– আচ্ছা মা বিয়ে তো একবার দিলেই, কি হলো! এখন আবার কেন বিয়ের কথা বলছো!
– তুই কি সারাজীবন এভাবেই থাকবি নাকি!
– কেন মা – এভাবে কেন থাকা যাবে না!
– নারে – এভাবে হয় না, আমার আর তোর বাবার বয়স হয়েছে, তোদের কোনো ভাইও নেই যে তোকে আগলে রাখবে।
– মা তুমি বোধহয় জানো না – জীবনের একটা পর্যায়ে এসে কারো প্রয়োজন হয় না – নিজের সাথেই নিজে বেশ ভালো থাকা যায়।
– তবুও তোর তিন বোন সংসার করছে তাদের মতো তুইও সংসার করবি – সেটা দেখে মরতে পারলেও আমি আর তোর বাবা শান্তি পাবো।
– মা সংসার তো আগেও একবার করে তোমাদের শান্তি দিতে চেয়েছিলাম!
মা চোখের পানি আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন – যে ছেলেটা তোকে ডিভোর্স দিয়েছে মনে রাখিস – অনেকে মূল্যবান কিছু অর্জন করে ফেলে কিন্তু সেটাকে ধরে রাখার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না। সেই ছেলে তোকে মর্যাদা দিতে পারে নাই তাই সবাই যে ঐ ছেলের মতো হবে এমন তো নয়! দুনিয়াতে এখনো অনেক ভালো ছেলে আছে – তুই শুধু একবার এই পাত্রটার সাথে দেখা কর, পরে ভালো না লাগলে না করে দিস ; আমরা আগেরবারের মতো কোনো জোর করবো না।
আমি আর কিছু বলি না – শুধু মনে পড়তে থাকে – চার বছর আগে সন্তান ধারনের অক্ষমতার অজুহাত দিয়ে শিহাব তিন বছরের বিবাহিত জীবনের অবসান ঘটিয়েছিলো। ডিভোর্স দিয়ে ছয়মাসের মধ্যেই শিহাব বিয়ে করে তার এক সুন্দরী পি এস কে শুধু এইটুকুই জানি – এরপর শিহাবের খবর কেউ দেবার আগেই বলে দিয়েছি – আমি আমার এক্স হাসব্যান্ড এর কোনো খবর শুনতে চাই না – আমাকে তার ব্যাপারে কোনো কথা কেউ বলবেন না প্লিজ।
আমার আর শিহাবের ভালোবাসার সংসার ছিলো কিনা আমি জানি না কারন শিহাবের সাথে আমার পারিবারিকভাবে বিয়ে হয় তখন আমি সবেমাত্র হিসাব বিজ্ঞানে অনার্স প্রথম বর্ষে ছিলাম। পড়ালেখা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়েটা করতে চেয়েছিলাম বলে তখন ঘোর আপত্তি করেছিলাম কিন্তু আমার মা বাবা অনুরোধ করলেন – এতো ভালো আর্কিটেক্ট পাত্র পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ; সাথে আমার বড় তিন বোন বললেন – তুই তো দেখতেও আমাদের তিন বোনের মতো সুন্দরী না কিন্তু দেখ তোর কপালেই বুয়েট পাস করা আর্কিটেক্ট মিলেছে। সুন্দরী না হবার খেসারতটা তাই তখন আর্কিটেক্টকে কবুল বলে দিতে হলো।
কামনা বাসনায় কাছে আসা আমার আর্কিটেক্ট স্বামী খুব সুক্ষ্ণভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন সুন্দরী না হওয়াটা একটা অপরাধ আর সেই অপরাধে স্বামী – স্ত্রী সম্পর্কের মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী করে রেখেছিলেন। সেই অদৃশ্য দেয়াল ভেদ করে নিজের কোনো শখ আহ্লাদ পূরণ করার কথা তাকে আর বলা হতো না! কাজের মধ্যে একটা কাজ করেছেন আমার পড়ালেখাটা বন্ধ করেন নি। হয়তো বিনে পয়সায় উনার বাড়িতে কাজের লোক হয়েছিলাম তাই সেটার শোধ দিয়েছেন।
তবুও দিন কাটছিলো কিন্তু দুই বছর না যেতেই বাচ্চা চাই বাচ্চা চাই বলে শশুড় শাশুড়ী ননদরা যখন চেঁচাতে লাগলো তখন আমার স্বামীর স্কুল জীবনের বান্ধুবীর কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার নামে অনেক টেষ্ট করানো হলো – কিছুদিন পর টেষ্টের রেজাল্ট বের হয়ে আসলো – আমার সমস্যার কারনে সন্তানের মুখ দেখতে পারবেন না আমার স্বামী। আমি যতোবারেই জানতে চাইলাম আমার সমস্যাটা কি! তখন আমার স্বামী বললো – হিসাব বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে তুমি মেডিকেলের সমস্যার কি বুঝবে? বললাম – আমি আমার সমস্যাটা জানতে চেয়েছি – মেডিকেলের সমস্যা কেন জানতে চাইবো!
সাথে সাথে আমার গালে খুব জোরে একটা চড় দেয় শিহাব। আমি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি! শিহাব বলতে থাকে – মা হবার যোগ্যতা নাই যার তার আবার কেন হতে পারবে না – সেটার কৈফিয়ত চাই! তোর মতো অসুন্দরীকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল ছিলো ; ভালো ফ্যামিলির মেয়ে কালো হলেও ভালো – এগুলো বলে বলে তখন মানুষ মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো ; তোর মতো কালো মেয়ে আমার জীবনটাও এখন কালো করে দিয়েছে। তোকে আমি আর রাখবো না! এরপরেই আমি বাবার বাসায় চলে আসি ; বাবা – মা অপেক্ষা করতেন আর বলতে থাকেন – দেখবি রাগ কমে গেলে শিহাব তোকে নিতে চলে আসবে।
আমি জানতাম শিহাব আসবে না তবুও কিছু বলতাম না! সতের দিনের দিন শিহাব ডিভোর্স লেটার পাঠায়।
কেন জানি আমার খুব ভালো লাগে – নিজেকে খুব স্বাধীন মনে হয় ; এরপর মাষ্টার্স শেষ করে আমি একটা সরকারী ব্যাংকে চাকুরী শুরু করে দেই। সমস্যা হয় আত্নীয় স্বজন থেকে শুরু করে সবাই জেনে যায় সন্তান না হবার কারনে আমার এতো ভালো বিয়েটা ভেংগে গেলো! সবাই আফসোস পর্ব শেষ করে কিছুদিন পর থেকে সন্তান আছে এমন সব বিপত্নীক লোকজনের জন্য আমার বাবা – মা’র কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছেন। আমার জোরালো অসম্মতিতে বাবা – মা আর এইসব প্রস্তাব আমাকে জানাতো না।
কিন্ত আজ চার বছর পর মা অনুরোধ করলেন একবার পাত্রের সাথে দেখা করার জন্য। পাত্র বাংলাদেশ থেকে এইচ এস সি পাস করে লন্ডন থেকে এমবিএ শেষ করে দুই বছর সেখানে চাকুরী করে গত মাসে একেবারে দেশে চলে এসেছে – এখন বিয়ের জন্য পাত্রী হিসেবে আমাকে নাকি ছবি দেখে তার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি ডিভোর্সি ও সন্তান ধারনে অক্ষম জেনেও উনি আমাকেই বিয়ে করতে চাইছেন – এখন শুধু আমার অনুমতির অপেক্ষা।
আমার কেন জানি মনে হলো – এই লোকের লন্ডনে একটা সাদা চামড়ার বউ আছে ; দেশের লোকজনের কাছে ভালো সাজার জন্য আমাকে বিয়ে করতে চাইছে। তাই দু’টো কথা শুনাবো বলেই আজ নির্ধারিত রেষ্টুরেন্ট এ উনার সাথে দেখা করতে গেলাম। উনার মোবাইল নাম্বার আসার সময় মা দিয়ে দিলো ; রেষ্টুরেন্ট এর সামনে গিয়ে মোবাইলে কল দিতেই পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম – কোথায় আছেন? বললেন – আপনার দুই হাত পিছনে আছি।
ঘাড় ঘুরিয়ে যাকে দেখলাম আমি তাকে কখনোই পাত্র হিসেবে দেখবো আশা করি নি! বিস্ময়ের ঘোর আমি অনেক কষ্টে সামলে বললাম – তুমি রাকিব না! মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে রাকিব বললো – চলো রেষ্টুরেন্ট এর ভিতরে গিয়ে বসে কথা বলি। বহুদিন পর এক পশলা বৃষ্টি এসে টিনের চালে শব্দ তুললে যেমন আনন্দ হয় ঠিক তেমন প্রিয় মানুষকে বহুদিন পর হঠাৎ দেখে আমার বুকের মাঝে এরকম শব্দ হচ্ছিলো। আমি সেই শব্দের সুর বুকে নিয়ে রাকিবের মুখোমুখি হয়ে রেষ্টুরেন্ট এ বসলাম।
রাকিবের চোখে চোখ পড়তেই টের পেলাম গত আট বছরে রাকিবের অনেক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু সেই চোখের মুগ্ধতা ঠিক আগের মতোই আছে। এই মুগ্ধতার মায়া আমি জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় ভুলেই গিয়েছিলাম তবুও মাঝে মাঝে মনে পড়ে যেতো – এইচএসসি পরীক্ষার কোচিং এ একসাথে পড়তে আসা এই মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকা রাকিব নামক ছেলেটার কথা! অথচ চার মাস কোচিং এর পরিচয়ে – খুব অল্পই কথা হয়েছে। কোনো ছেলে মুখ ফোটে ভালোবাসি না বললেও বুঝতে পারাটা প্রতিটা মেয়ের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। সেই সুবাদে মুখে রাকিব না বললেও বেশ বুঝেছিলাম ছেলেটা আমাকে খুব পছন্দ করে। আমি যখন রেষ্টুরেন্ট এর মেন্যু হাতে নিয়ে এইসব ভাবছি ঠিক তখনই রাকিব বললো – কি খাবে বলো! আমি বললাম – শুধু চা খাবো ; আমার অন্য কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না!
রাকিব বললো তাহলে বাইরে কোথাও কোনো টং দোকানে চা খাবো ; যতক্ষণ টং দোকান না পাবো আমরা হাঁটবো ; পারবে তো! হাসতে হাসতে আমি উঠলাম – চোখ তুলেই দেখলাম রাকিব আবারও মুগ্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তাকাতেই লজ্জায় চোখ জোড়াতে সানগ্লাস দিলো। হাঁটতে হাঁটতেই রাকিব বললো – এইচএসসি এর পর আমি লন্ডনে চলে যাই সেখানে তোমাকে ফেসবুকে খুঁজি আর সেখান থেকেই জানতে পারি তোমার অনার্সে ভর্তি হতে না হতেই বিয়ে হয়ে যাই ; এরপর তোমাকে আর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাইনি ; ভেবেছি স্বামী সংসার নিয়ে ভালোই আছো! গত বছর আমাদের সাথে যে কোচিং করতো মুক্তা
– সে আমাকে ফেসবুকে নক দেয় ; পরে তোমার কথা জানতে চাইলে বলে – তোমার ডিভোর্স এর ব্যাপারটা বললো! এরপর তোমাকে ফেসবুকে অনেকবার সার্চ দিয়েও আর পাইনি!
– আর তাই এখন তুমি আমাকে করুণা দেখিয়ে বিয়ে করতে চাইছো!
– এভাবে কেন বলছো! তুমি কি সেই চার মাসে একবারের জন্যও বুঝো নি যে আমি তোমাকে কত্ত ভালোবাসি। আমি প্রবাসে অনেক মেয়ে দেখেছি কিন্তু সবার মাঝেই তোমার ছায়া খুঁজতাম ; মা বাবা বিয়ের জন্য অনেক পাত্রীর ছবি পাঠাতো – দেশে আসতে বলতো কিন্তু তোমার জন্য জমানো ভালোবাসা আমি কাউকে দিতে পারি নি।
– আবেগ আর বাস্তবতা এক না রাকিব! তুমি কি এটা জানো যে আমি কখনো মা হতে পারবো না!
– জানি ; আমার ফ্যামিলিও জানে – তারা কিছুটা আপসেট ছিলো পরে আমার পছন্দের কথা ভেবে তাদের এখন আর কোনো আপত্তি নেই!
আমার বলতে ইচ্ছে হয় – রাকিব – তুমি জানবেনা – গত চারটা বছর ধরে কতবার যে আমি তোমার ফেসবুকের প্রোফাইলে ঘুরে আসতাম কিন্তু রিকোয়েস্ট পাঠাতে গিয়েও পাঠাতাম না! সমাজের কটুক্তি থেকে দূরে থাকতে পুরোনো আইডি ডিসেবল করে নতুন ফেইক নাম দিয়ে আইডি খুলেছিলাম। একটা ডিভোর্স দেয়া নারী যতোটা না নিজের কাছে মানসিকভাবে ভেংগে পড়ে তার চেয়ে এই সমাজ সংসার তাকে আরও বেশি ভেংগে ফেলে। আমি আরও অনেক কিছু বলতে চাই কিন্তু পারিনা – আমার গলায় সব কথা আটকে চোখটা ভিজে উঠে ; আমি রাকিবের সাথে হাঁটতে থাকি আর ভাবতে থাকি – এটা বোধহয় আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর স্বপ্ন – আমি চাই না এই স্বপ্নের শেষ হোক!
একটা টং দোকান দেখে বসতে বসতেই রাকিব বলে – বিয়ে করবে আমায়? আমি থতমত খেয়ে বলি – চা খাওয়াবে রোজ কোনো টং দোকানে! অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঘরোয়া আয়োজনে আমার আর রাকিবের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের প্রায় আট মাস পর একদিন সন্ধ্যায় ব্যাংক থেকে ফিরে এসে বার কয়েক বমি করতে থাকি – রাকিব ভয় পেয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় – ডাক্তার টেষ্ট করিয়ে পরদিন জানায় আমি দুই মাসের প্রেগন্যান্ট! আমি সেদিন প্রচুর কাঁদতে থাকি আমার সাথে রাকিবও কাঁদতে থাকে। আমার এখন তিন বছরের একটা ছেলে ; আমার শশুড় শাশুড়ীর কাছেই রেখে আমি ব্যাংকে প্রতিদিনের মতো যাই – আজকে বাড়ীর জন্য লোন এর দরখাস্তের ঝামেলা নিয়ে এক ভদ্রমহিলা ব্যাংকে আসলে চেহারাটা কোথায় যেনো দেখেছি বলে মনে হয়!
এরপর মহিলা নিজেই বলেন – আপনি শিহাবের প্রাক্তন স্ত্রী – আমি শিহাবের স্কুল ফেন্ড – একবার শিহাব আপনার কিছু টেষ্ট করানোর জন্য আমার কাছে এনেছিলেন। আমার তখন মনে পড়লো – সেই ডাক্তার মহিলাটা! তখন মহিলা বললেন – আপনার কোনো সমস্যা ছিলো না! সমস্যা ছিলো শিহাবের সে কোনোদিন বাবা হতে পারবে না! কিন্তু আমাকে অনুরোধ করে এই মিথ্যে কথাটা বলেছিলো কারন সে তার পি এস অনিতার সাথে প্রেম করতো!
আমি খুব শব্দ করে হাসলাম – চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে মহিলাকে উনার চেয়ার ছেড়ে উঠতে বললাম – মহিলা খুব ভয়ে ভয়ে উঠলো – আমি উনাকে খুব করে জড়িয়ে ধরলাম – আর বললাম – আপনারা সবাই আমার অনেক উপকার করেছেন – আপনাদের উপকারে আজ আমি আমার ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখের সংসার করছি – আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।