তুই নাকি প্রেম-টেম করিস?” খাবার টেবিলে আম্মুর কথা শুনে হঠাৎ গলায় ভাত আটকে কাশতে শুরু করলাম।এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে তিনি আবার বললেন, “বললি নাতো আমাকে?” আমি বললাম, তুমি কার কাছ থেকে জানলে?
–অজানার কি আছে।সামান্য ব্লক বাটন দিয়ে এতবড় একটা নিউজ আটকে রাখা যায় নাকি? এতো মানুষ জানতে পারে আমি জানতে পারি না?
–ব্লক তোমায় অন্য কারনে করেছি আম্মু।আর রিলেশন-ফিলেশন করিনা কিছু। এমনি প্রোফাইল এডিট করতে ছিলাম,কীভাবে যেনো আপডেট হয়ে গেলো।পরে ভাবলাম বন্ধুদের সাথে মজা নেই। আম্মু আমার দিকে চোখ বড় করে তাকিয়ে বললো, “তোর পেটে আমি হয়েছি নাকি তুই আমার পেটে হয়েছিস?”
–এটা কেমন প্রশ্ন? “প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করবিনা,যা জানতে চেয়েছি বল”
–তোমার পেটে আমি হয়েছি। তাহলে? তোকে আমি তোর চেয়েও বেশী চিনি কি চিনি না?কখন সত্যি বলছিস কখন মিথ্যা চোখ দেখে বলে দিতে পারি।
–ভাত খাওয়ার সময় এতো চার্চ কেনো করো তুমি?তুমি কি চাও আমি খাবার রেখে উঠে যাই?
খাবার রেখে উঠে যাওয়ার মতো আমি কিছু বলিনি। আমি খাবার রেখে উঠতে যাবো ওমনি আম্মু হাত চেপে ধরে বললো,তুই খাবার শেষ না করে গেলে আমার মরা মুখ দেখবি। আমি আবার বসে বললাম,এমন করছো কেনো?
আম্মু বললেন, কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি তোর মেজাজ খিটখিটে থাকে।ফোনে কথা বলার সময় হঠাৎ-হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠিস।সকালের খাবার দুপুরে খাস তো দুপুরের খাবার রাতে।তোর বন্ধুরা তোকে ওয়েটিং পেয়ে আমাকে কল করে।গভীর রাতে বাথরুমের ট্যাপ ছেড়ে চোখেমুখে পানি দিস আমি আম্মুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম,তুমি রাত জেগে আমাকে পাহারা দাও? পাহারা দেইনা। সেদিন রাতে চোখে পড়লো।প্রেম কর আমি নিষেধ করিনি।কিন্তু নিজেকে রীতিমতো টর্চার কেনো করছিস বুঝতেছিনা।চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে তোর।শেষবার কবে মাথার চুল আচরিয়ে ছিলি মনে আছে? আমি খাওয়া রেখে হাত ধুতে ধুতে বললাম,
–তুমি রাত জেগে আমাকে পাহারা কেনো দাও সেটা আগে বলো?
আম্মু আমার কথা উত্তরে একটা চিরুনি নিয়ে এসে বললো, তোর চুলের সামনের দিকে কেমন জটের মতো বেঁধে গেছে। সেম্পু-টেম্পু করিস না? আমি সাথে-সাথে রেগে গিয়ে বললাম,
–চুলে হাত দিবে না।কি চাও তুমি? সারাজীবন তোমার আঁচলের নিচে বসে থাকি? কখনো বন্ধুদের সাথে দূরে যেতে দাও না।বাইক চালানো শিখতে দিলে না।ভার্সিটি থেকে ফিরতে একটু দেরী হলে ৫০০ বার কল করো।শুধু আমাকে না বন্ধুদেরও ফোন করে বিরক্ত করো।আমি নিজের চুল নিজে আঁচরাতে জানি।নিজের খাবার হাত দিয়ে খেতে পারি।চুলে কখন সেম্পু করতে হয় তাও জানি।প্লিজ লিভ মি এলোন। আম্মু অবাক হয়ে বললো, তুই এভাবে কথা বলছিস কেনো?
–করবোনা তো কি করবো?তোমার জন্য আমি পড়াশুনার জন্য দেশের বাইরে যেতে পারিনি।জীবনের সব ডিশিসন তোমার অনুমতি নিয়ে করতে হয়।আমার মেয়ে বান্ধবীরা কি বলে জানো?বলে বিয়ের পর বাসর ঘরেও নাকি তোমার অনুমতি নিয়ে যাবো। আম্মু হঠাৎ চুপ হয়ে রইলো।কিছুক্ষন পর বললো,
–এতো রাগ আর এতো ক্ষোভ কবে থেকে মনে জমা করে ছিলি?
–জমা আগে থেকেই ছিলো।এতোদিন বলিনি আজ বললাম। কেনো বললি? নতুন গার্লফ্রেন্ড বলতে বললো বুঝি?
–সব প্রসঙ্গে গার্লফ্রেন্ড টানবে না।কিছু সিদ্ধান্ত একান্ত আমার।আমি যদি প্রেম করেও থাকি তোমার সমস্যা হবার কথা নয়।নিজের ভালোমন্দ বোঝার মতো বয়স আমার হয়েছে। তুমি না থাকলেও আমার জীবন ভালোই চলবে।
এই কথাটা বলেই আমি চুপ হয়ে গেলাম।মনে হলো বেশী বলে ফেলেছি।যদিও আম্মু এর পর আর কথা বাড়ায়নি। তখন রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে যাই।বাসায় ফিরি রাত ৯ টায়।অবাক করার বিষয় এর মাঝে আম্মুর একবারও কল আসে নি।
বাসায় এসে দেখি তালা ঝুলছে।পাশের বাসার আন্টি চাবি দিয়ে বললো,তোমার আম্মু চাবি দিয়ে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে তোমার নানুর ওখানে গেছে বুঝি? আমি মুচকি হেসে বললাম “হুম” আম্মুকে আর ফোন না দিয়ে বাসায় ঢুকে লাইট অন করি।টেবিলের উপর খাবার সাজিয়ে রাখা পাশে এক চিঠি।চিঠি বললে অবশ্য ভুল হবে এলোমেলো শব্দে মোটা মোটা অক্ষরে লেখা,
“আজকের মতো খাবার রেখে গেলাম।কাল থেকে নিজের খাবার নিজে তৈরি করে খাবি অথবা যেভাবে খেতে ইচ্ছে হয় সেভাবে খাবি।আমি খুব খুশি হয়েছি যে তুই বড় হয়ে গেছিস।তোকে মুক্তি দিয়ে গেলাম।নিজের ইচ্ছেতে গেলাম আবার নিজের ইচ্ছেতে আসবো,অযথা খোঁজাখুঁজি না করাই ভালো।” তারপরের কাহিনী খুব সংক্ষিপ্ত।আম্মুকে কল করে পাই না।
সকাল থেকে অনেকবার কল করেছি।যতরকম সরি লেখা যায় সবরকম লিখেছি।দুপুরে হোটেলের বাসি খাবার খেয়েছি। মাথা ব্যথায় ৩ টা ঘুমের ঔষধ খেয়ে টিভি অন করে সোফায় ঘুমিয়ে সন্ধ্যা পার করেছি। যখন ঘুম চোখে ফোনের দিকে তাকিয়েছি। গার্লফ্রেন্ডের আর বন্ধুদের মিসড কল দেখিছি।আত্নীয়-স্বজন সবার বাসায় খোঁজ নিয়ে জেনেছি কোথাও যান নি। ঘুমের ঘোরে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম ! আম্মু সাদা ধবধবে ঘোড়ায় চড়ে এসে সাদা এক চিরুনি এনে বললো,আয় সাদবিন তোর মাথার চুল আচরিয়ে দেই।
অবাক কান্ড স্বপ্নে আমি চুপচাপ ঘোড়ায় চড়ে বসলাম।আম্মু চুল আচরিয়ে দিলো।ঘোড়া আপন গতিতে ছুটে চললো।সবকিছু ধূসর লাগছে। আম্মুকে দেখা যাচ্ছে না।কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলাম ঘোড়ায় আমি একলা বসা আম্মু আর নেই। ছুটন্ত ঘোড়ায় আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলাম। ঘোড়ায় শুধু সাদা কাগজের এক চিরকুটে লেখা, “আমি চললাম সাদবিন,তুই এখন নিজের চুল নিজেই আঁচরাতে পারবি” যখন জেগে উঠলাম তখনও আমার চোখ ভেজা।চুল এলোমেলো।আম্মু শরীরের ঘ্রান এখনো যেনো আমার চোখে মুখে লেগে আছে।