সুদীর্ঘ পথচলা

সুদীর্ঘ পথচলা

আমি মরিয়ম। সবাই আমাকে মারিয়া বলে চিনে। আমার বেড়ে ওঠা এতিমখানাতে। ছাত্রী হিসেবে আমি খুব ভালো ছিলাম। এতিমখানায় সবাই আমাকে বেশ আদর করতো, কারণ আমি খুব ঠান্ডা স্বভাবের আর পড়াশোনায় ভাল ছিলাম বলে। চুপিচুপি গান করতাম। কোন এক অজানা কারনে লালনের গান আমায় টানতো। আমার মন খারাপ থাকলেই এতিমখানার ছাদটাতে চুপিচুপি উঠতাম আর লালনের গান গাইতাম।নিজেকে প্রশ্ন করতাম কে আমি? আমাকে কারা এই এতিমখানাতে রেখে গেলো? যথারীতি আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে GPA-5 পেলাম। এতিমখানাতে একটা শোরগোল পড়ে গেলো। বড় স্যার আমার মাথায় হাত রেখে অনেক দোয়া করলেন।

আমি সকল পাবলিক ভার্সিটিতেই এডমিশন টেস্ট দেয়া শুরু করলাম। চান্সও পেলাম, এমন কি বুয়েটেও। সেদিন বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রথম গেলাম। আমার জোড়াতালি দেয়া স্যান্ডেলটা ছিড়ে গেলো, স্যান্ডেল হাতে নিয়ে হাটছি আমি। অনেকে এই দৃশ্য দেখে হাসছে, কিন্তু এতে আমার বিন্দু মাত্র লজ্জাবোধ হচ্ছে না। কারণ সেদিন ছিলো আমার পেটে প্রচন্ড খিদে, আর নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তেজনা। আমার পরিচিত কেউ নেই। বন্ধু নেই, কোথাও কেউ নেই।
আমার এক হাতে ছেড়া চপ্পল আর একহাতে ফাইল। ক্যাম্পাসে বসে থাকা চার পাঁচজন যুবক আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলো।

আমি সামনে এগিয়ে গেলাম, একজন প্রশ্ন করলো হাতে ছেড়া চপ্পল নিয়ে এখানে কাকে খুঁজছো! বয়ফ্রেন্ড? আমি থতমত খেয়েছিলাম সেদিন। বললাম আজ আমি নতুন এসেছি, আমার ডিপার্টমেন্ট খুঁজছি। অন্য একজন বললো, তুমি বুয়েটের ছাত্রী? আমি মাথা নিচু করে বলি এবার প্রথম বর্ষে চান্স পেয়েছি Computer Science এ। সঙ্গে সঙ্গেই সে বললো, বলো কি মেয়ে! আমি আমার সার্টিফিকেট দেখালাম। আমি চাইলে আমার এতিমখানা কোটাতেও পারতাম, কিন্তু তার প্রয়োজন হয়নি। আমি সেদিন প্রথমবারের মতন বুঝলাম মানুষ মানুষের জন্য। ওরা আমার মুখ দেখেই বুঝেছে আমি সেদিন অভুক্ত ছিলাম। তারা সেদিন আমাকে খাওয়ালোলো, এমন কি জুতোও কিনে দিলো। এখন পর্যন্ত আমি এই ভাইদের আন্ডারেই আছি। কোন রকম সমস্যায় পড়তে হয়নি আমার। তারা আগলিয়ে রেখেছে এখনো।

মোটামুটি বন্ধুও জুটেছে এখন অনেক। একটা হোষ্টেল ও পেয়ে গেছি ভাইয়ারাই ম্যানেজ করে দিয়েছে। কয়টা টিউশন ও পেয়েছি এরমধ্যে। রোজ শুক্রবার টা আমার চলে যায়, পুরাতন ঠিকানা এতিমখানাতে। সব ছোট্ট ছোট্ট মুখ আমাকে জড়িয়ে ধরে আপু আপু করে। তেমন কিছুই নিতে পারিনা তাদের জন্য। এই একটু চকলেট আর চিপস, তাতেই ওরা খুশি। বড় স্যার আমার মাথায় হাত রেখে বাচ্চাদের বলে মরিয়মের মতন হও। মরিয়ম এই এতিমখানার গর্ব। নিজের যোগ্যতায় আজ সে বুয়েটে পড়ছে। আমি লজ্জায় মাথা নীচু করে বলি, স্যার এইভাবে বলবেন না, আপনাদের দোয়া আর পরিশ্রমের ফলেই আজ আমি এতোদূর। জীবনে বড় হওয়ার একটাই উদ্দেশ্য, এতিম শিশুদের জন্য কিছু করার জন্য সুস্থ পরিবেশে নিজে একটা এতিমখানা গড়বো।

