জীবনের রংধনু

জীবনের রংধনু

টিভি দেখছিলাম৷ মিতু উড়ে এসে বলল, ডালে লবণ হয়নি৷ বললেনা কেন?” আমি মুচকি হেসে বললাম, বুঝতে পারিনি তো৷ তোমার হাতে জাদু আছে বুঝলে মেয়ে!” ক’বার বলবো এসব ন্যাকামো আমার সামনে করবেনা৷ যত্তসব৷” হনহন করে রুম ছাড়লো মিতু৷” গত পরশু বলেছিলাম, মাংসে ঝালটা বেশি হয়ে গেল মিতু৷” মিতু ভ্রু কুচকে ৫মিনিট তাকিয়ে থেকে বলল, নিজেতো চা বানাতে গেলেই তালগোল পাকিয়ে চা অর বদলে শরবত বানিয়ে ফেলো৷ তাতে কিছু হয় না?” আমি আরেক লোকমা ভাত গালে তুলে হেসে বললাম, ঝাল আমার ভালোই লাগে৷ পেট খারাপ না হলেই হলো৷”

যেদিন বিকেলে বাসায় থাকি৷ মিতুকে বলি, শাড়ি পরোতো৷ বেগুনি রঙা শাড়িটা পড়ো৷ ঘুরতে যাবো৷” মিতু মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, বুড়ো বয়সে ভীমরতি হয়েছে?” আমি হাতের চামড়া আর মুখের চামড়া টেনে বলি, কই চামড়া কুচকেছে? চুলে হাত বুলিয়ে বলি, সাদা হয়নি তো৷” মিতু আবার বিরক্ত হয়৷ “আমার ইচ্ছে নেই৷ সেটা বুঝো না তুমি?” পূর্ণিমার রাতে বেলকণিতে চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ে৷ আমার ঘুম ধরে না৷ মিতু ওপাশ ফিরে ঘুমোয়৷ আমি ডাকবো না ডাকবো করেও ডেকে ফেলি৷ মিতু দাঁত কিড়মিড় করে বলে, তোমার আর কাজ কি? সকাল ১০টায় উঠলেও চলবে৷ আমার অনেক কাজ৷ ৬টা থেকে খাটা লাগে আমার৷ নয়তো গিলতে পারবেনা৷”

সকালে ঘুম ভাঙতেই রান্না ঘরের দিকে পা বাড়াই আমি৷ মিতু রান্নায় ব্যস্ত৷ ফর্সা গালটায় ঘাম চিকচিক করছে৷ আমি হাত বাড়িয়ে মুছে দিয়ে বলি, এত চিল্লাচিল্লি করো কেন? ভেজা চুলের পানি চিটিয়ে ঘুম ভাঙাতে পারো না!” ভাবসাব দেখে মনে হয়,কানে নেয়নি কথা৷ আজকাল মেয়েটা কীছুই কানে নেয়না৷ আমিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি৷ ” এইতো কদিন আগেও তরকারির ঝাল বেশি কিংবা লবণ কম হলেও আমি চুপচাপ খেতাম৷ মিতু যখন মুখে দিয়ে ব্যাপারটা বুঝতো৷ সারারাত কেঁদে ভাসাতো৷ আমার সাথে মিছে অভিমান দেখিয়ে বলতো, বললেনা কেন? বেশি ন্যাকা হয়েছো না?”

টিভির রিমোর্টটা ড্রয়ারে রেখে বলতো, তুমি শুধু আমাকে দেখবা৷ আমার খবর শুনবা৷ টিভির খবর শুনে তোমার কাজ নেই৷ ছুটির দিনের বিকেল হলে বেগুনি রঙা শাড়ি পরে বলতো, আসো আজ আমরা প্রেমিক-প্রেমিকা হয়ে শহরের এপাশ থেকে ওপাশে হেঁটে বেড়াবো৷ তুমি একটুও রোমান্টিক না৷ এতো ক্ষ্যাত ক্যান তুমি? এরকম ক্ষ্যাতই থাকবা বুঝলে৷ স্মার্ট হওয়ার দরকার নেই৷”

আব্বা-আম্মার সাথে যেবার মিতুকে প্রথম পাত্রী হিসেবে দেখতে গিয়েছিলাম৷ মোলায়েম চেহারার মেয়েটাকে দেখামাত্রই ভালো লেগে গিয়েছিল একদম৷ আলাদা কথা বলতে পাঠালো৷ আমি নাহু নাহু করেও বলে ফেললাম, হাসলে আপনাকে ভালো দেখাবে আরো৷” মিতু হেসেছিল৷ দেখেছেন সত্যিই ভালো দেখাচ্ছে৷ ছবি তোলা যাক৷” মিতু বাঁধা দেয়৷ আমি জোর করি না৷”

-আচ্ছা আপনার প্রিয় দিন আছে?
-আমার সব দিনই প্রিয়৷” জবাব দেয় মিতু৷
-তবুও থাকে তো বিশেষ প্রিয় কিছু৷ কিংবা অপ্রিয় থাকলেও বলতে পারেন৷”
-আমার কাছে প্রতিটা মূহূর্তই প্রিয়৷ আমার প্রিয় প্রত্যেকটা শ্বাস প্রশ্বাস৷”

মুগ্ধ হই আমি৷ নীরবতা ভর করে৷ “দেখেছেন গালের এপাশটা?” নীরবতা ভেঙে বলল মিতু৷ গালের বামপাশটা চুলে ডেকে রেখেছিল মেয়েটা৷ আমি ভালোভাবে খেয়াল করি৷ গালে কালসিটে দাগ পড়েছে৷ আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে৷ এই কেঁপে উঠাঠার উৎপত্তি কেন হয়েছিল আমার জানা নেই৷ আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম৷ মিতু মুচকি হেসে ছাদের রেলিংয়ে হাত ভর দিয়ে দূরের আকাশটায় তাকায়৷” দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, জানেন দু’চারটা চড় আমার প্রতিদিনের রুটিনের মধ্যে থাকে৷ আমার প্রতিবাদ করা হয়ে উঠে না৷ যখন বুঝতে পারি, আমার চড় খেতেই হবে৷ গালের এপাশটা আমি হাত দিয়ে আড়াল করি৷ ”

আমি জীবনের প্রতিটা মূহূর্ত জোর করে ভালো থাকি৷ আমি অতীত মনে রাখি না৷ আজ ফেলে আসা সকালটাও না৷ সকালবেলা হজম করা চড়টাও না৷ অতীত বলতে শুধু আমার মায়ের মুখটা মনে রেখেছি৷ মা আমাকে বলেছিল, আমি এতোদিন ভাবতাম, মরে গেলে ফুরিয়ে যাবো৷ দুনিয়ার রং আমার বিষাধ লাগতে শুরু করেছে৷ অর্থহীন মনে হতো নিজেকে৷” কিন্তু যেদিন ডাক্তার বলল, আপনি আর ক’টা দিন বাঁচবেন৷” তারপর থেকে কি যেন হলো৷ আমার দুনিয়ার সবকিছু রঙিন মনে হচ্ছে মা৷

ইচ্ছে করছে, যুগ যুগান্তর বেঁচে থাকি৷ আমি প্রতিরাতে মনে মনে বলি, আল্লাহ আর ক’টা দিন বাঁচতে দাও৷” আমার চারপাশটা যখন বিষাদে ভরে যায়৷ আমি তখন মায়ের সেই গলা ধরে আসা কথাগুলোর কথাগুলো অনুভব করি৷ দুঃখগুলো আমার আর দুঃখ মনে হয় না৷” আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিতু৷” “জানেন মিতু, আমাদের জীবনটা রংধনুর মতো৷ রংধনুর যেমন ভিন্ন কয়েকটা রঙ থাকে৷ আমাদের জীবনেরও তেমন রং আছে৷ একেক সময় একেক রং ভর করে আমাদের মনে৷ সেই রং নিয়ে বেঁচে থাকা৷” “কথা বলে ভালো লাগলো৷ ভালো থাকবেন৷ আমি জানি, আপনার সাথে আমার বিয়ে হবে না৷” মলিন হেসে বলল মিতু৷

-কেন?
-ক’বছর ধরে এমনই চলছে৷ পাত্র পক্ষ আসে,যায়৷

আমাকে পছন্দ হলেও তাদের দাবী মিটে না৷ খালু তো সেদিন বলল, দাবী মেনে বিয়ে দিবে না৷ দরকারে চিরকুমারী রাখবে৷ বলুন, আপনাদের দাবীটা শুনি?” “আমি অতো বেহায়া না মিতু৷ দাবীর কথা আপনার চোখে চোখ রেখে বলবো৷” চলুন নিচে যাওয়া যাক৷ “মিতুর খালু যখন বলল, দাবী দাওয়া কিছু আছে?” আব্বা পান মুখে দিয়ে বলেছিল, আমার মেয়ে নেই৷ মেয়েটায় আমাদের দাবী৷” আমি পর্দার আড়ালে দাঁড়ানো মিতুকে দেখি৷ মুখের বিষন্নতার ছাপটা গায়েব হয়েছে৷ ভর করেছে লজ্জা৷”

আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর ৫ এর মতো৷ বাচ্চা হয়নি৷ পরিবার থেকে শুরু করে আত্মীয়৷ সবাই হতাশ৷ বাইরে বাচ্চা দেখলেই আমি মিতুর দিকে তাকাই৷ চোখেমুখে “মা”ডাক শোনার কি আকুলতা৷ অথচ এই মেয়েটা কোনোদিন মা হতে পারবেনা৷ সেটা জানতোনা মেয়েটা৷ ক’দিন হলো জেনেছে৷ মিতুর পাল্টে যাওয়ার কারণ আমি খুব বুঝি৷ মিতু চায় আমি বিরক্ত হই৷ আমার বিরক্তি আসে না৷ মিতুর প্রতি জন্মানো অনুভূতিগুলো দিনের পর দিন ঘনীভূত হচ্ছে আরো৷” ফোনটা বাজছে৷ রকিবের ফোন৷ ছেলেটা আমার কলিগ৷ একটা বাচ্চা মেয়ে আছে বছর দেড়েকের৷ দিনকয়েক ধরে রকিব অসুস্থ৷ আমি বলেছি ডাক্তার দেখাতে৷ ছেলেটার সবকিছুতেই অবহেলা৷ আমি যখন মিতুর রান্না করাটা দুপুরের খাবারটা অফিসে বসে খাই৷ ছেলেটা তখন সিগারেট পোড়ায়৷ আমি রাগ দেখায়৷ ছেলেটা হেসে বলে, আমার বাঁচতে ইচ্ছে করে না ভাই৷ কার জন্য বাঁচবো বলুনতো?”

আমি তার ছোট্ট মেয়েটার কথা স্মরণ করিয়ে দেই৷ রকিব সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বলে, মেয়েটার দিকে আমি তাকাতে পারিনা ভাই৷ রুমির কথা মনে পড়ে আমার৷ মানুষ এত নিষ্ঠুর কেন বলুনতো?” আমি রকিবের কথার প্রত্যুত্তর দেই না৷ আমি ভাবি, রুমি মেয়েটার কথা, মিতুর কথা৷ রুমি মেয়েটাকে রকিব ভালোবেসে বিয়ে করেছিল৷ বাচ্চা ও হলো৷” ভালোবাসার মানুষ কিংবা বাচ্চা মেয়েটার আদর ভরা চেহারা৷ কিছুর পরোয়া না করেই মেয়েটা পরপুরুষের হাত ধরে পালালো!” অথচ মিতু কিংবা কতশত রমণী৷ একটা বার “মা” শোনার জন্য তাদের চোখে মুখে লেগে থাকে কত আকুলতা৷” আমি দীর্ঘঃশ্বাস ফেলি৷ রকিবকে বলি, আমাকে একটা দে৷ টানি৷” হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে রকিব৷ কাছে যেতেই বুঝলাম, চোখের কোণে জল জমেছে ছেলেটার৷

আমি পাশে বসতেই হাতটা জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে দিল ছেলেটা৷ এর আগে কখনো কাঁদতে দেখিনি আমি৷”
জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, ভাই আমি আর বেশিদিন নেই৷” আমি রকিবের কাঁধ চাপড়ে বলি, তোর ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে তাহলে৷” রকিব কাঁদছে, জানেন, এই কথাটা শোনার পর থেকেই আমার মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রাখার ইচ্ছে হচ্ছে৷ ইচ্ছে করছে, লেপ্টে রাখি৷” আমি কিছু বলিনা৷ চোখের জল লুকোই৷ মিছে শান্তনা দেয়া হয়না আমার৷” খুব সাবধানে কলিংবেল বাজালাম৷ কোলে রাখা মেয়েটা একটু কেঁপে উঠলো৷ আমি পরম মায়ায় হাত বুলোই৷” দরজা খুলে অবাক হয় মিতু৷ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় আমার দিকে৷ আমি বাচ্চাটার মোলায়েম চেহারায় হাত বুলিয়ে বললাম, “তোমার মা ডাক শোনার আকুলতা, আর বাচ্চাটার “মা” বলে ডাকার আকুলতা৷” বছর পাঁচেক পর৷ “শুনো, খাবারে ঝাল কম হয়েছে৷”

-কমই খাও৷ বেশি হলে আমার মেয়ের সমস্যা৷” “লবণ কম হয়েছে৷”
-কমই খাও আমার মেয়ের সমস্যা৷”

-শুনো, বেগুনী রঙা শাড়িটা পুরনো হয়েছে৷ আসার সময় দু’টো নিয়ে এসো৷”
-দু’টো?”
-একটা বড় আরেকটা ছোট৷ আমার মেয়ে শাড়ি পড়বে৷”

সকালের ঘুমটা চুলে জমে থাকা পানির ছিটকে দিয়েই ভাঙে৷ মিতু আমার ঘুম ভাঙাতে ভাঙাতে ক্লান্ত৷ এখন মেয়ের চুল বড় করে তাকেও সাথে নিয়েছে৷ যদিও মেয়ের একটু অাপত্তী৷ মা সরে যেতেই মেয়ে আমার কপালে চুমু দিয়ে কানে কানে বলে, বেশি ঘুমালে শরীর নষ্ট হবে৷” আমি মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বুকের সাথে লেপ্টে রাখি৷ চোখ বন্ধ করে মায়া অনুভব করি৷ মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেই আমার পরম শান্তি লাগে৷ রকিব ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞতা পুষি মনে৷ আমি অনুভব করি, জীবনটা আসলে একটা রংধনু৷ যার অনেকগুলো রং রয়েছে৷”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত