদা! এর একটা উপায় বের করতে হবে। আব্বাজান এর রুমে গিয়ে তার পাশে ভদ্র ছেলের মতো বসলাম। মাঝে মাঝে তার পা টিপে দিচ্ছি। আব্বাজান বেশ অবাক হলেন। কারণ যে ছেলেকে হাজার বলেও কোনো কাজ করানো যায় না, সেই ছেলে তার পা টিপে দিচ্ছে! আমি আব্বাজানকে বললাম,
– আব্বাজান একটা কথা বলতাম।
– বল কী বলবি?
– মনে করেন,
আপনি একজনে একটা কথা দিছেন আর আমি একজনকে একটা কথা দিছি। এখন আপনার দেওয়া কথা রাখতে গেলে, আমার দেওয়া কথা রাখা হবে না। আবার আমার দেওয়া কথা রাখতে গেলে, আপনার দেওয়া কথা রাখা হবে না। আপনি তো নামাজ কালাম পড়েন, এখন এটার মাসয়ালা কী? উপায় কী?
– তাহলে দুইটা কথা রাখা যায় এমন কিছু করতে হবে।
– আব্বাজান এটা তো সম্ভব না।
– তার আগে আমাকে বলতো, কিসের কথা?
– আপনি ছোট বেলায় কুলসুম আন্টিকে একটা কথা দিছিলেন। মনে আছে?
– কোন কুলসুম?
– আরে আমাদের পাশের ফ্লাটে।
– তুই জানলি কিভাবে?
– আপনার ডায়রি পড়ে।
– ঐ ডায়রি তো আমি এক জায়াগা লুকিয়ে রাখছিলাম। তুই পেলি কিভাবে?
– আপনি মনে হয় ভুলে যাচ্ছেন, আমার একটা নিকনেম আছে।
– ওহ বাইত্তা ইঁন্দুর।
– আব্বাজান আসল কথায় আসেন।
– হুম তোর মা’কে বলিস না যেন আবার। কুলসুমকে যে কথা দিয়েছি ওটাই বহাল থাকবে।
– কিন্তু,,,
– কিন্তু কী?
– আমি যে একজনকে একটা কথা দিয়েছি।
– কাকে কী কথা দিয়েছিস?
– সানজিদা নামের একটা মেয়েকে।
– কী কথা দিয়েছিস?
– ওকে বিয়ে করবো।
আব্বাজান এই কথা শুনে মনে হলো বুকের মাঝে অনেক ব্যথা অনুভব মনে করলেন। তার চোঁখ লাল হয়ে আছে। আমি ভয়ে টিভির দিকি তাঁকিয়ে পড়লাম।এখান থেকে উঠে যাওয়ার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলছি। হঠাৎ আব্বাজান আমার ঘাড়ে হাত দিলেন। আমি ভয়ে আম্মাজান বলে একটা চিৎকার দিলাম। এই বুঝি আমার জানটা বের হয়ে যাবে। আব্বাজান আমার মুখ চেপে ধরে বললেন,
– চুপ চিল্লানি দিস না। তুই যে কথা দিয়েছিস সানজিদাকে তা ফিরিয়ে নে।
– কিন্তু আব্বাজান,,,
– কোনো কিন্তু নাই।
– একটা কথা বলি আব্বাজান?
– বল।
– আমি কিন্তু সমুদ্রের পাশে বসে সানজিদাকে কথা দিয়েছি।
– তো কী হইছে?
– আপনি কিন্তু পুকুরপাড় বসে কুলসুম আন্টিকে কথা দিছেন।
– হুম তো কী হইছে বল?
– আপনি পুকুরে ঝাপ দিলে পাশে মানুষ ছিল বাঁচানোর। আর আমি সমুদ্রে ঝাপ দিলে আমাকে বাঁচানোর মতো কেউ নাই। অল্প বসয়ে আপনি আপনার একটা সোনার ছেলেকে হারাবেন। আপনার বংসের প্রদীপ নিভে যাবে।
– ছি বাবা ওমন বলতে হয় না।
আমি জানি আমার আব্বাজান আমাকে খুব ভালোবাসে। তাই কোথায় কোন ডোজ দিলে কাজ হবে, সেটা ভালো করে বুঝি। এবার আব্বাজান আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
– তুই যা বলবি তাই হবে।
– ধন্যবাদ আব্বাজান। আব্বাজান, আপনার কিছু লাগবে?
– না কিছু লাগবে না। খবরদার তোর কুলসুম আন্টির কথা যেন তোর মা না জানে, তাহলে তুই কিন্তু অল্প বয়সে এমন একটা কচি মনের বাবা হারাবি। কারণ আমি কিন্তু তোর মা’কে কথা দিয়েছি ছয় তলা দালান এর ছাদে দাঁড়িয়ে।