আমার মরিয়ম নাম নাকি খুব ব্যাকডেটেট। তাই এখন আমাকে এখন মারিয়া বলেই সবাই চিনে। সবার মাঝে একজন আবার আমাকে ম্যারি বলে ডাকে। প্রচন্ড রোদ সেদিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে। আমার সামনে সেদিন শুভ এসে হাত ধরে বলে, লাইনে না দাঁড়িয়ে আমার গাড়িতে চল। শুভ আমার ক্লাসমেট। প্রচন্ড স্কলার ছেলে। আমাকে অনেক সাহায্য করে পড়াশোনাতে, এমন কি নোটস দিয়েও।

আমি আজ শুভর গাড়ীতে, এই প্রথম আমার জীবনে আমি গাড়ি চড়ি তাও আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত দামী গাড়ি। আমি শুভর দিকে তাকিয়ে বলি, এই গাড়িতে চড়তে আমার ভয় করছে, কেমন জানি দম বন্ধ হয়ে আসছে। শুভ হেসে বলে ফাজলামি ছাড় তো। আমি শুভকে বলি সত্যিই, আমি কখনও গাড়িতে উঠিনি ওই বাস পর্যন্তই আমার দৌড়। সেদিন শুভর সাথে আমি দামী রেষ্টুরেন্টে খেলাম। এটাও আমার জীবনে প্রথম। চোখ সেদিন ভিজে এসছিলো। শুভ আমার হাত ধরে বলে, পাগলী চোখ পানি কেনো? আমি বললাম তুই কত টাকা খরচ করে ফেললি, এই টাকা দিয়ে আমার এতিমখানার বাচ্চগুলোর একবেলা পেট ভরে ভাত খাওয়া হয়ে যেতো। শুভ আমার হাত ধরে সেদিন কথা দিয়েছিলো, তোর এতিমখানার বাচ্চাদের একবেলা না সারাজীবনের ভার নিব একদিন দেখিস।

শুভ আর আমার মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে, শুধু বন্ধুত্ব বললে ভুল হবে হয়তো আরো বেশি কিছু। এটাকে হয়তো প্রেম বলে, হ্যাঁ আমাদের বন্ধুত্বটা অল্প অল্প করে একটা প্রেমের সম্পর্কের জন্ম দিলো। এদিকে আমাদের দুজনের পড়াশোনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। আমি স্কলারশিপ এর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি। শুভ এবার আমাকে জোর করছে বিয়ে করার জন্য। আমি কিছুতেই রাজি না। আমার স্বপ্ন আরও পড়াশোনা করবো, একটা এতিমখানা করবো, আর আমার শেকড়ের খোঁজ করা। কে আমি? সেদিন হঠাৎ ফোন এলো, শুভর ফোন। ও বলছে, তুই এখনি বাসায় আয় আমার শরীর খুব খারাপ। আমি আধঘন্টার মধ্যে শুভদের ধানমন্ডি ১১/এ’র বাসায় যাই।বাসার মেড আমাকে চিনে, আমি এর আগেও শুভর বাসায় গিয়েছি। আমাকে দেখেই বলে ভাইয়ার রুমে যান।

শুভ ওর রুমে শুয়ে শুয়ে গেম খেলছে। আমি চেয়ার টেনে ওর মুখের সামনে এসে বসি, কি হলো আবার তোর? ও আমার হাত টেনে বলে কাছে আয় বলছি, আমি ওর বিছানায় বসি ও আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে করতে বলে আমাকে বিয়ে কর। হঠাৎ রুমে নকে এর আওয়াজ, আমি নিজেকে গুছিয়ে চেয়ারে বসি। শুভর মা। আমি সালাম দিলাম। উনি হেসে বললো, ম্যারি কেমন আছো? জ্বি আন্টি ভালো। ম্যারি শুভ তো তোমার খুব ভাল বন্ধু। তোমার বন্ধুর জন্য একটা মেয়ে দেখো। আমি চাই শুভ কানাডাতে এমএস করার আগে একটা বিয়ে করুক। এমনিতে তোমাকে আমার বেশ পছন্দ, কিন্তু সমাজ বলে কথা আছে তো। তোমার বাবা মায়ের কোন পরিচয় নেই। বাচ্চা কাচ্চা হওয়ার পর কি জবাব দিবে। শুভ এক প্রকার তার মা’কে ধমকিয়ে চুপ করালো। আমার চোখ ভিজে গেছিলো, সেদিন শুভ আমার হাত ধরে অনেক সর‍্যি বলে তার মায়ের হয়ে মাফ চাইলো।

অতঃপর, পাঁচ বছর পর আজ আমি অনেক নথিপত্র ঘেটে আমার শেকড়ের খোঁজ পেলাম। শেকড়ের খোঁজে বাংলাদেশে এলাম। ও বলা হয়নি, আমি MIT তে পিএইচডি করতে আমেরিকাতে আসি, সেখানে ৫টা বছর কাটিয়ে আবার শেকড়ের খোঁজে ছুটছি। আমার মা সবিতা চক্রবর্তী, পাবনা কলেজের গণিতের প্রফেসর। আমি উনার কোয়ার্টারের ঠিকানায় যাই। উনার ড্রইংরুমে বসতে দেয় আমাকে, সমস্ত রুম বইয়ে ঠাসা, একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বললেও ভুল হবে না। দেখলাম এক বয়স্ক মানুষ উকিলের পোষাকে বের হচ্ছেন, সাথে উনার ফাইলপত্র নিয়ে। আমাকে দেখে বললেন, তুমি সবিতার ছাত্রী! বসো চা খাও, সবিতা পূজা সেড়ে এক্ষুনি আসছে।

পুজো সেড়ে উনি আমার পাশেই এসে বসলেন, লক্ষ্য করলাম উনার কপালে লাল সিঁদুরের সিঁথিতে জলজল করছে সিঁদূরের আভা। হঠাৎ বললেন, তুমি কি আমার ছাত্রী ছিলে? আমি মাথা নাড়িযে না করলাম। তার আগে আপনাকে একবার সালাম করতে পারি! উনাকে অত্যন্ত মায়াবতী মনে হলো, পা ছুঁতে দিলেন না। উনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি উনার হাত ধরে বলি আপনাকে একটু ছুঁয়ে থাকি। সবিতা চক্রবর্তী, যিনি আমার মা, আমার হাত ছুঁয়ে বসে আছেন। আমার কেন জানি মনে হলো, তিনি আমাকে চিনেছেন। উনার মুখ দিয়ে বার বার শব্দ আসছে, হায় ভগবান তোমার কি লীলাখেলা। আমি উনাকে প্রশ্ন করি, আপনার সত্নান কয়জন? উনি বলে একটাই মেয়ে তোমার বয়সী হবে। রোজ ভগবানের কাছে প্রথর্না করি ও যেন খুব ভাল থাকে।

আমি এবার কেঁদে দেই, কি অপরাধ ছিল তার! তাকে এতিমখানায় দিতে হয়েছিল কেন? সে কি তোমাদের ভালোবাসার ফসল ছিলো নাকি পাপের? আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের ভালবাসার ফসল ছিলি। তোর বাবা মুসলিম ছিলো, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। ওই অবস্থায় বিয়ে করি। তোর দাদা জোর করে তোর বাবার অন্যত্র বিয়ে দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দেয়। সমাজ মেনে নিবে না তুই তখন আমার পেটে চলে এলি, আমি তোকে নষ্ট করিনি মা। সিদ্ধান্ত নিলাম তোকে আমি পৃথিবীর আলো দেখাবো, বাকিটা আমার ভগবান জানে। তোকে জন্ম দেয়ার পর আমার জ্ঞান ফিরে তোকে আর পাইনিরে মা। আমাকে ক্ষমা কর, আমি তোর অভাগী মা। তবে রোজ প্রথর্না করেছি তোর মঙ্গলের, তোর মুখখানা একবার নয়নভরে দেখার। আজ ভগবান আমার প্রার্থনা শুনেই আমার কাছে তোকে পাঠিয়েছে। মা আর মেয়ে মিলে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাদঁছি। বাইরে তখন বৈশাখের প্রথম ঝড় বৃষ্টি।

এদিকে আমার এতিম শিশুদের নিয়ে আমি আমার এতিমখানার কাজ শুরু করে দিয়েছি, আধুনিক এতিমখানা করার ইচ্ছে, আমার স্বপ্ন অনেক বড়। সবিতা চক্রবর্তী আমার মা, আজ উনি আমার পাশে আছেন। এতিমখানার কাজে বড় একটা ডোনেট করেছেন, কিন্তু নাম লিখেননি। তবে আমি জানি উনি কে আমি মরিয়ম, শুভর ম্যারি। আমার জন্য দোয়া করবেন। আমার স্বপ্ন যেন এই শিশুগুলোর মধ্যে দিয়েই বিলিয়ে দিই। আপনারও আসুন এই এতিম শিশুদের পাশে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত