আমাদের বাসা গুজুরগুজুর আর ফুসুরফাসুরের জন্য প্রসিদ্ধ। বিশেষ করে আম্মা আর ছোট চাচি যদি একসাথে থাকেন। মাঝেমাঝে এদের সাথে এসে যোগ দেন আপুরা। আমার আর হৃদি বেচারির তখন বাসায় থাকা, দায় হয়ে যায়। আজ কয়েকদিন গুজুরগুজুরের মাত্রাটা একটু বেশিই বেড়েছে। আমাকে বা হৃদিকে দেখলেই কোন এক মন্ত্রবলে থেমে যায়। পরে আবার একই অবস্থা। কতো আর সওয়া যায়।
সেদিন রেডি হচ্ছি , ভার্সিটি যাবো। মেজো আপু এসে মানা করলেন। ‘ আদৃতা আজ ভার্সিটিতে যেওনা। বাসায় মেহমান আসবে।’ বাসায় মেহমান আসার সাথে আমার ভার্সিটিতে না যাওয়ার সম্পর্কটা কি, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। ছুটির দিনের নাকি আলাদা মজা থাকে। আজ আমার মনে হচ্ছে ভার্সিটি যাওয়ার চেয়ে আনন্দের কিছু এ গোলার্ধে নেই। রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। মনমরা হয়ে দুই প্যাকেট চিপস খেয়ে ফেললাম। যদি দুঃখ একটু কমে।
বিকেলেই বাসায় মেহমান এলো। বাসায় দেখি নাস্তা বানানোর প্রতিযোগিতা চলছে। আম্মাতো আছেই, সাথে দুই আপু, চাচি সবাই হাত লাগিয়েছে। কাবাব, পুডিং, কাস্টার্ড, ফিস ফিঙ্গার, ভেজিটেবল রোল,তান্দুরি চিকেনের একদম মেলা বসে গেছে। ‘ মিঠাই ‘ থেকে একবার আব্বু মিষ্টি আনেন একবার ছোটচাচা আনেন। ছোটচাচার নাকি মিষ্টির সাইজ পছন্দ হয়নি। কিছুক্ষণ পরে গেস্ট এলো। হৃদি খবর দিলো, তারা নাকি সংখ্যায় মোটে দুইজন। মাত্র দুইজনের জন্য এতো নাস্তার আয়োজন! আমাদের খুশি আর ধরেনা।
ইচ্ছেমত সস মাখিয়ে প্রাণ ভরে কাবাব খেলাম। আম্মার নিজের হাতে বানানো সস সবসময় লুকানো থাকে। বিশেষ বিশেষ মেহমান ছাড়া সেই সস কখনো আলোর মুখ দেখে না। আশেপাশে আম্মা নেই। আজ আমাদের পায় কে!
একটু পরেই আম্মা রান্নাঘরে এলেন। অন্যসময় হলে উনি অবশ্যই আমাদের দু’বোনকে রান্নাঘরে দেখলে সন্দেহ করতেন। আজ দেখলাম, সব অন্যায় মাফ। এরপরে শুরু হলো ট্রে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। আম্মা একটা ট্রে নেন তো ছোট চাচি আরেকটা নিয়ে যান। বড় আপু শুধু এ ঘর ও ঘর করছেন , উনি দেখলাম আজ ঘোমটাও দিয়েছে । আমি আর হৃদি এই নিয়ে এক ফাঁকে একটু হেসেও নেই।
আব্বু আর ছোট চাচা মেহমানকে পরিবেশনে ব্যস্ত। আমার রুম থেকেই শোনা যাচ্ছে, ‘ভাইতো কিছুই খেলেন না, এই উনাকে আরো দুইটা রোল দাও তো! আহা সাথে একটা চিকেন ও দাও না !’ এসব শুনে টুনে ভাবলাম, এই সুযোগে টানা একটা ঘুম দেই । এমন সময় আপু আমার রুমে এলেন। আমি কিছু বোঝার আগেই আমার ওড়নাটা ঘোমটার মতো করে মাথায় দিয়ে দিলেন। ছোট চাচি হাতে ধরিয়ে দিলেন কোল্ড ড্রিংকস এর ট্রে।
আপু বলে দিলেন, আমি যেন লক্ষ্মী মেয়ের মতো ট্রে হাতে নিয়ে ড্রইংরুমে যাই। হাত না তুলে মাথা ঝাঁকিয়ে নিচু গলায় সালাম দেই। আমার বিখ্যাত ঝগড়ুটে গলা যেন মেহমানরা মোটেও আঁচ না করতে পারেন, ছোটচাচি তাই নিয়ে বিস্তর উপদেশ দিলেন। আমিও মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে প্রাকটিস করে নিলাম। আমি রুমে ঢুকেই বিপদে পরে গেলাম, দুজন বসে আছে, কাকে সালাম দেই। এদিকে দুই হাত বন্ধ। শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে সালাম দিতে গিয়ে আধাআধি করে দেয়া ঘোমটাও খুলে গেলো।
ওয়ালাইকুম আসসলাম ওয়ালাইকুম আসসালাম। বলে উঠে দাঁড়ালেন এক দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক। উনার পাশেই গোবদা মার্কা একটা ছেলে বসে আছে। মুরুব্বী আমাকে খেয়াল করে দেখছেন। কিন্তু আর একজন মনে হয় লাজুক বেশি। মাথা নিচু করে আছেন। তখনই আমার কাছে সবকিছু পরিষ্কার হলো। উনারা আসলে আমায় বিয়ের পাত্রী হিসেবে দেখতে এসেছেন। গোবদা বেচারাই পাত্র কিনা, আল্লাহ মালুম । মুরুব্বী মুখের ভেতর আস্ত কাবাব পুরে দিতে দিতে আমায় বললেন।
— আফনে খিতা খরুইন আমি ভাল মানুষের মতো মুখ করে বললাম।
— বসে আছি।
— আফনের আব্বা,যে খইলো আফনে ফরইন।
— না না আমি ফরেনে থাকিনা। আমার মাথায় তখন দুষ্টু বুদ্ধি চেপে বসেছে।
— না, আফনার আব্বা আমাকে বলেচেন। আফনে ফরইন।
— আমি তো ফরেন নাই। আমার বংশের ও কেউ ফরেন নাই।
— উমা বলে কি! সবাই যে বললো আফনেরা শিক্কিত পেমিলি। কি মিত্যা কতা। নাউজুবিল্লাহ। আম্মা ব্যাপার বুঝে হেসে বললেন।
— না ভাই সাহেব। আমার মেয়ে ফান করে বলেছে।
— কি বলেন? আফনার মেয়ে ফান ও করে ! তা কি কায় গাইঞ্জা না মদ?
— আরে না ভাই। আমার মেয়ে হয়েছে তার বাবার মতো। মেয়ের বাবাও সবসময় ফান করে।
— কি আজিব পেমেলি। বাফ মেয়ে দুজনেই ফান করে। নাউজুবিল্লাহ। এবার গোবদা মনে হয় মুরুব্বীর কানে কানে কি বললো। উনি দুই একবার গলা খাঁকারি দিয়ে চুপ করলেন। আব্বু হঠাৎ বলে উঠলেন।
–” ফান” অর্থ মজা , বুঝলেন ভাই । আমি সবসময় মজা করে কথা বলতে পছন্দ করি। আনন্দ, মজা এসব নিয়েই তো জীবন! উনিও আব্বুর কথায় সায় দিলেন। আপনারা যে কুব আনন্দে আচেন, তা আমি এই সরলা বালিকাকে দেখেই বুজতে পেরেচি। আনন্দ তামাশা না হলে আবার জীবনের মুইল্য কি ! উনি আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন। আব্বু বললেন – এই ভাই ওয়েট ওয়েট , আপনি কাকে সরলা বালিকা বলছেন! উনি আমার স্ত্রী। এই মেয়ের মা !
— বলেন কি, তাইজ্জব গঠনা। বালিকা এই মেয়ের মা? সৎ না আপন? বরই সৌইন্দর্য।
— ভাই আপনিতো দেখছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো। পাত্রী দেখতে এসে পাত্রীর মাকে পছন্দ করে ফেলেছেন। বলে, আব্বু হো হো করে হেসে ফেললেন । আমিও সব শেখানো আদব কায়দা ভুলে হু হু করে হেসে উঠেছি । উনি তখন একটুও না ঘাবড়ে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে বললেন-
— আপনি টিক্কই বলেচেন বাই। আমি নিজেও একজন ছোটখাটো রবীন্দ্রনাথ। আমিও অল্পবিস্তর কাইব্য ছর্চা গরিএ। এমন সময় দুষ্টু দুষ্টু মুখ করে ছোট চাচা এগিয়ে এলেন।
— আমাদের এই আকালের যুগে আপনার মতো রবীন্দ্রনাথেরই তো দরকার। তা ভাই আপনি কি কি কাব্য চর্চা করেন?
— বাইজান আমার সংসারে তো খাইব্য ছর্চার কুনু মূল্য নাই। আমার পরিবার এসব ভালো না পায় । তাই আমি এখাই এখাই কাইব্য চর্চার মাজে আচি। এমন সময়ে গোবদা বেচারা ( তার বাবা বা চাচার ) পায়ে একটু চাপ দিলো। উনি বিরক্ত হয়ে বললেন-‘ তাম ব্যাটা, মনের মতো দুজ্ঞা মানুষ পাইয়ে, এখটু মনর খতা কই। ‘ সুযোগ মতো চাচাও উৎসাহ দিলেন ‘ সত্যিই ভাই আপনাকে পেয়ে আমরাও ধন্য। এবার আপনার অমূল্য কাব্য থেকে আমাদের কিছু বলুন। আমরাও একটু শুনি !
— আইচ্চা বাইসাব, ছুডু একটা খবিতা শুনাই। বলে উনি কেশে গলা পরিস্কার করে নিলেন। তারপর চোখ বন্ধ করে বলা শুরু করলেন।
” আমরার ছুডু নদী ছলে বাঁখে বাঁখে বৈশাক মাসে হেয়ানো আডু ফানি তাহে ফারুইয়া যায় গরু, ফার অয় গাড়ি দুই কানি উচা থার,ডালু থার ফাড়ি। ” এবার আর কে কাকে ঠেকায় আমরা সবাই হাসছি। আর উনি তখন হঠাৎ রেগে গোবদা বেচারাকে টানতে টানতে বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন আর বলছেন।
— কি আজফ ফাগল পেমেলি। বাফরে বাফ।
আব্বু বললেন – পাগল বলুক আর যাই বলুক, উনাদের আসার সুবাদে আর যাই হোক বহুদিন পরে প্রচুর হেসেছি । দাও এখন নাস্তাপানি আমরাই খাই। ছোটচাচা তখন হাসতেও পারছেন না কথাও বলছেন না। উনার গাল ভর্তি তখন মিঠাইয়ের সেই বিগ সাইজের মিষ্টি।