আমি কালো কিন্তু অভিশাপ নই

আমি কালো কিন্তু অভিশাপ নই

আমি কালো, এরকম কালো মনে হয় আমাদের বংশে আর কেউ নেই। আমাকে দেখে দাদী ফুফুরা মুখ বাকিয়ে আমার মাকে বলতো,এতো কুচকুচে কালো, তাও আবার মেয়ে মানুষ একে নিয়ে তো সমস্যা, বিয়ে দিবে কেমন করে??.. কে গোছবে তোমার এই মেয়েকে?? ছেলে হলে তো কোন কথাই ছিলোনা, হাতি যেমন জিন্দাতেও শুয়া লাখ, মরলেও শুয়া লাখ টাকা দাম। ঠিক তেমনি ছেলে মানুষ সাদা হলেও যা দাম কালো হলেও তাই দাম। ওদের নিয়ে চিন্তা নেই।

সবাই আমাকে ছোট থেকেই খুব অবহেলা করতো, কেউ কোলে নিতো না।আমার একটা চাচাতো ভাই ছিলো দেখতে খুব সুন্দর আর ফর্সা তাই সবাই ওকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো, ওকে কোলে নিতো। এসব দেখে বাবাও আমার জন্য আমার মাকে খালি বকা দিতো। সবার কথা শুনে বাবার মেজাজটা খুব খিটখিটে হয়ে গেছিলো।আর সব রাগ তুলতো আমার মায়ের উপর। কখনো কখনো গায়েও হাত তুলতো।

মা আড়ালে খুব কাঁদতো আমার জন্য, ভাবতো আমার মেয়েটার কি হবে। একে তো মেয়ে মানুষ তার উপর কালো, বাড়ির লোকেরাই তো আমার মেয়েটাকে সহ্য করতে পারে না, তাচ্ছিল্য করে। তাহলে ওকে কে দেখবে।মা সবসময় নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতো, আর আমার জন্য কোন কিছুর একটা ব্যবস্থা করতে বলতো। সবার অবহেলা, অবজ্ঞা,তাচ্ছিল্য নিয়ে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলাম। সবসময় বোরকা পরে বাইরে যেতাম বলে পাড়ার লোকেরা বলতো আমি কালো তাই আমার কালো চেহারা টা ঢাকার জন্য নাকি আমি পর্দা করি।তারা আমাকে নিয়ে মজা করতো আর বলতো,

আরে তুই তো হাড়ির কালি, তুই বোরকা পরলেই কি আর না পরলেই কি, তোর দিকে কেউই ফিরে তাকাবেনা।
একথা বলেই তারা অট্টহাসি দিতো। মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগতো, কষ্ট হতো,কিন্তু ভাবতাম আমার রুপ,আমার সৌন্দর্য আমার পরিচয় হতে পারে না।আমার পরিচয় তো আমার কর্ম আমার ব্যবহার।একদিন ঠিকই ওরা ওদের কথার জবাব পাবে।সেটা আমি দিবোনা আমার কর্ম দিবে।

আমার খুব ইচ্ছা ছিল আমি লেখাপড়া করবো, তাই প্রতিদিন স্কুলে যেতাম, কিন্তু আমার বাবা আমাকে পড়াবেনা।বিয়ে দিয়ে দিবে কিন্তু সেটা ও পারেনা। পাত্রপক্ষ আসে আর চলে যায়। আমি কালো দেখে তাদের আর পছন্দ হয় না। তাই আমার বাবার ধীরে ধীরে আমার প্রতি রাগ জন্মে যায়।আর মাকে দোষারোপ করে মা আমাকে জন্ম দিয়েছে তাই। বাবা মনে করে আমি তার পাপের শাস্তি। কিন্তু মা কখনো আমাকে কিছু বলেনি, বরঞ্চ আমাকে আরো শ্বান্তনা দিতো। বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগাতো। তারপর ও কেন জানি বাবার কথা শুনে খুব কষ্ট লাগতো।একদিন তো বাবা বলেই ফেললো, এতো মানুষের মরণ হয়, তোর মরণ হয় না, তুই মরতে পারিসনা। তোর জ্বালায় পাড়ায় মুখ দেখাতে পারিনা। তোর লজ্জা করে না।

বাবার মুখে এসব কথা শুনে মনে হতো নিজেকে শেষ করে ফেলি কিন্তু পরক্ষণেই মনে হতো, আমার মৃত্যু মানে আমার পরাজয়, আমার হার,না আমি হার মানবোনা। নিজেকে প্রমাণ করেই ছাড়বো। তাই শত অবহেলা স্বয়েও লেখাপড়া চালিয়ে গেলাম, বাবা কোন সময় ই আমার লেখাপড়ার খরচ দিতো না। কখনো টিউশনি করে, কখনো সেলাইয়ের কাজ করে নিজের খরচ চালিয়েছি। বাড়িতে ও তার মধ্যে থেকে কিছু খরচ দিয়েছি। এভাবেই আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করেছি।

এখন আমি অনেক ভালো একটা সরকারি চাকরি করছি। মা বাবার জন্য সুন্দর একটা বাড়ি বানিয়েছি। আমি যেদিন চাকরি টা পাই বাবা সেদিন খুব কান্না করেছিলো। আর বলছিলো আমাকে ক্ষমা করে দেন রে মা।আমি অনেক বড় পাপ করেছি। তোকে অনেক কথা শুনিয়েছি। আমি বাবাকে বলেছিলাম বাবা আজ থেকে আমাদের কান্নার দিন শেষ। আমি যে প্রমাণ করতে পেরেছি যে আমি অভিশাপ নই, আর তুমি ও সেটা বুঝতে পেরেছো এটাই তো অনেক বড় পাওয়া।

আর আমার যে চাচাতো ভাই টা ছিলো অনেক সুন্দর দেখতে সে আমার চাচাচাচিকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাই আমি ওদের নিয়ে এসে আমার বাড়িতে রেখেছি।তারা এখন আমাদের সাথে থাকে। পাড়ার লোকেরা যারা আমাকে নিয়ে মজা করতো তারা এখন তাদের সন্তানদের শিক্ষা দেয় যে বড় হয়ে তারা যেন আমার মতো হয়।

এখন আমাকে অনেক পয়সাওয়ালা সুদর্শন যুবক বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে, কিন্তু আমি তো তাদের বিয়ে করবোনা। আমি বিয়ে করব আমার মতো কালো কুচকুচে ছেলে কে। আর আমি ও জন্ম দেবো কালো সন্তান যে আবার আমার মতো প্রমাণ করবে যে সে কারো পাপের শাস্তি নয়, সেও আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা জীব। সেও প্রমাণ করবে, মানুষের পরিচয় তার কর্মে, তার চেহারায় নয়।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত