দীর্ঘ ২৩ বছর বাবার সাথে এক ছাঁদের নিচে থাকার পরও যতটা না ভালো সম্পর্ক গড়তে পারি নাই, তিথি একমাস বউ হয়ে এসে তারচেয়ে মধুরতম সম্পর্ক গড়ে সবার চোখের মধ্যোমণি হয়ে গেছে। আমার বাবার সাথে আমি যতটা না ফ্রি মাইন্ডে কথা বলতে পারি তার চেয়ে ফ্রি মাইন্ডে কথা বলে আমার বউ। ছোটবেলা থেকে বাবা মানে এক আতঙ্কের নাম শুনে এসেছি। তার চোখে চোখ রেখে কথা বলা তো দূরের কথা, তার সামনেই যেতে ভয় করতো। সেই শৈশবকাল থেকে বাবাকে ভয় করি খুব। তবে এমনটা নয় যে বাবা সবসময় বকাঝকা করে।
কখনো রাত করে বাসায় ফিরি নাই বাবার ভয়ে। আবার অনেক সময় বাবার সাথে কথা বলতে গিয়েও তুতলিয়ে যেতাম। সময় পাল্টে গেছে। বিয়েও করেছি একমাস হলো। বাবার বয়স হয়ে গেছে, তবুও সেই আগের মতোই ভয় করি। কারণ বাবা তো বাবাই। কিন্তু তিথি একদম ব্যতিক্রম। সে দু’দিন এ বাড়িতে আসতে না আসতেই বাবার সাথে কত্ত হেসে হেসে কথা বলে, বাবার পাশে বসে টিভি দেখে। মাঝে মধ্যে বাবার পছন্দের আইটেমের খাবার তৈরি করে সারপ্রাইজ দেয়। আর বাবা এতেই অনেক খুশি হয়।
আসলে আমি বিয়ে সাবজেক্টটা ছোট বেলা থেকেই একটা অশান্তি, যন্ত্রণাময় জীবন ভাবতাম। কারণ ছোট বেলা থেকে দেখে এসেছি পাশের বাসার আন্টির ছেলের বউকে। উঠতে বসতে তিন বেলায় যেন তাদের বাসায় ঝগড়া হতো। যেমন ঝগড়াটে ছিল আন্টি তেমনি ছিল তার ছেলের বৌ। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সাথে এমন নিত্যদিন ঝগড়াঝাটি দেখে বিয়ের ভাবনাটাই ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমি ভুললে কি হয়! আমার বাবা, মা তো আর ভুলে নাই। সন্তান বড় হলে বিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা বাবা-মায়ের ঘাড়ে এসেই পড়ে। যার কারণে আমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগছিল। কি আর করার! বাবার উপরে তো আর কথা বলতে পারি না। তাই অবশেষে বিয়েটা করতে হলো। একদিন সকালের কথা
– এই আর কতক্ষণ ঘুমাবে তুমি? (তিথি)
– এই দেখ একদম ডিস্টার্ব করবে না। এমনিতেই গতরাতে ঘুমাতে দাওনি। আর আজ তো শুক্রবার, অফিস ছুটি আছে। (আমি)
– আমি এত জানি না। তুমি ওঠো আমি রুম পরিষ্কার করব। রুমটা অনেক দিন পরিষ্কার করা হয়নি। দেখছো নাহ্ কেমন অপরিষ্কার।
– তিথি তোমাকে না ডিস্টার্ব করতে মানা করলাম!
– আমিও কিন্তু বলেছি ওঠো রুম পরিষ্কার করব।
– আমি যেদিন অফিসে যাবো না সেদিন পরিষ্কার কইরো। এখন যাও তো..
– দেখ আব্বা-আম্মার রুমসহ সবকয়টা রুম পরিষ্কার করা হয়ে গেছে। এখন শুধু আমাদের রুমটাই বাকি আছে। তুমি উঠে বাহিরের দিক থেকে ঘুরে এসো।
– আমি এখন উঠতে পারব না।
– কি ভাবে ওঠাতে হয় সেটা আমি ভালোই জানি। ওয়েট করো একটু।
– যাও তো এখান থেকে। সকাল সকাল মাথটা গরম করে দেয়। (জোরে একটা ধাক্কা দিয়ে কথাটা বললাম)
তিথি নিচে পড়ে গিয়ে হু হু করে কান্না শুরু করলো। একটুখানি কেটেও গেছে। আমি কান্নার আওয়াজ শুনে উঠে বসলাম। পাশের ঘর থেকে আব্বা-আম্মা যেমনি ভাবে ছুটে এলো মনেহয় কি না জানি হয়েছে। তিথি অবশ্য আব্বা-আম্মাকে দেখে কান্না থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিথির হাত থেকে হালকা রক্ত পড়তে দেখেই আব্বা ক্ষেপে গেল।
– কি হয়েছে বৌমা? (বাবা)
– না আব্বা তেমন কিছুই হয়নি। (তিথি)
– রাগী কণ্ঠে বলল সত্যি করে বলো বলছি! (বাবা)
– আসলে আমি পা পিছলে পড়ে গেছি। (তিথি)
– এই বাবু কি হইছে সত্যি করে বল।(বাবা)
– কোন কথা না বলে চুপ করে বসে আছি। (আমি)
– একটা ঝাড়ি দিয়ে বলল কি হয়েছে বলতে বলছি নাহ্! (বাবা) আমি তো ঝাড়ি শুনে চুপসে গেলাম। তিথিও লাফ দিয়ে উঠলো।
– বৌমা বাবু তোমাকে মেরেছে! (বাবা)
– এবার কান্না করে বলল আব্বা আমি তাকে ঘুম থেকে ডেকেছি বলে আমাকে ধাক্কা মেরেছে। আর আমি পড়ে গেছি। (তিথি)
আব্বা সিংহের মতো আমার দিকে ছুটে আসছিল কিন্তু আম্মার জন্য পারলো না। আজ এত বছরেও যে বাবা তার ছেলের দিকে এমন ভাবে রাগী চোখে তাকায়নি সেই বাবা আজ আমাকে মারতে এসেছিল পরের মেয়ের জন্য। তিথির উপর এমন রাগ হচ্ছে সেটা বলে বুঝানো সম্ভব না। আজ যদি বউয়ের জন্য বাপের কাছে মাইর খেতাম তাহলে তো ইতিহাসের পাতায় নতুন করে আরেকটা গল্প রচিত হতো। যাই হোক মায়ের জন্য আজ ছাড় পেয়ে গেলাম।
আব্বার হাতের মাইর থেকে হয়তো মা বাঁচিয়েছে। কিন্তু এদিকে মা ও বলতে কম করছে না। তাদের এমন নির্যাতন দেখে নিজেরই সন্দেহ হচ্ছে আমি তাদের সন্তান কিনা! সামান্য একটা বিষয় নিয়ে তারা আমাকে বারবার অপমান করে কথা বলছে। তুই কি পুরুষ নাকি! মেয়ে মানুষের গায়ে হাত তুলিস। কি এমন বলেছিল যার জন্য গায়ে হাত তুলতে হবে! ঘুম থেকেই তো উঠতে বলছিল৷ তোর মত অলস ছেলে আমার সংসার রাখাই ঠিক হয়নি। বেরিয়ে যাহ্ আমার বাসা থেকে। দু’দিন বিয়ে করতে পারলো না বউয়ের গায়ে হাত তুলা শুরু করছে। এসব বলে আব্বা আম্মা রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আমি যে একটা মানুষ, আমারও যে কিছু বলার আছে সেটা না শুনেই আমাকে ইচ্ছা মত বকে চলে গেল। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় এই বাসা থেকে চলে গিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকি। সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ পর্যন্ত অফিস করেও আমাকে অলস কথাটি শুনতে হয়। তিথির দিকে আড়ে আড়ে তাকাচ্ছি আর দাঁত শিটকাচ্ছি। তিথি তো ভয়ে মুখটা চামচিকার ন্যায় করে রাখছে। দুই তিন বার তাকানোর পর বলল এমন ভাবে তাকালে কিন্তু আমি আব্বাকে ডাক দিব।
– যাও ওঠো বলছি আমি রুম পরিষ্কার করব।
– দাঁড়া তোর রুম পরিষ্কার করাচ্ছি।
– আম্মাআআআআআআ
– আচ্ছা আচ্ছা আমি উঠছি
বাহিরে যেতেই আব্বা আমাকে আবার ডাকলো। বাবু এদিকে আয়। মনে মনে ভাবছি না জানি এবার একা পেয়ে কি হাল করে আমার। বিয়ে করেই জীবনটা বেদনার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। শালার বিয়ে না করেই বিন্দাস ছিলাম। আচ্ছা শোন তুই কি কাজটা ভালো করেছিস! একদম সত্যি করে বলবি?
– আব্বা আপনি তো কোন কথা না শুনেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলেন। আপনি তো তিথির হয়ে কথা বলছেন।
– জানিস একটা মেয়ে কতটা নীরিহ!
পরিবারের মায়া ত্যাগ করে। সকল আত্মীয় স্বজনকে ছেড়ে যখন একটা অচেনা পরিবেশে বউ হয়ে একটা মেয়ে আসে, তখন তার সেই পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে কতটা কষ্ট হয় বুঝিস! মেয়েদের দুঃখটা কখনো জানতে চেয়েছিস?
তোদের বিয়ে হলো এই কিছুদিন আগে, এর মধ্যেই ঝগড়া। এখন তুই ওকে ঝাড়ি দিচ্ছিস, এরপর আমি যদি নিজের ছেলে ভেবে তোকে সাপোর্ট করি তখন মেয়েটার অবস্থা কি হবে? সংসারে মন বসবে তার! একটা কথা বলি কান খুলে শোন বউমাকে কখনো আঘাত করে কথা বলিস না। তাহলে কিন্তু সুখ নামক কোন কিছুই তোর সংসারে বিরাজ করবে না। এরপর আব্বা সেখান থেকে চলে গেল।
আমি ওখানেই বসে ভাবতে থাকলাম সত্যিই তো আব্বা ঠিক কথা বলেছে৷ একটা বউ যদি তার শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামীর কাছ থেকে ভালো ব্যবহার না পায় তাহলে তার জীবনটাই তো বৃথা। আর আমি চাই না আমার বউয়ের জীবনটাও এমন হোক। আমার মনেহয় আমার বাবা-মায়ের মত প্রতিটা বাবা-মা যদি তাদের ছেলের বউকে পরের মেয়ে না ভেবে নিজের মেয়ে ভাবতো, তাহলে কোন সংসারেই অশান্তি বিরাজ করতে পারতো না। যাই তিথিকে ঘরের কাজে হেল্প করি….