চক্রবাক

চক্রবাক

সকালে ঘুম থেকে উঠে ই শুনলাম আজ আমার বিয়ে! প্রথমে স্বপ্ন ভাব ছিলাম। কিন্তু নিজের হাতে নিজে চিমটি কেটে শিওর হলাম এটা স্বপ্ন নয়। যা শুনছি তা সত্য আর বাস্তব। আমাকে পার্লারে নিয়ে যাওয়া হবে তাই তাড়াতারি গোসল করার জন্য বলা হচ্ছে। আমার ঘোর এদিকে কাটছে না। বিয়ে খেতে এসে এখন নিজের ই বিয়ে !

যা শুনলাম, গতকাল গভীর রাতে আমার ফুপা তো ভাইয়ের হবু বউ পালিয়ে গেছে অন্য একজনের সাথে। তাতে এখানে আমাকে কেন পাঠার বলি দেওয়া হচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমার বড় আপুর বিয়ে ঠিক এরপরে ই আমি কিন্তু এখানে আমার কোনো মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না কেউ। সবসময় বাবা এরকম করেন। একটু ভারী রাশ গম্ভীর স্বভাবের লোক। যা বলেন তাই হয়। বাবা ফুফু আর ফুপার সম্মান রক্ষার্থে এমন সিদ্ধান্ত। তায়েফ ভাইয়াকে অপছন্দ করার মত তেমন কিছু নেই। কিন্তু কখনো যা ভাবিনি এমন কিছু হতে চলেছে ।

মাকে বললে, মা বলেন সব ঠিক হয়ে যাবে। যা হয় ভালোর জন্য হয় মায়ের এক কথা এটা। এখানে তায়েফ ভাইয়ারও কি মত আছে মনে প্রশ্ন জাগল। ঠিক তখনি ভাবি এসে বললেন তায়েফ ভাইয়া আমাকে ডাকছেন। সকালে এসব শুনার পর এখন কেন জানি তায়েফ ভাইয়ার সামনে যেতে অস্বস্তি লাগছে। ভাবিকে বললাম আমার সাথে যেতে কিন্তু উনি মানা করে দিলেন।

এমন হুট করে এসবের জন্য হয়ত তায়েফ ভাইয়া আমাকে কিছু বলতে চাইছেন। হ্যা এটাই তো স্বাভাবিক এরকম পরিস্থিতি কথা বলার প্রয়োজন তো থাকতে ই পারে। কিছুটা অস্বস্তি কাটিয়ে জড়তা নিয়ে গেলাম তায়েফ ভাইয়ার সামনে। তিনি যা বললেন তাতে আমি আরো অবাক হলাম। বুঝতে পারছিলাম না কি বলব।

আমাকে নাকি বলতে হবে আমার প্রেমিক আছে, আমি অন্যকাউকে পছন্দ করি। এই বিয়ে তে না করতে। কিন্তু সত্যি বলতে আমার এমন কিছু নেই। ভাইয়ার কথা শুনে এভাবে মিথ্যে বলতে হবে ভেবে শিউরে উঠলাম। আমি বললাম, আমি সবাইকে বলব আমার এই বিয়েতে মত নেই তাহলে হবে। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া বিয়েতে মত না থাকার কি আছে সেটার উত্তর কি দিব।

ভাইয়া কে বললাম, তুমি বল তুমি এ বিয়ে করতে পারবে না তোমার কথা সবাই মানবে। নাহ, ভাইয়া নাকি একটা মেয়েকে পছন্দ করে সেটা সে বাসায় জানিয়েও ছিল কিন্তু মেয়ে টাকে ফুপু ফুপার মোটেও পছন্দ না। আর বড় কথা বল বাবার শেষ কথা এটাই সেখানে তায়েফ ভাইয়ার কোনো কথায় কাজ হবে না। তায়েফ ভাইয়া বললেন, ভাগ্য হয়ত সহায় আমার না হলে বিয়ের আগের দিন মেয়েটি পালিয়ে যাবে কেন ! তুই না করে দিলে ই আর কোনো উপায় থাকবে না মা বাবার আমি আমার পছন্দের মানুষটাকে বিয়ে করতে পারব।

তায়েফ ভাইয়ার কথা শুনে খানিকা থমকে গেলাম। যা করিনি তা বলতে হবে। তার চেয়ে বড় কথা হল যে আমাকে চাইছে না এভাবে বলছে তার কাছে আমি কেন যাব সবার কথায়। আমার মন সেটাই সায় দিল কারণ দুজন পছন্দের মানুষ একে অপরকে চাইছে আর প্রকৃতি কোথায় যেন সেই সুযোগ দিয়ে অদৃশ্য ভাবে সাহায্য করছে তাহলে আমি মাঝখানে থাকব কেন শুধু শুধু। আর কোনো কিছু না ভেবে তায়েফ ভাইয়ার কথায় রাজি হয়ে গেলাম।

রুম থেকে বের হয়ে ই বাবার সামনে গেলাম সেখানে মোটামুটি পরিবারের বড়রা সবাই আছেন। বলে দিলাম, আমি এ বিয়ে করতে পারব না। আমি অন্য কাউকে পছন্দ করি। বাবা একথা শুনে রেগে একদম আগুন। একথা বলে ই ছাদে চলে গেলাম যাওয়ার সময় বলে গেলাম আমাকে জোড় করলে ছাদ থেকে লাফ দিব। ছাদের দরজা লাগিয়ে বসে ছিলাম সারা দিন। ফুপু ফুপা অন্য কোনো উপায় না দেখে মান সম্মান রক্ষার্থে ভাইয়ার পছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিলেন কারণ সবকিছু রেডি মেহমানরা সব আসতে শুরু করবে একটু পর।

ভালো লাগছিল যাক ভাইয়া তার পছন্দের মানুষটাকে কাছে পেয়েছে। আমি সারা দিন ছাদে ছিলাম বিকালে নামলাম। এমন করার জন্য আমাকে কম কথা শুনতে হয়নি। বাবা জানতে চাইলেন ছেলেটি কে যাকে আমি পছন্দ করি। কি বলব না বলব বুঝে উঠতে পারছি না কারণ এমন কারো অস্তিত্ব তো নেই। তারপরও সাহস করে বললাম পরে বলব। যাকে পছন্দ করি সে উপযুক্ত হয়ে আসবে। মিথ্যে বললাম।

বাবা অনেক দিন রাগ করে আমার সাথে কথা বলেননি। আমি আমার মত চলছিলাম পড়াশোনা কলেজ বেশ। মাঝে শুনতাম তায়েফ ভাইয়া আর ভাবির মধ্যে নাকি প্রচন্ড ঝগড়া হয়। হতে ই পারে স্বামী স্ত্রী। আট নয় মাস পর একদিন কলেজ থেকে এসে শুনলাম ভাবি মানে তায়েফ ভাইয়ার বউ সব টাকা পয়সা গয়নাগাটি নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কথাটা শুনে আমি পুরো শক্ড।

ভাবির নাকি অন্যকারো সাথে সম্পর্ক চলছে আর এসব নিয়ে ই নাকি তাদের মাঝে সমস্যা হচ্ছিল তায়েফ ভাইয়া নাকি সেটা আন্দাজ করতে পেরেছে অবশেষে এই বিপত্তি। ফুপু ফুপা তখনো বলছিল উনারা খবর নিয়ে জেনে ছিলেন মেয়েটা ভালো না কিন্তু উনি প্রেমে অন্ধ শেষ সময়ে যা হয়েছে তাতে মেয়ে টিকে ঘরে আনতে ই হয়েছে। আরো জানা গেল মেয়েটি আগে আরো ২ টা বিয়ে করেছে এভাবে। সবকিছু শুনে যেন আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না মানুষ মানুষকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারে। সব এক না কিন্তু কিছু এমন মেয়ের কারণে সবাই সব মেয়ের দিকে আঙুল তুলে।

কিন্তু কেন এমন হল। প্রকৃতি নিয়ম সবকিছু ই তো তাদের অনুকূলে ছিল তাহলে নিয়তি কেন এভাবে খেলা করল তায়েফ ভাইয়ার সাথে ! কোথায় যেন খারাপ লাগছিল এসব ভেবে। তায়েফ ভাইয়াও এখন মাথা নিচু করে হাটে কারো সাথে কথা বলে না। শুধু কাজ করে আর একা একা বসে থাকে। ফুপুর বাসায় গেলে আমার এসব দেখে কেন জানি খারাপ লাগত ফুপু তার একমাত্র ছেলের এসব দেখে কান্না যেন নিত্য সঙ্গি হয়ে গিয়েছিল উনার। আমি দেখে ছিলাম চোখের সামনে কিভাবে ভালোবাসার মানুষ হারিয়ে গেলে মানুষ নিশ্বেষ হয়ে যায়। মেয়েটা না তায়েফ ভাইয়া তো ভালোবেসে ছিল মন থেকে। এসব দেখে আমারো কেমন জানি লাগছিল।

অনার্স ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হতে ই খুব ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে বাবা আমাকে ডেকে বলেন এসব। জানতে চান আমি যার কথা বলেছি সে কোথায়। তখন আর মিথ্যে না বলে সত্যটা বলে দিলাম আমার এমন কেউ নেই কিন্তু আমি এই বিয়েও করতে পারব না। বাবা এসব শুনে ধমক দিয়ে আমার পাগলামি কথাবার্তার লাগাম দিতে বললেন। আমি তখনি বলে দিলাম, আমি তায়েফ ভাইয়াকে বিয়ে করতে চাই। সবাই সেটা শুনে অবাক। কারণ সেটা তো ১ম এ ই হওয়ার কথা ছিল। আমি সবকিছু না ভেঙে শুধু বললাম আমি বিয়ে করলে তায়েফ কে ই করব।

ফুপু এ কথা শুনে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছেন কিন্তু তায়েফ ভাইয়া না করে দিল সে করবে না। আমাকে তার অন্ধকার জীবনে টেনে আনতে চায় না সে। কিন্তু এত দিনে এই মানুষটাকে কেন জানি আমি ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তার বাধার উপেক্ষা করে আমি রাজি। যেহেতু পারিবারিক আত্মীয় আর উনাদের অবস্থায়ও ভালো ভাইয়াও সবার পছন্দের তাই বাবা আর না করলেন না শেষ পর্যন্ত। আজ আমাদের ২য় বিবাহ বার্ষিকী গলায় একটা চেইন পড়িয়ে দিয়ে তায়েফ বলল এটাই হয়তো নিয়তি তে লিখন ছিল।

একদম প্রথমে যার জন্য এত কিছু হয়েছিল কিন্তু মানুষের ভুল চিন্তা চেতনা তা অন্যপথে নিয়ে গেল। সৃষ্টিকর্তা হয়ত চেয়ে ছিলেন ঐ সময় আমাদের মিল টা হোক কিন্তু না আমরা অন্যকিছু করলাম অন্যতা ভেবে। সত্যি যা লেখা থাকে তা কেউ মুছতে পারবে না শুধু মানুষ তার ভুল সিদ্ধান্তের শাস্তি ভোগ করবে কিছু কাল আর কিছু না। মানুষের সিদ্ধান্ত কতটা ভুল তা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য এমন করেন সৃষ্টিকর্তা কিন্তু ঐ উপরওয়ালা যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন তা হবে ই। হ্যা, এখন আমরা একে অপরে অনেক ভালোবাসি আর আমি জানি তায়েফ আমাকে ছেড়ে কখনো দূরে যাবে না কারণ সে বুঝে একসময়ে প্রিয়জন চলে যাওয়ার ব্যথা কতটুকু । আর এখানে ই আমার ভরসা ভালোবাসা আর বিশ্বাস নিহিত আর তারও।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত