সবজী বিক্রেতা

সবজী বিক্রেতা

রাতে খাবার খেতে বসে আব্বা তার স্বভাবসুলভ বক্তৃতা দিতে লাগলেন – তোমাকে বিয়ের জন্য যতো পাত্রই দেখানো হয়েছে তুমি তাদের সবার একটা করে সমস্যা এনে হাজির করে রিজেক্ট করেছো ; এইগুলা নিয়া আমি এর আগে তোমাকে অনেক বুঝিয়েছি – তুমি কি বুঝেছো আমি জানি না তবে আমার যেটা বোঝার আমি বুঝে ফেলেছি আর তাই আজ আমি একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি – আগামীকাল সকালে আমি মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পরে – এক ঘন্টা হাঁটাহাঁটি শেষ করে – বাসায় এসে চা নাস্তা খেয়ে এরপর বাসার মেইন গেইট খুলে যাকে প্রথম দেখবো বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছে তার সাথেই তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো। আম্মা সাথে সাথেই আব্বাকে কে বললেন – এটা আবার কেমন সিদ্ধান্ত!

আব্বা আম্মাকে বললেন – তোমার মেয়েকে এভাবে হুট করে বিয়ে না দিলে জীবনেও বিয়ে করবে বলে আমার মনে হয় না।

আম্মা বললো – তাই বলে দরজা খুলে যাকে দেখবে তার কাছেই মেয়ে দিবে! হতে পারে দরজা খুলে দেখলে কোনো সবজী বিক্রেতা সামনে দিয়ে যাচ্ছে বা কোনো রিকশাওয়ালা যাচ্ছে তাদের একজনকে ডেকে এনে বিয়ে দিবে মেয়েকে?

আব্বা বললো – হতে পারে কিন্তু শর্ত একটাই শুধু জানতে চাইবো তারা আগে থেকেই বিবাহিত কিনা!
যদি বিবাহিত হয় তাহলে দ্বিতীয়জন , তৃতীয়জনকে দেখার উপর ভিত্তি করে মেয়ের জামাই সিলেক্ট করা হবে।

আমি আব্বার সিদ্ধান্ত শুনে আহত হবার চেয়ে অনেক বেশি খুশিই হয়েছিলাম – তাই খুশির ঠ্যালায় বলেই ফেললাম – আব্বা তোমার সিদ্ধান্তে আমার পূর্ণ সমর্থন রইলো। আমার কথা শুনে আব্বার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। আম্মা টেবিল থেকে ভাতের বাটিতে আরো ভাত নিয়ে আসার জন্য কিচেনে যেতে যেতে বললেন – যেমন বাপ তেমন মেয়ে – দুই পাগল নিয়া আমার সংসার। খাওয়া শেষ করে রুমে এসেই জোভানকে কল দিলাম – ওপাশ থেকে জোভান বললো – বাবু – ভাত খাওয়া শেষ হয়েছে?

– হুম ভাত খাওয়া শেষ হয়েছে এখন ডেজার্ট হিসেবে তোমার হাড্ডিগুড্ডি চিনির সিরাতে ভিজিয়ে রেখে খাবো।
– কি হলো জান! এতো রেগে আছো কেন?

– আব্বা বিয়ে ঠিক করে ফেলছে – কাল সকালে আমার বিয়ে ; দাওয়াতের কোনো ব্যবস্থা নাই তাই দাওয়াত দিতে পারলাম না।

– কি বলছো তুমি এসব আবোল তাবোল!

আমি আব্বা’র সিদ্ধান্তের ব্যাপারটা জোভানকে জানালাম ; জোভান বললো – তাহলে এখন কি করবো? চলো আজ রাতে আমরা দু’জনে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি!

– বাহ! দারুণ – পালিয়ে যদি বিয়ে করতাম তবে এতো কষ্ট করে এতগুলো পাত্রের নেগেটিভ দিকগুলো কেন খুঁজলাম আমরা দু’জনে মিলে! আব্বা – আম্মাকে ফাঁকি দিয়ে প্রেম করছি এটাই বেশি হয়ে গেছে – কিন্তু উনাদের ফাঁকি দিয়ে বিয়ে আমি কোনোদিন করবো না।

– সে সব তো জানি কিন্ত এখন তো আমাদের কাছে পালিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো পথ নাই!

– এমন একটা বোকার সাথে আমি কেমনে চার বছর ধরে প্রেম করলাম! ওরে বোকা – এখন আরো সহজ পথ হয়েছে আমাদের বিয়ে করার ; আগামীকাল সকালে তুমি সবজি বিক্রেতা হয়ে আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবা ; দেখো – আবার খুব ভোরে এসে হাজির হয়ো না – সকাল সাতটার সময় দাঁড়িয়ে থাকবা।

– রাতারাতি মানুষ কোটিপতি হতে পারে আবার কোটিপতি নিঃস্ব হতে পারে কিন্ত আমার মতো বেকার একটা ছেলে রাতারাতি সবজী বিক্রেতা কিভাবে হতে পারে? গ্রামে হলে তাও মানুষের ক্ষেতের সবজী রাতে চুরি করে সবজী বিক্রেতা হতে পারতাম! কিন্তু এই ঢাকা শহরে এতো রাতে সবজী কোথায় পাবো?যে কয়জন ছাদ কৃষি করেন তারা সবাই গেইটে তালা দিয়া ঘুমায়! সেখানে সবজি চুরি করা অসম্ভব!

– লম্বা ছেলেদের বুদ্ধি যে হাঁটুতে থাকে – তোমার সাথে প্রেম না করলে আমি শিওর হতে পারতাম না! কত সবজী বিক্রেতারা সকালে সবজীর ভ্যান নিয়া ঘোরে তাদের কাছ থেকে একটা সবজী ভ্যান ভাড়া নিবা আর লুঙ্গি গামছা পরে আমার বাসার গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবা। কিন্তু সমস্যা হলো – তোমার ফর্সা গায়ের রঙ! ছেলেরা ফর্সা হওয়াটা একেবারেই ঠিক না ; আমি নিজেই বুঝি না – এমন মেয়েদের মতো ফর্সা ছেলের প্রেমে আমি কেমনে পড়লাম ; এখন ঝামেলা আর ঝামেলা!

– বাবু – আবার এখানে তুমি আমার ফর্সা গায়ের রঙ নিয়ে আসছো?

– রাস্তায় ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে সবজী বিক্রি করা সব মামারা একসময় যতোই ফর্সা থাকুক না কেন সূর্যের প্রখর তাপে তাদের সেই ফর্সা রঙ তামাটে হয়ে যায়। তাই তুমি সেই অর্থে একটা সবজী বিক্রেতাও হইতে পারলা না!
– আচ্ছা কালি দিয়া কিছুটা কালো হয়ে যাবো; কি বলো জান?
– হুম এটা ভালো বলছো! তবে ঠিক সাতটায় একদম পুরা সবজী বিক্রেতার লুকে ভ্যানে কইরা সবজী নিয়া দাঁড়াইয়া থাকবা। আচ্ছ এখন রাখছি ; কাল আবার খুব সকালে উঠতে হবে ; বাই।
– বাই।

সকালে ঘুম থেকে উঠেই অপেক্ষা করছি কখন সাতটা বাজবে! জোভানের সাথে একটু পর পর কথা বলছি ; মেসেঞ্জারে ছবি পাঠালো জোভান সবজী বিক্রেতা সেজে – একেবারে চেনাই যাচ্ছে না। সকালে আব্বা – আম্মা’র সাথে নাস্তা করতে বসেছি – আব্বা বললো – তোমাদের মনে আছে তো! এখন নাস্তা শেষ হলেই পাত্র সিলেক্ট করে কাজী ডেকে এনে বিয়ে। আম্মা মুখ গোমড়া করে বললো – আমি তোমাদের বাপ মেয়ের পাগলামিতে নাই ; এসব নিয়া আমাকে কিছু বলবে না। আব্বা বললো – মেয়ের মা হিসেবে বিয়েতে তোমার থাকা আবশ্যক ; তারপরেও তোমার আপত্তি থাকলে – জোর করবো না – আমি একাই করে নিবো সব।

– আমার কোন কথাটা তুমি এতো বছরে শুনেছো? আম্মা বললো।
– আহা! আজ একটা শুভ দিন ; এগুলো বলে দিনটা নষ্ট করোনা ;

আম্মা রেগে বলতে থাকে – সব পাগল পাবনার হেমায়েতপুরে থাকে না ; একজন ঢাকার উত্তরার এই বাসাতেও থাকে!
আমি বললাম – আম্মা রাগ করছো কেন? আমার তো কোনো আপত্তি নেই। আব্বা বললেন – তোমারও যদি তোমার আম্মার মতো ঘোর আপত্তি থাকতো তবুও আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে একচুল নড়তাম না! জ্বি আব্বা – খুব ভালো সিদ্ধান্ত! আমি বললাম।

আব্বা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন সাতটা বেজে যাচ্ছে আমি নিচে গেলাম – তোমরা দু’জন সাথে আসতে পারে – আমি ফার্স্ট আম্পায়ার ; তুমি সেকেন্ড আম্পায়ার আর তোমার আম্মা থার্ড আম্পায়ার – শিওর হবার জন্য যে কে প্রথম আমাদের গেইটের সামনে দিয়ে যাচ্ছে – এজন্য তোমাদের এভাবে আম্পায়ার উপাধি দিয়েছি।
আম্মা বললো – আমি যাবো না! আমি আর আব্বা শুধু গেলাম – গেইট খুলে আব্বা আর আমি দু’জনেই চমকে উঠলাম! দুইজন সবজী বিক্রেতা আমাদের গেইটের সামনে ভ্যান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আব্বা আর আমি একজন অন্যজনের দিকে তাকালাম! তখন পিছন থেকে আম্মা বললো – এখন কি হবে?

আব্বা বললো – টেনশন করছো কেন – তারা কি জানে আমাদের কি প্ল্যান! আচ্ছা আগে কথা বলি ; আব্বা অরিজিনাল সবজী বিক্রেতাকে ডাক দিলেন – বললেন – বিয়ে করেছো? লোকটা বেশ সহজভাবে বললো – না। এখনো করি নাই। এরপর আব্বা জোভানকে ডাক দিলেন – বললেন – বিয়ে করেছো? জোভান বললো – না। আব্বা বললেন তোমরা দু’জন ভ্যান নিয়ে আমার বাড়ির গেইটের ভিতরে রাখো – এরপর বাসার ভিতরে আসো – কথা আছে। জোভান আমার দিকে তাকালো কিন্তু আমি অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলাম ; ইচ্ছে হলো – এই গাধাটারে বলি – ওই সবজী বিক্রেতাকে বুঝিয়ে কিছু সময়ের জন্য সরে যেতে বললে তো এখন এই ঝামেলাটা হতো না! কিন্ত বলার কোনো চান্স নাই!

দুই সবজী বিক্রেতা আমাদের সোফাতে বসে আছে পাশাপাশি ; আব্বা দুইজনের সামনের সোফাতে বসে আছে আর আমি আব্বার পিছনে দাঁড়িয়ে আছি ; আম্মা পাশের রুমের পর্দা কিছুটা সরিয়ে দেখছেন। আব্বা বললেন – রুবেল তোমাকে এতো করে বুঝিয়ে বলার পরেও তুমি একা সবজী বিক্রেতা সেজে আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে না ; তুমি এখানে ফেইল করেছো তাই বিয়েটা আমি অরিজিনাল সবজী বিক্রেতার সাথে দিবো। আম্মা ভিতর থেকে এসে বললেন – এগুলো সব তোমার প্ল্যান ছিলো! এই রুবেল নামের সবজী বিক্রেতাকে তুমি চিনো?

আব্বা বলেন – হুম রুবেল আমার বন্ধু ইদ্রিসের ভাইয়ের ছেলে ; আইটি ইঞ্জিনিয়ার – আমার আইডিয়াতে রুবেল কে আমি সবজী বিক্রেতা সাজতে বলেছিলাম কিন্তু সে ফেইল। এমন সময় রুবেল বলে উঠলো – কিন্তু আংকেল এই সবজীওয়ালা বললো – আপনার মেয়ের সাথে তার চার বছরের রিলেশন ; এখন আপনার মেয়ে তাকে এভাবে আসতে বলেছে ; এই নিয়ে তর্ক করতে করতেই আপনি এসে পড়লেন আর আমাদের দু’জনকে দেখলেন।

আব্বা আম্মা দু’জন আমার দিকে তাকালেন! আমার মনে হচ্ছিলো – বাসার ফ্লোরটা ফাঁক হয়ে যাক আর অইটার নিচে আমি জোভান গাধাটাকে পুঁতে ফেলি! হঠাৎ আম্মা হাসতে হাসতে বললেন – যেমন বাপ তেমন মেয়ে ; এইবার দাও তোমার মেয়েকে বিয়ে! আব্বা রুবেলকে বিদায় দিয়ে আমাকে আর আম্মাকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে বললেন – জোভানের সাথে একা কথা বললেন। এরপর আমাদের ডাকলেন যখন – তখন দেখি জোভান আর রুমে নেই!

আমার তো ততক্ষণে কলিজা শুকিয়ে গেছে ; আব্বা বললেন- আগামীকাল ছেলেপক্ষ তোমাকে দেখতে আসবে!
আমি কিছু বলার আগে আব্বা বললেন – আমি আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরি নি তাই – বিয়ে তোমার ইংলিশে মাষ্টার্স করা এই সবজী বিক্রেতা জোভানের সাথেই হবে। তবে এখন শুধু কাবিন হবে যতোদিন চাকুরী না পাবে ততোদিন শশুড় বাড়িতে তোমাকে পাঠানো হবে না কারন আমি স্পষ্ট বলে দিয়েছি – শুধু সবজী খেয়ে আমার মেয়ে সংসার করতে পারবে না। আমি আব্বা – আম্মাকে জড়িয়ে ধরলাম আর বললাম – আমি কোনোদিন তোমাদের ছেড়ে যাবো না।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত