প্রেম আসে না

প্রেম আসে না

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কিছু অবাঞ্চিত ভাইয়া এবং আপুকে দেখে এক ধরণের কষ্ট হত- বিমর্ষ মুখ, ক্লান্ত পায়ের রেখা লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে চুপচাপ মাথা নুইয়ে হেঁটে-হেঁটে হেঁটে-হেঁটে নীলক্ষেত, লালবাগ কিংবা আজিমপুরের দিকে হারিয়ে যাচ্ছেন সকরুণ বিস্ময়ে ভাবতাম, এদের এখনো চাকুরী হচ্ছে না কেন? অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর ৪-৫ বছর চলে যাচ্ছে এখনো চাকুরী হয় না কেন? এইটা কোন কথা? থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় আচমকা একদিন ধাক্কা লেগে এমনই একজোড়া ভাইয়া এবং আপুর সঙ্গে পরিচয় হয়ে গেল! ভাইয়ার বয়স তখন সাতাশ, আপুটা সাড়ে সাতাশ ধরা যাক, আপুর নাম আঁখি (ছদ্মনাম)। ভাইয়াটা তার পাখি। পাখি ভাইয়া এদের দুইজনেরই পড়াশোনা শেষ। এইবার চাকুরী চাই। ধুমায়ে জিকে পড়ছে। আঙুলের ডগা গুণে দিনরাত অংক কষছে। দিন মাস বছর যাচ্ছে। বাড়ছে বয়স। বাড়ে টেনশন। কিন্তু চাকুরী আর হয় না। মাঝেমধ্যেই দেখা হয়। আপুটা জানতে চায়,”কেমন আছিস?”

“ভালো।”
“নতুন কিছু লিখছি?”
“উহু। সামনে মিড টার্ম। ক্লাশের পড়া পড়ছি।”
“আচ্ছা বেশ-”

আপুটা টুকিটাকি কথা কয়। ভাইয়াটা হাসিমুখে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রয়। আপুটার জন্য অপেক্ষা করে। ওরা একসাথে লাইব্রেরিতে আসে। একই সঙ্গে ফিরে যায়। একজন থাকে আজিমপুর, অন্যজন লালবাগ। প্রতিদিন ভোর সাতটার মধ্যে হাজিরা দেয়। সন্ধ্যার পর বাসায় যায়। এক চিলতে আনন্দ নাই। হাসিখুশির উৎসব নাই। অতলান্ত ক্লান্তি ও নৈরাশ্যের জীবন।

বন্ধুদের অনেকেই তদ্দিনে বড় বড় চাকুরী নিয়ে বিয়েসাদী করে রাজ্যপাট মেলে দিয়েছে একই ব্যাচের ছাত্র হয়েও বন্ধুদের জীবনে অবারিত বসন্ত কুজন, এদের দুইচোখে খাঁখাঁ রোদ্দুর দিন মাস বছর যায়, আয়ুর খাতায় দাগ পড়ে… এদের চাকুরী আর হয় না। দিনে দিনে দুজনেই আরও বেশি বিমর্ষ হয়ে যায় এখন আর আগের মতো আপুটার মুখে হাসি নাই। দেখা হলে এড়িয়ে যায়। নিজে থেকেই তবু আমি আগ বাড়িয়ে জানতে চাই,”কেমন আছো?” আপুটা ঘাড় বাঁকিয়ে সম্মতি সূচক একটা ভঙ্গি করে। খুব অস্ফুট কণ্ঠে বলে,”এই তো-” ভাইয়াটা আমাকে দেখেও না দেখার ভান করে। কিংবা কে জানে, দুঃসহ বেকারত্বের চাপে ভুলেই গেছে হয়ত আমাকে আমি বুঝতে পারি, ওরা ভালো নেই।

আমার কষ্ট হয় এর কিছুদিন পর থেকেই আপুটাকে আর দেখতে পাই না৷ শুধু ভাইয়াটাকে দেখি প্রথম প্রথম গা করি নি। কয়েকদিন যাওয়ার পর কৌতুহল হল। তবে কি আপুটার চাকুরী হয়ে গেছে? কোথায় হল? ব্যাংকে নাকি বিসিএস? নাকি আরও বড় কিছু? হাকিম চত্বরের কোণার দিকে একটা বেঞ্চে বসে ভাইয়াটা নাস্তা করছিল। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। উনার সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সালাম দিয়ে জানতে চাই,”ভাইয়া কেমন আছেন?” ভাইয়া ফিরে তাকায়। প্রথম দেখাতেই চিনেও ফেলে।

“হেই, নুরা! কি খবর, ভালো আছিস?”
“ভালো আছি ভাই।”
“আয় বস, নাস্তা কর।”
“নাহ ভাই। বাসা থেকে নাস্তা করেই আসছি।

অনেকদিন হল আঁখি আপুকে দেখছি না। ঘটনা কি বলুন তো? কোথায় জয়েন করেছে?” ভাইয়াটা একটা ধাক্কা খায়। অনেকটা কষ্ট করেই যেন হাসার চেষ্টা করে৷ বলে,”তুই জানিস না কিছু? জানায় নি তোকে?”

“কই না তো!”
“ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে!”
এইবার আমারই ধাক্কা খাওয়ার পালা,
“বিয়ে হয়ে গেছে মানে? মজা করছেন আমার সাথে?”

ভাইয়া ফ্যাকাশে গলায় বলে,”তোর সঙ্গে আমার মজাক করার সম্পর্ক? আসলেই বিয়ে হয়ে গেছে। কুরবানির ঈদে বাড়ি গেল সেবার। এলাকার এক অল্প বয়সী ছেলে চেয়ারম্যান হয়েছে। সে খুব ছোটবেলা থেকেই আঁখিরে পছন্দ করত। এতদিন নাগাল পায় নি, কিন্তু…” ভাইয়াটা থেমে যায়। গলাটা ধরে আসে ওর। বিচিত্র বিস্ময়ের সঙ্গে আমি ভাবি,”কুরবানির ঈদে বাড়ি গিয়ে আচমকা বিয়ে? মরার আর টাইম পেল না!” “ভাইয়া জানতে চায়, তোর কি খবর?””ভালো।” “ফোর্থ ইয়ার নাহ?””হ্যা।”ভাইয়া মাথা নুইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,”কঠিন সময়, খুব কঠিন!” আমি পুরনো কথার রেশ ধরে জানতে চাই,”আপুর বিয়েতে যান নাই আপনি?” ভাইয়া ফিরে চায়। ম্লান গলায় বলে,”হা, নাহ! প্রেমিকার বিয়ে খাইতে ফেনী যামু? ছোট লোক আর কারে কয়!”

“কষ্ট হয় না?”
“কষ্ট? নাহ। ওয় আমারে রাগানোর জন্যই বিয়ে করেছে। বিয়ের আগে আমারে ফোন দিয়ে কি কয় জানস?”
“কি?”
“কয় আমি নাকি একটা ভেজা বারুদ। ওর বিয়েতে চুল্লি না জ্বললে আমার গা গরম হবে না। গরম না হলে চাকুরী হবে না!”

কথা শেষ করে সে আহাম্মকের মতো হা হা করে হাসে। মাথায় গুত্তা খাওয়া গরুর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে এলোপাতাড়ি মাথা নাড়ায়। আমার কষ্ট হতে থাকে। কি বলব ভেবে পাই না। ভাইয়াটা আবারও হে-হে করে হাসে। নিজের মাথায় চাপর দিয়ে স্বগোতক্তির মতো করে বলে,”মাইয়্যার বুদ্ধি আছে বুঝলি। কথা সে মন্দ বলে নি! চাকুরী এইবার হয়ে যাবে আমার। খুব বড়সড় একটা দাও মারার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। যার জন্যে এত অপেক্ষা সেই চলে যায়, হালার জীবন। জীবন একটা বাল!”

এই ছিল উনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। এরপর আর কখনো ক্যাম্পাসে দেখা হয় নি। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম তাই ওর কথা মনে পড়লেও গভীর থেকে ভাবি নি কিছু। এর মধ্যে কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। কয়েকমাস আগে একটা পুলিশি পোষাক পড়া প্রফাইল থেকে রিকুয়েষ্ট আসে। একসেপ্ট করি। ভেতরে ঢুকে তালাশ করি নি। কিন্তু মাঝেমধ্যেই ছবি দেখি৷ চেনাচেনা লাগে। মনে হয় এই মানুষটাকে কোথায় যেন দেখেছি? মাঝেমধ্যে সে আমার লেখায় লম্বা-চওড়া কমেন্ট দেয়৷ আমি সাদামাটা একটা ‘থ্যাংকইউ’ দিয়ে এড়িয়ে যাই।

এইবার বইমেলায় একদিন শেষরাতের দিকে আচমকাই ইনবক্সে হানা দেয়। বলে,”কি হে কবি? আছো কেমন?” অচেনা কেউ তুমি করে বললে ভালো লাগে না। ভ্রুরু কুচকে যায়। সে বলে,”অনেকদিন দেখি না তোমায়। আগামীকাল মেলায় থাকবা? দেখা করতে মন চায়!” এইবার ধাক্কা খাই। অনেকদিন দেখা হয় না মানে আগে দেখা হয়েছে। প্রফাইলে গিয়ে কিছু ছবি ঘাঁটতেই ভুল ভাঙে। অবাক বিস্ময়ে বলি,”পাখি ভাই, আপনি? এতদিন কোথায় ছিলেন!” ভাই বলে,”আছি আছি, মানুষের মধ্যেই আছি!””চাকুরী হয়েছে, মিষ্টি পাই নাই! মিষ্টি খাওবেন কবে?” “এসো, আগামীকাল মেলায় আসো। দেখা করি!” “জ্বি ভাই, আসছি।

মেলায় গেলাম। তিনিও আসলেন। দেখা হল। কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম,”ভাই, বিয়ে করেছেন?” ভাই বলে,”নাহ-।” “বিয়ে করবেন না?” “হু করব। আগে একটা বাড়ি হোক, এক-দুইটা গাড়ি হোক, এরপর ভেবে দেখব-।” “পুলিশে জব করছেন, অবাক লাগছে!” “অবাক হওয়ার কি আছে? পুলিশ কি মানুষ নয়? আচ্ছা ভালো কথা, তুই দুনিয়ার সবকিছু নিয়ে গল্প লিখিস, পুলিস নিয়ে লিখা নাই কেন? যে কটা আছে, সবই মন্দ পুলিশের কথা!” লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলি। ভাই আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চায়,”আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখবি। আমার কাছে গল্প আছে!” উনার কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলি। বেচারা পাখি ভাই, শেষ বয়সে ছ্যাকাটেকা খেয়ে আসলেই আউলায়ে গেছে!

মজাক করে জানতে চাই,”আঁখি আপু কেমন আছে? যোগাযোগ আছে?” ভাই আমার বিরস কণ্ঠে বলেন,”আছে, ভালোই আছে।” “বাচ্চাকাচ্চা হয় নি?” “হয়েছে। একজোড়া।” ভাইয়ের নির্মোহ ভঙ্গি দেখে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। টপিক বদলে ফেলি৷ রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি- ইত্যাদি হাই-থট বিষয় নিয়ে কথা কই। ফেরার আগে তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে আচমকাই জানতে চান,”তুই তো লেখক মানুষ। প্রচ্চুর বইপত্র পড়িস। প্রচুর মানুষ দেখেছিস, তুই আমারে ক দেখি, পৃথিবীতে প্রেম বলে আসলেই কি কিছু আছে?”

এইবার সিরিয়াস হয়ে যাই। গম্ভীর গলায় বলি,”আছে, ভাই আছে। কেউ কেউ সত্যিই পায়। বাকিরা আপনার আমার মতো ঝিমায়!” “ধুর শালা, আমারে কি ঝিমাইন্যা পাবলিক মনে হয়। আমি ভালো আছি৷ খুব ভালো।” “ভালো আছেন শুনে খুশি হয়েছি।” “আসলেই ভালো আছি। মাঝেমধ্যে আঁখির কথা মনে হইলে মনটা উদাস হয়ে যায়। আম্মায় পাগল হইছে বিয়ে করানোর জন্য। মাসে মাসে দশটা মেয়ের ছবি পাঠায়। ছবিতে ওদের ঠোঁট দেখি, সুন্দর! বুক দেখি, সুন্দর! নাদুস-নুদুস দেহের বাঁধুনি দেখে দুইটা মেয়ের সাথে দেখাও করলাম কয়েকবার। দেখা হলে কি হয় জানিস?”

“কি?” “আমার শুধু সেক্স আসে, প্রেম আসে না! প্রেম বলে জগতে কিছু নাই, তাই না?” আমি নিরুত্তর তাকিয়ে থাকি। উত্তর খুঁজে পাই না! “মাঝেমধ্যে নিজেকে একটা কুকুরের চাইতেও অধম লাগে। একটা মানুষের দেহ ভরা সেক্স আছে, অথচ বিন্দু পরিমাণ প্রেম নাই… ভাবতে পারিস?” আমার কিছু বলার ছিল না। তাই চুপচাপ শুনে গেলাম শুধু। বিপন্ন বিস্ময়ের সঙ্গে ভাবছিলাম, একজন যুবকের অন্তরে কী ভীষণ প্রেম থাকলেই না এইভাবে ভাবতে পারে। আজকের পর থেকে যদি আমাকে শ্রেষ্ঠতম প্রেমিকের কথা কেউ বলতে বলে, আমি হয়ত এই মানুষটার কথাই বলব!

রাত্রিরে একা বাসায় ফিরছিলাম। বিহঙ্গ বাসের পেছনের দিকে জানলার পাশে সীটে বসেছিলাম। বর্ণালী আলোয় সুসজ্জিত নাগরিক রাজপথ। অগুন্তি গাড়ির মিছিল। যান্ত্রিক কোলাহল। এই সবকিছু ছাপিয়ে তবুও একজন বিপন্ন যুবকের অযান্ত্রিক ভালোবাসার আবেশে আপ্লুত হয়েছিলাম আমি। পাখি ভাইয়ার কথা ভাবছিলাম। পাখি আমার একলা পাখি। ভেবে ভেবে কষ্ট হচ্ছিল। আঁখি আপুর কথা ভাবছিলাম। ভেবে ভেবে কান্না পাচ্ছিল।

আঁখি আপু… এই পৃথিবীর সবচাইতে হতভাগা এক রমণী… ওর জন্যে এক নিঃসঙ্গ যুবক এক পৃথিবী ভালোবাসা বুকের ভেতর আগলে রেখে একাকী এই শহরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। হেঁটে হেঁটে, হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত প্রাণ এক দুঃসহ নিয়তির কষাঘাতে কিছু ফুল এভাবেই মারা যায়। নিভৃত নিরজনে পদদলিত হয়ে গলে পঁচে নাগরিক নর্দমার নালা পথে হারিয়ে যায় তবুও- ওরা বলে, প্রেম আসে না! কেন প্রেম আসে না?

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত