ছোটবেলায় স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে আমরা হাউস টিউটরের কাছে পড়তাম । আশপাশে থেকে আমরা সব বন্ধুরাই পড়তে যেতাম আদনানদের বাসায় । মাষ্টার সাহেব যখন বসে বসে ঝিমুতেন তখন আমরা চুপ করে ওঠে গিয়ে রোদে শুকাতে দেওয়া আচার একেবারে সবার করে দিতাম । আমার স্পষ্ট মনে আছে, রোজকারের মতোই এক দিন সবাই ছাদে আচার খাচ্ছি । হঠাৎ আদনানের আম্মা দেখে ফেললো ।
সেই দিন মাষ্টার সাহেবকে বেশ বকুনি খেতে হয়েছিল আমাদের দুষ্টুমির ওপরে নজর না রাখার জন্য । হয়তো তিনি আদনানের আম্মার কথায় খুব কষ্ট পেয়েছিলেন, কারণ তারপর থেকে তিনি আর আমাদেরকে পড়াতে আসেন নি । মাষ্টার সাহেবের দুর্বলতা ছিল ঘুম । ঘুমাতে তিনি খুবই পছন্দ করতেন । পড়াতে এসেই তিনি চেয়ারে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বসতেন । তারপর একটু কাত হতেই পুটি মাছ অতল জলে তলিয়ে যেতো । ছোটবেলায় তার এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমরা দুষ্টুমি করলাম । আর সেই কারণে বকুনি খেতে হলো মাষ্টার কে । ছোটবেলার অপরাধের জন্যেই হয়তো আমার কপালেও একটা বজ্জাত ছাত্র জুটেছে । কেবল মাত্র ফাইভে পড়ে কিন্তু কি পাকা পাকা কথা বলে !! খুবই দার্শনিক প্রকৃতির, কিন্তু তার দর্শন বিদ্যা শুধুমাত্র প্রেম আর ফেসবুকের মাঝখানে সীমাবদ্ধ । প্রথমদিন পড়াতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল ।
অঙ্ক বইটা একটু উল্টে পাল্টে দেখছি এমন সময় আমার ছাত্র নিহাল তার ফোনটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “স্যার একটা রোমান্টিক স্ট্যাটাস লিখে দিন তো । দু’দিন ধরে কোন স্ট্যাটাস দিইনা ।” আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । এত্ত পিচ্চি একটা ছেলের ফ্রেন্ডলিস্টে মেয়ের অভাব নাই । ওই দিন অঙ্ক করার সময় আমাকে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বললো, “স্যার ! মেয়েটা বিদেশী । ইংরেজিতে মেসেজ দিচ্ছে !! আমি তো কিছু বুঝি না ইংরেজি । আপনি একটু চ্যাট করে দিবেন প্লিজ ??
তবে ও যতোই ফেসবুক নিয়ে গবেষণা করুক না কেন নিজের পড়া ঠিকমতো দেয় আর তাছাড়া অনেক ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে । এমন স্টুডেন্ট পড়ানোর মজাই আলাদা !! একটু বুঝিয়ে দিই আর বাকিগুলো নিজেই করে ফেলে । এর আগে যে মেয়েটাকে পড়াতাম ওটা একটা আস্ত বোকা ছিল । ক্লাস সিক্সে পড়া একটা মেয়ে ছোট ছোট ভাগ করতেই হিমশিম খেয়ে যেতো । ওই ছাত্রীকে পড়াতে গেলে আমার নিজের আর পড়া হতো না, সারাটা রাত মাথা ব্যাথা করতো । সে তুলনায় নিহাল অনেক ভালো আছে । তাই ওকে মাইর না দিয়ে একটা ছোট ধমক দিয়ে বললাম, “তাড়াতাড়ি শেষ করো । অন্য সাবজেক্ট আছে তো ।” পরেরদিন পড়াতে গিয়ে দেখি নিহাল মন খারাপ করে বসে আছে, খুবই চুপচাপ । কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বললো, “স্যার! মেয়েদের বয়স বোঝার আসলেই কোন উপায় নেই ।” আমি তো পুরাই অবাক । হঠাৎ মেয়েদের বয়সের পিছনে ক্ষেপলো কেন ?
– কেন ? কি হয়েছে ?”
– আমি যে আমাদের কোচিংয়ের অঙ্ক ম্যাডামের ওপর ক্রাশ খেয়েছিলাম সেটা আপনাকে বলেছিলাম না ?
– হ্যা । ওই যে লম্বা করে ফর্সা ম্যাডাম । খুব ভালো অঙ্ক করায় ।
– হ্যা হ্যা হ্যা । ওই ম্যাডাম টাই আমাকে শেষ করে দিছে ।
– মানে কি ? তোমাকে পিটুনী দিয়েছে নাকি ?
– না স্যার, পিটুনী দেয়নি । আমি আজই জানতে পারলাম ক্লাসমেট রাজুর আম্মু উনি । কি লজ্জার ব্যাপার !!
কথাটা শুনে হি হি করে হেসে ওঠলাম । আমার হাসি শুনেই নিহালের মুখটা আরো ছোট হয়ে গেল । পিচ্চিটাকে তো এমন গোমড়া মুখে দেখতে চাই না আমি । এখন কি যে করি ! নিহালের মন ভালো করার জন্যেই, আন্টিকে বলে নিহালকে নিয়ে বেড়াতে বের হলাম । সারাবিকাল ঘুরা ঘুরি করে, আইসক্রিম খেয়ে সন্ধ্যায় ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসলাম । তখন আর নিহালের মন খারাপ ছিল না, খুব হাসি হাসি মুখেই ঘোরাঘুরি করেছে । পরেরদিন গিয়ে দেখি ছাত্রের মুখ একটু বেশি জ্বলজ্বল করছে । আমি বললাম, “কি হলো নিহাল ? আজকে এতো খুশি কেন ? Ben 10 এর ঘড়ি কি পেয়ে গেছো ?”
– না স্যার । তবে অনেক বড় জিনিস পেয়ে গেছি ।
– কি পাইছো ?
– গতকালকে রাতে ক্লাস টেনের একটা মেয়েকে পটিয়ে নিয়েছি । কি যে সুন্দর দেখতে !! স্যার, আপনি না দেখলে বিশ্বাস করবেন না !! আমি অবাক হয়ে বললাম, “ক্লাস টেনের মেয়ে ক্যামনে তোমার মতো পিচ্চির কাছে পটে যায় ?” ফেইক নিউজ না তো ?”
– স্যার আমি কি বোকা নাকি ? আমি বলেছি আমি এইবার ইন্টারে পড়ি ।
বলেই আমার ছাত্র সবগুলো দাত বের করে একটা হাসি দিলো । মাঝখানে একটা দাঁতের জায়গা যে ফোকলা সেটাও দেখতে পেলাম । নিহাল ফোন নিয়ে আসলে দেখলাম আইডির নাম Dreamless Queen আর প্রোফাইল পিকচার দেওয়া একটা কোরিয়ান অথবা, জাপানি মেয়ের । আইডিটা দেখে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো । এক সপ্তাহ আগে আমার ছোটবোন নদীকে আইডি টা খুলে দিছি । হায়রে আমার ছাত্র রে !! তুই শেষ পর্যন্ত আমার বোনকেই পাইলি ?
বাসায় গিয়েই নদীর কাছে থেকে ওর ফোনটা নিয়ে নিলাম আর বললাম, “একসপ্তাহ এই ফোন আমার কাছে থাকবে।” পরেরদিন প্রাইভেট পড়াতে যেতে যেতেই ঘেমে গেছি । রাস্তায় প্রচুর রোদ । ফ্যানের নিচে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছি ঠিক তখনই নিহাল হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসলো, “স্যার, স্যার ! মেয়েটা আমাকে বাবু বলে ডেকেছে !! আমি মনে মনে বললাম, “খেলা তো কেবলে শুরু নিহাল বাবু ।”