কল্যাণীয়

কল্যাণীয়

আমার মা খিদে সইতে পারেনা। প্রায়ই দুপুরে তাড়া দিতে থাকেন বিজয় আয় খাবি আয়। অন্যদিন আমি রাগ করলেও আজ ঠিকই প্লেট নিয়ে বসলাম। মায়ের চুল গামছায় মোড়ানো। একগোছা চুল কপালে ঝুলছে। মাকে কিশোরী, মেয়েদের মতো লাগছে। এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। আমি বেসিনে হাত ধুয়ে দরজা খুলে দেই। বাবা সাত আট বছরের একটা বাচ্চার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছনে একজন শাড়িপরা বৌ। আমি কিছু না বুঝে বাবাকে বলি ভেতরে আসতে। আর সোফা দেখিয়ে বলি। বসুন।

আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা বলেন। জয় তুই অতুলকে তোর ঘরে নিয়ে যা। আর তোর মাকে আসতে বল। আমি দরজায় তাকিয়ে দেখি মা দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে সব হারানো পাখির মতো চঞ্চল। আমি মায়ের হাত ধরি মা আস্তে আমার হাত ছাড়িয়ে রুমে গিয়ে শুয়ে থাকেন। আমি আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করি মা চিরকালের মতো রাগ করে দরজা লাগিয়ে দিলেন না। আমি ভাল মন্দ কিছুই বুঝিনা।

মহিলাটি কে? আর সাথের বাচ্চাটা? আমার জানি কেমন লাগে। আড়াইটা বাজে। এখুনি অনন্যা আসবে। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়াই। অনন্যার বাস এসে গেছে ও গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকছে। বাবাই ওকে দরজা খুলে দেন। ও রুমে ঢুকেই – মা আমি খেয়ে এসেছি আজ। এখন ঘুমালাম। বলে একটা চিল্লানি দিয়েই দুম করে দরজা লাগিয়ে দেয়। অন্যদিনের মতো মা রাগ কতে ওকে বকতে বকতে ভাত মাখিয়ে খাওয়ার জন্য পিড়াপিড়ি করেন না। এতো উদাসী হয়ে থাকতে মাকে কখনো দেখিনি। আমি এবার বিবিএ ফাইনাল দেবো। তারপরে এমবিএ। ভালো কোথাও চাকরি পাবোই। আমরা দু ভাইবোনই পড়াশোনায় ভালো।

আর মা বাবাকে জ্বালানো টাইপ না। মা আমার কাছে আবদারে খুকির মতো। একটুতেই অভিমান করেন। প্রায়ই রাতেই বাবার সাথে ঝগড়া করে, না খেয়ে ঘুমাতে যান। অনন্যা আর আমি সাধ্য সাধনা করে তাকে খেতে বসাই। উনি অভিমানি বালিকার মতো চোখ মুছতে মুছতে ভাত খান। আজ সবকিছু খাপছাড়া লাগছে আমার। বাবার সাথে সুন্দর শাড়িপরা, উনি কে! আর মাথা নিচু করে চুপচাপ থাকা বাচ্চাটা? বৌটি বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। খুব মায়াভরা চেহারা। আমার মায়ের থেকে বয়সে বেশ ছোট হবেন।

বাচ্চাটি এক মনে আমাদের বাঁধানো ছবিগুলি দেখছে। আমি ওকে কাছে ডাকি – বাবু এদিকে আসো।! বাচ্চাটি আস্তে উঠে আমার সাথে আমার রুমে আসে। আমি ওকে আমার পুরানো একটা ম্যাকানো সেট দিয়ে খেলতে দেই। বাচ্চাটি চুপচাপ খেলছে। মাথা নিচু করে, হাতে ম্যাকানো সেট। আমি চমকে দেয়ালের দিকে তাকাই ! দেয়ালে আমার একটা ছবি ঝুলছে। আমি মাথা নিচু করে খেলছি আমার হাতে ম্যাকানো সেট। আমি একবার ছবি আর একবার ছেলেটির দিকে তাকাই। আমার মাথা ঘুরে ওঠে। ছেলেটি দেখতে হুবুহু আমার মতো।

আমার মনটা নিমেষেই ঘৃণায় ক্লেদাক্ত হয়ে যায়। এ বাবার কেমন বিচার! আমার মা আমরা দু’ভাইবোনকে তাহলে উনি ভালবাসেন না? যা দেখি সব অভিনয়? আমি চুপচাপ শুয়ে থাকি, ছেলেটিও আমার মতো চুপচাপ আছে। আমি কিছু খাইনি আচ্ছা ও ও তো কিছু খায়নি। আমি আস্তে আস্তে ডাকি – খোকা খোকা.. ছেলেটি মুখ তুলে তাকায় আর আমার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফেলে। আর বলে – আমার নাম অতুল চন্দ্র রায় ।

আমি ওর হাসির মায়ায় পড়ে যাই। আচ্ছা বাচ্চাটির কি দোষ! আর বৌটি আমার কোনো পিসিমা বা কাকিও হতে পারেন। আমিই হয়তো ভুল ভাবছি। আমাদের বাড়ি আজ শব্দহীন। বাইরে ঝিঁঝিঁ ডাকছে। দূরে বাড়ি ফেরা গাড়িগুলোর হর্ণ শোনা যায়। একটা কুকুর করুন সুরে কাঁদছে। অতুল আমার বিছানায় গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। আমি আস্তে আস্তে মায়ের ঘরের সামনে দাঁড়াই। যা দেখতে পাই। আপাদমস্তক চমকে ওঠার জন্য তা যথেষ্ট। মা বিছানায় চোখের উপরে হাত দিয়ে শুয়ে আছেন। মায়ের চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সেই বৌটি। যেনো কতো আপন দুজন কতোকালের চেনাজানা। আড়াল থেকে কথা শোনা অন্যায়। তবুও আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। মা বলছেন।

– কল্যাণী অতুল কাঁদবেনা তো!

– না দিদি কাঁদবেনা।

– তুই কাঁদবি!

– না, দিদি আমি কাঁদবোনা। আমার চোখে কান্না নেই।

– আর আমিতো জানি আমার ছেলে তার মা বাবা ভাইবোনের কাছেই আছে। আমি কাঁদবো কেনো?
আর ওকে এভাবেই বড় করেছি। ঠিক এই মুহুর্তে অনন্যার রুম খুলে অনন্যা বেরিয়ে আসে।

– কিরে দাদা এখানে?

– না এমনি। ভাত খেয়েছিস।

– না খাবোনা,প্লিজ ডাকিস না দাদা সামনে আমার ভর্তি পরীক্ষা আমার পড়ার ক্ষতি হবে।

এটুকু বলেই ও আবার দরজা লাগিয়ে দেয়। আজ একটা অন্যরকম রাত আমাদের সংসারে। আমি বুঝে নেই বৌ’টি বাবার কোনো গরিব আত্বীয়। কিন্তু পোষাক দেখে যথেষ্ট ভদ্র মনে হয়। আমি কিছু বুঝিনা। এমন সময়ে বাবা আমাকে ডাকেন।

– বিজয় শুনছিস! একটু আসবি এদিকে!

আমি বাবার পাশে দাঁড়াই। বাবাকে এমন সবহারা মানুষের মতো লাগছে কেনো? আমার দাপুটে বাবার আজ কি হয়েছে? বাবা আমাকে নিয়ে রাস্তায় আসেন। উনি কাঁপা কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরান। আমি বাবাকে কখনো সিগারেট ধরাতে দেখিনি। আমি একটু কেশে গলা পরিস্কার করে বলি।

– বাবা আমাকে কিছু বলবেন!

সিগারেট দূরে ছুঁড়ে ফেলে বাবা মাথা নেড়ে হ্যা বলেন। একটা গল্প বলি শোন – তোর মাকে যখন বিয়ে করি তখন ওর বয়স সতেরো। বাচ্চা একটা মেয়ে। আমরা পালিয়ে বিয়ে করেছিলাম। তোর ঠাকুরদার ভয়ে বেশ কিছুদিন পালিয়ে ছিলাম। ছ’মাস পড়ে উনিই কুষ্টিয়া থেকে আমাদের ঢাকা নিয়ে আসেন।

আমার চাকরি নেই বেকার, তোর মা তখন কলেজে ভর্তি হয়েছে। সামনে পরীক্ষা আমি কিছুতেই ওর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারিনি। একদিন কি বুঝে তোর মা ও বললো – অনেক হয়েছে পড়া । আর না বাপু। এখন থেকে মন দিয়ে সংসার করবো আর বছর বছর বাচ্চার মা হবো। সংসারের কাজ সংসারের নিয়ম মতোই চলছে। বাইরে থেকে দেখে এতোটুকু অসংগতি মনে হবেনা।

কিছুদিনের মাঝেই আমার ব্যাংকের চাকরিটা হয়ে যায়। আমি তোর মাকে নিয়ে আলাদা বাসা নেই। একে একে ছয়টি বছর কেটে যায়। তোর মায়ের বাচ্চা হয়না। একদিন রাতে তোর মা আমাকে বললো। তার সন্তান চাই, যে করেই হোক। আমরা দুজনেই ডাক্তার দেখালাম। তোর মায়ের কিছু সমস্যা ছিলো। আমি রিপোর্ট ছিঁড়ে ফেললাম। তোর মা টের পেয়ে গেলো। সে রাতেই সে ঘুমের ওষুধ খায়।

যমে মানুষে টানাটানি করে সে বাঁচলো। কিন্তু ওর মানসিক সমস্যা দেখা দিলো। ও আমাকে আবার সংসার করতে বললো। অনেক বুঝালাম কাজ হোলোনা। একরাতে সে চুপচাপ চলে যাচ্ছিলো। আমি ওর কাছে একটা বছর ভিক্ষা চাইলাম। কল্যাণী আমার ব্যাংকের ক্যাশিয়ার বাবুর মেয়ে, মা নেই। সৎমা ভালোবাসেনা। ক্যাশিয়ার বাবুর আরো চারটে এন্ডিগেন্ডি আছে। আমি সে রাতেই কল্যাণী কে বিয়ের কথা বলি। ক্যাশিয়ার বাবু আমার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। আমি বাসায় চলে আসি। চুপচাপ তোর মায়ের পাশে শুয়ে পড়ি।

কিছুদিন পরে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে কল্যাণী আর তার বাবাকে নিয়ে সীতাকুণ্ড চলে যাই। সাতদিন থেকে আসি। সেখানেই আমাদের বিয়ে হয়। আমি বিবাহিত, কল্যাণী জানতো। এবার খুলে বলি ওকে বিয়ে করার রহস্য। ও চুপচাপ মেনে নিলো। একবছর পরে তোর জন্ম। এসব কি শুনছি আমি! আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। আমি ধুলোমাখা রাস্তায় ধপ করে বসে পড়ি। বাবা আমার হাত ধরেন। তারপর আনমনে বলে যেতে থাকেন। তোকে পেয়ে কল্যাণী এতো খুশি হোলো বলার বাইরে। ও তোকে কোল থেকে নামাতো না। তোর কাপড় কাউকে ধুতে দিতোনা। তার ক’দিন পরেই তোকে তোর মায়ের কোলে তুলে দিলাম। কল্যাণী কাঠ হয়ে রইলো। ওর চোখে একফোঁটা জল দেখিনি।

এরপর আমি লজ্জায় কল্যাণীর সামনে যেতে পারতাম না। কি বলে সান্তনা দেবো ওকে। অবশ্য ও সান্তনা চাইতোও না আমার কাছে। সপ্তাহে একবার বা দুবার যেতাম, ওকে দেখতে। একদিন তোর মা বললো তার একটা মেয়ে চাই। এর পাঁচ বছর পরে কল্যাণী আবার মা হোলো ততদিনে ও ভীষণ সংসারী হয়ে গেছে বাবা মারা গেছেন। ভাইবোনদের হাল ধরতে ও কুষ্টিয়া নিজেদের দেশের বাড়ি ফিরে গেছে। অনুকে যখন নিয়ে আসি তখন ওর বয়স ছ’মাস। ও মায়ের দুধ খেতো। কল্যাণী কিছু বলেনি ঘরের থাম বুকে জড়িয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলো। কল্যাণীর ভাই তখন হাতে পায়ে বেশ বড় হয়েছে।সে এসে আমার হাত চেপে ধরলো।

– জামাইবাবু আপনি এটা পারেননা। অনুকে আমরা যেতে দেবোনা। কিছুতেই না।

কল্যাণী ঘর থেকে বটি নিয়ে এলো। বললো – তোর জামাইবাবুর মুখের উপর যদি কোনোদিন কথা বলিস তো আমি নিজের গলায় দা বসাবো। অনুকে পেয়ে তোদের মা হাতে চাঁদ পেলো। সারাক্ষণ মেয়ে নিয়ে থাকে। আমি একদিন তোকে নিয়ে কুষ্টিয়া গেলাম। কল্যাণী দূর থেকে তোকে দেখলো। তারপরে চলে গেলো। কাছে এসে কোলে নিলোনা। আমি পরে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি। ওর একই উত্তর দিদির জিনিষের ভাগ চাইনা। আমায় যেদিন ভগবান দেবেন তো দেবেন। এরপরে দশ বছর কেটে গেলো। কল্যাণী আবার মা হোলো। খুব শখ করে নাম রাখলো অতুল। কাল ওর জন্মদিন ছিলো। আমি গিয়েছিলাম। রাতে কল্যাণী বললো – এবার সময় হয়েছে, অতুলকে নিয়ে যাও। আমি বললাম –

– কিন্তু কেনো? ও তোমার কাছেই বড় হোক।

কল্যাণী না বলে দিলো। – যতোদিন আমার ভেবেছি, বুকে ধরে মানুষ করেছি। এখন দিদির ওকে প্রয়োজন। আর নিজের শাঁখাসিঁদুর দেখিয়ে বললে – বাবার ঘরে এঁটোকাঁটা খেয়ে পড়ে ছিলাম এটুকুর জোরে তোমায় পেয়েছি, সন্তান পেয়েছি। এই বা কম কিসে!

আর আমার সাথেই এই প্রথম এবাড়িতে চলে এলো অতুলকে রাখতে। আমি তখন হু হু করে কাঁদছি। “কল্যাণী ” যাকে আমি কতোকিছু ভাবছি উনি আসলে আমার মা! বাবা বললেন চল ঘরে যাই। রাত প্রায় শেষ হয়ে গেলো। কষ্টে আমার গলা বুজে আসছে। আমরা ঘরে ফিরে এলাম । বাসায় এসে দেখি মা আর ” কল্যাণী” মা তখনো কথা বলছে। আমায় দেখেই কল্যাণী মা আঁচলটা একটু টেনে সামনে নিয়ে এলো। মা শুধু বললেন। – তুই একা থাকতে পারবি কল্যাণী!

– ভেবোনা দিদি। আরেকজন অনু বা বিজয় আসছে পৃথিবীতে। তাকে নিয়েই থাকবো। বিজয় চাকরিতে চলে যাবে অনু ভার্সিটিতে। তুমি অতুল কে নিয়ে থাকবে। তোমায় কোনোদিন একা থাকতে হবেনা দিদি’ভাই।

ভোরের বাসটা প্রায় ছেড়ে দিচ্ছে। আমি আর বাবা এসেছি বাস স্ট্যান্ডে। অনেক কথাই বলার ছিলো কিছুই বলতে পারলাম না। ইচ্ছে হোলো একটা একটা গড় প্রণাম করি এই কল্যাণী নারীকে। একবার অন্তত বলি ” মা থেকে যাও আমাদের সাথে”। আমি এ যুগের মানুষ আমি কিছুই পারলাম না। বাস ছেড়ে দিলো। বাসায় ফিরে এসেছি। অতুল আমার বিছানাতেই ছিলো, কই গেলো! আমি মায়ের রুমে উঁকি দিয়ে দেখি ও মায়ের কোলের কাছে ঘুমাচ্ছে। আমায় দেখে মা বললো। – বিজয় আমিই অতুলের নাম রেখেছি অনুর সাথে মিলিয়ে, নামটা সুন্দর না? আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে বললাম – খুব সুন্দর নাম মা খুব সুন্দর।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত