আপুকে নিয়ে আমরা পড়লাম মহা ঝামেলায়। কোন পাত্রকেই তার পছন্দ হয় না। এই ছেলে লম্বু, ওই ছেলে টাকলু, সেই ছেলে খাটো, ওই ছেলে মোটা ইত্যাদি যুক্তিতে কান ঝালাপালা। মা বলেন, তোর বিয়ে হবে না।
– না হোক। এখানেই থাকব।
বাবা বলেন, এতগুলো পাত্রকে তার পছন্দ হয়না! কোন রাজকুমারকে বিয়ে করবে শুনি? বাবার রাগী কথায় সবাই চুপ থাকে। পাত্ররা দেখতে আসলে আমার ঈদ। পাত্রী দেখার পর তারা আমাকে নিশ্চিত হবু শালা ভেবে এটা ওটা কিনে দিতো। মেয়ের ভাই পটলে মেয়েও পটবে, হয়তো এমন ধারণা ছিল। তারা ভাবতো, সিক্স সেভেনে পড়া এই পিচ্চি ছেলেটা তাদের স্ট্র্যাটেজি বুঝবে না। আমি বুঝেও না বোঝার ভান করতাম।
ওদিকে আব্বা হরেক রকমের মিষ্টান্ন কিনে আনতেন। মেয়েকে দেখতে আসবে, ভাল আপ্যায়ন না করলে জাত যাবে ! পাত্র ও তার সাথে থাকা বন্ধুদের ইচ্ছে থাকলেও বেশি খেতে পারেন না। বেশি খেলে ইজ্জত যাবে। লাভ হয় ঘটক মশাইদের। তারা যেমনি বকবক করে, তেমনি খায়। পাত্রী দেখা শেষ করে যাবার পর বেঁচে যাওয়া মিষ্টান্ন নিয়ে কাড়াকাড়ি করতাম। মা বলেন, একটু আগেই না খাইলি? এত মিষ্টি এক সাথে খেলে অসুখ করবে।
বাবা মার মারফতে জানতে চাইলেন এতগুলো ছেলেকে ফিরিয়ে দেবার কারণ? বিশেষ কাউকে পছন্দ করে কিনা তাও শুনতে চাইলেন। মা এসবের কোন উত্তর দিতে পারলেন না। বাবা বিরক্ত হয়ে ঘটককে বললেন, আর কোন পাত্র দেখার দরকার নেই। ঘটক মশাই ছাতা বগলের মধ্যে চেপে ধরে বললেন, কি কন? এইবার নাম্বার ওয়ান ছেলেরে দেখামু। খালি একটু সময় দেন। ঘটকের বিধি বাম। নাম্বার ওয়ান ছেলেটাও জিরো বলে স্বীকৃতি পেলো। আমি আপুকে বললাম, কিরে তুই কি কাউরে পছন্দ করিস?
– নাহ।
– তো এত বর ফিরিয়ে দিচ্ছিস কেন?
আপু হেসে বলল, তোর মিষ্টি খাওয়ার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য। আমিও খুশি হয়ে বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে। আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে গালে একটা চুমু দিয়ে বলল, আমি চলে গেলে তোর সাথে গল্প করবে কে? দুষ্টুমি করবে কে? এসব না ভেবে শুধু মিষ্টির কথায় খুশি হলি? আপুর মায়া মমতা ভুলে গেলি?
– নাহ আপু। তুই কোত্থাও যাবি না। এ বাড়িতেই থাকবি।
– কিন্তু তোর বউ এলে তো আপুকে ভুলে যাবি।
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, ধুর। আমি বিয়েই করব না। আব্বা আজ ভীষণ খুশি। আপু পাত্রকে পছন্দ করেছে। আব্বার দেড় বছর ধরে চলা বিরক্তির অবসানে মার মনেও আনন্দের ঢেউ। মেয়ের মত পাল্টানোর ভয়ে আব্বা দেরি করতে চাইলেন না। পাত্রপক্ষের যৌতুকের দর কষাকষিতে আব্বা হার মানলেন। তাদের কথা অনুযায়ী যৌতুক নির্ধারিত হল। বিয়ের দিন তারিখ পাকা হল। আব্বা দক্ষিণ গাঁয়ের দুই বিঘা ধানী জমি বিক্রি করলেন। মোটা মোটা কয়টা বান্ডিল নিয়ে মার কাছে রাখলেন।
আমার মনে বিশাল আনন্দ। আক্কেলপুর থেকে চারটা বড় বড় সাউন্ড বক্স, সিডি প্লেয়ার ভাড়া করে আনলাম। ছয় সাত দিন ধরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈচৈ, উল্লাসে মেতে উঠলাম। সারাদিন গান বাজাতাম, বিকেলে হতো পাড়ার মেয়েদের ড্যান্স, সন্ধ্যায় ছেলেদের। গান বাজনার ঝোঁকে আশে পাশের পাড়ার মধ্যবয়স্ক ও বয়স্ক লোকও আসত উৎসব দেখতে। মহিলারা পান খেয়ে গীত ধরত। আমার কাজ ছিল অপারেটরের। কখন কোন গান বাজাবো, সাউন্ড জোরে না ধীরে, ব্যাটারিতে চার্জ আছে নাকি নেই, জেনারেটর মেশিন ঠিকমত চলছে কিনা ইত্যাদি। দুই দিন আগে বিয়েবাড়ি লেপা পোছা শেষে নকশা করা হল। স্রোতের মত মেহমানরা আসতে শুরু করল। আব্বা, মা, বড় দুলাভাই, বোনরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
গ্রামের বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল আমার। তারা সবাই মিলে বিয়ের আগেরদিন গেট বানালো। আমি শুধু হালকা সাপোর্ট দিয়েছি। সব কাজ ওরাই করেছে। ছোট মামার কাছ থেকে ফিল্মের ক্যামেরা এনেছি। একশো পঁয়ত্রিশ টাকায় ফিল্ম কিনেছি। অযথা ক্লিক করলেই ফিল্ম নষ্ট। বড়জোর ত্রিশ কি বত্রিশটা ছবি তোলা যাবে। সংখ্যাটা ঠিক মনে নেই। মনের আনন্দে মজার মুহুর্তগুলো বন্দী করতে লাগলাম। বিয়ের দিন চলে এল। বাড়ির খলায় অনেকগুলো চেয়ার টেবিল সাজানো। মাথার উপর আকাশী লাল রঙের সামিয়ানা। কিন্তু বরপক্ষ আসতে এত দেরি করছে কেন? শুক্রবার দিন। নামাজের টাইম পেরিয়ে গেল। আমরা পথের দিকে চেয়ে রইলাম। সিনেমার কথা মনে হল, বর যদি না আসে?
বরপক্ষ এলো সাদা প্রাইভেট কারে। গেটের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বাড়িতে প্রবেশ ঘটল। বিয়ে পড়ানো হল। আমরা সবাই মিলে খাবার পরিবেশন করলাম। খাওয়া শেষে এবার বিদায়ের পালা। বাবা রিমি আপুর হাত বরের হাতে তুলে দিলেন। আপু কান্নায় ভেঙে পড়ল। মা তো দুপুর থেকেই কাঁদছে এখনও কাঁদছে। আমার গলায় ক্যামেরা ঝুলছে। কেমন ছবি তুলি তার চেয়ে বেশি আনন্দের ছিল যে আমি তুলতে তো পারছি। খট খট করে প্রিয় ও কষ্টের সব মুহুর্তকে ক্যামেরাবন্দী করলাম।
আপু গাড়িতে উঠল। জানালার পাশে বসেছে। দুলাভাই তার পাশে বসেছেন। আমি জানালার ওপার থেকে কয়েকটা ছবি তুললাম। কত আনন্দ মনের ভেতর। আব্বা, মা চোখ মুচছেন কিন্তু আমার ভেতরে কোন কষ্টই অনুভূত হচ্ছে না। সমগ্র আয়োজন নিয়ে আমি যেন একমাত্র ব্যস্ত মানুষ। আপুর সাথেও দুই দিনে তেমন একটা কথা হয়নি।
গাড়ি ছাড়ল। আমি দাঁড়িয়ে আছি আপুর জানালার পাশে। আপু কেমন যেন দৃষ্টি দিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে। আমি হাত নেড়ে ইশারা করে বললাম, যা। ভাল থাকিস। গাড়ি চলে গেল। নাম্বার প্লেটটা দৃষ্টিসীমা ছাড়িয়ে ঝাপসা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল। মনের অজান্তেই একটু সামনে হাঁটতে থাকলাম। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর বসে পড়লাম রাস্তার পাশেই। আপুর বিষন্ন মুখ বারবার আমার মস্তিষ্কে আঘাত করতে লাগল। কিশোর বয়সে আমি শিশুর মত হাউমাউ করে কাঁদছি।
এত অশ্রু জলেও আপুর মায়াবী মুখ ভুলতে পারছি না। কান্না গোপন করতে পাশের নির্জন জায়গায় গেলাম। আপুও কী আমার মতই কাঁদছে? ক্যান আপুর বিয়ে হল? মানতে পারছি না। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আপুর সাথে মারামারি, ঘুমানোর আগে ভুতের গল্প, লুডু, গাদল, লুকোচুরি, কানামাছি, পুতুল, বাঘ বকরি, চোর পুলিশ খেলা, হাট ফেরত আব্বার বাজারের ব্যাগে থাকা জলপান নিয়ে কাড়াকাড়ি। চোখের জল শুকিয়ে নিঃশ্বাস ঘন হয়ে হৃদকম্পন বেড়ে যাচ্ছে। আপুর ওই অসহায় চাহনি আমায় বারবার ক্ষতবিক্ষত করছে। রক্তের টান এত দৃঢ় এই প্রথম অনুভব করলাম। আফসোস, আপুর সাথে আর আগের মত মারামারি, কথা কাটাকাটি করা হবে না। যে জন্ম নিয়েছে পরের ঘরে যাবার জন্য, তাকে শত বাঁধনেও বেঁধে রাখা যায়না।
পরদিন যা ঘটল তাতে পুরাই চমকে গেলাম। দুপুরে দুলাভাই সহ আপু হাজির। বিয়ের পরের দিন শ্বশুরবাড়ি আসা দৃষ্টিকটু। আব্বা মাও অবাক হলেন। নিশ্চয়ই কোন ঝামেলা হয়েছে ভেবে শঙ্কা বোধ করলেন। আর আমি যেন পুরো পৃথিবী হাতে পেলাম। ভেতরে একটাই আনন্দ, আপু এসেছে! আপু আমাকে দেখেই বুকে জড়িয়ে গালে চুমু দিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠল। মনে হল কত বছর ধরে আপুকে দেখিনি। আপুর স্নেহ পাইনি। নব্য দুলাভাই পিঠে একটা মৃদু থাবা দিয়ে বললেন, শালাবাবু, রেডি হও। আমাদের সঙ্গে যাবে।