শ্রেষ্ঠ উপহার বাবা মা

শ্রেষ্ঠ উপহার বাবা মা

বাবার কাছ থেকে চার হাজার টাকা চেয়েছিলাম।উদ্দেশ্য বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার।কিন্তু বাবা টাকাটা দিতে পারে নি।পরবর্তীতে রেগে গিয়ে মা বাবা দু’জনকে বলেছিলাম,চাহিদা পূরণ করতে না পারলে দুনিয়াতে নিয়ে আসছো কেন? ফকিরের মত বন্ধুদের সাথে মেশা যায় নাকি ? অভাব দেখানো ছাড়া কিছুই তো জীবনে দিতে পারলা না । নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে আমি।কিন্তু বন্ধুমহলে নিজেকে এইভাবে তুলে ধরতে আমার খুব লজ্জা করতো। তাই প্রায় মা বাবাকে এরকম কটু কথা শুনাতাম। সেদিন রাগারাগি করে ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় হাঁটছিলাম।মাথা চরম আকারে উত্তেজিত ! তিরিক্ষি মেজাজে হনহন করে হাঁটছি ।

হঠাৎ থমকে গেলাম। প্ল্যাটফরমের পাশের গলিটার সামনে দাঁড়িয়ে গেলাম।তিন রাস্তার মোড়ে একটা ডাস্টবিন।লক্ষ্য করলাম ৯/১০ বছরের একটা ছেলে ডাস্টবিন এবং তার আশেপাশে কি যেন খুঁজছে ? আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ যাবৎ বুঝতে চেষ্টা করলাম ছেলেটা আসলে কি খুঁজছে ?

প্রায় ঘন্টাখানেক পর লক্ষ্য করলাম ছেলেটা বেরিয়ে আসছে।ততক্ষণ পর্যন্ত আমি বুঝতে পারলাম না ছেলেটা আসলে কি খুঁজলো ? তার কাঁধেও কোনো ব্যাগ নেই।ব্যাগ থাকলে বুঝতে পারতাম হয়তো প্লাস্টিক, কাগজ বা এই ধরনের কিছুই খুঁজেছিলো।ছেলেটার কাঁধে কোনো ব্যাগ না থাকায় আমি একটু বেশি কৌতুহল হয়ে গেলাম মূল বিষয়টা জানার জন্য ।

ছেলেটাকে ডাক দিলাম । ডাক শুনে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।চুলগুলো উষ্কখুষ্ক, শার্ট ময়লা বা ছিঁড়া , পায়ে জুতা নেই এই ধরনের কোনো কিছুই না।বরং ছেলেটার চুলগুলো বেশ চিরুনি বুলিয়ে দেওয়া।তেল দেওয়া চুলের বাম পাশে একটা সিঁথি করা।গায়ের শার্ট যথেষ্ট পরিষ্কার এবং সুন্দর। অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,

–তোমার নাম কি ?

–পারভেজ ।

–ওখানে কি খুঁজছিলে একটু আগে ?

–লোহা । অনেকটা ইতস্তঃত হয়ে প্রশ্নের উত্তর দিলো পারভেজ নামের ছেলেটা।

–লোহা ! কিন্তু লোহা দিয়ে তুমি কি করবে ?

–ভাইয়া, আমার আব্বু একটা ভালো জায়গায় চাকরী করে।আমি ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ি।আমরা তিন ভাই বোন।আমি সবার বড় । কিন্তু ইদানিং আব্বু ঘরে বাজার সদাই কিনে না । জানিনা উনার কি হয়েছে, মায়ের সাথে শুধু ঝগড়া করে।

ছোট ভাইবোনগুলো চটপট করছে ক্ষুধায় । মা না পারছে কাউকে বলতে না পারছে সইতে।জানেন ভাইয়া,মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো এমন ই । না পারে হজম করতে না পারে কারও কাছে খুঁজতে। তাই আজ প্রায় এক সপ্তাহ যাবৎ আমি খুব সকালে মা’কে বলে লুকিয়ে এলাকা থেকে বেরিয়ে এসে এই জায়গায় লোহা টোকাই।কারণ এলাকার কারও চোখে পড়লে আমার বাবার মানসম্মান থাকবেনা, যা কিছুই হোক উনি তো আমাদের বাবা।পৃথিবীর মুখ দেখিয়েছেন তো আমাদের । তাই মা সবসময় উনার সম্মানের কথা ভাবেন,আর তা আমাদের শেখান।সেই ভয়ে মা আমাকে এলাকায় লোহা টোকাতে দেয় না।

এই লোহা বিক্রয় করে যে কয় টাকা পাই তা দিয়ে আটা কিনে নিয়ে যাই।কারণ চালের অনেক দাম । এই সামান্য টাকায় কতটুকুই বা চাল পাবো ! আর কয়জনেই বা ভাত খাবো ? তাছাড়া রুটির তুলনায় ভাত তাড়াতাড়ি হজম হয়ে যায় । তাই মা বলেছে আটা নিয়ে যাওয়ার জন্য।আটা দিয়ে মা রুটি বানিয়ে আমাদের তিন ভাইবোনকে খেতে দেন। যাই ভাইয়া, আমার ভাইবোনরা ক্ষুধায় হয়তো মা’কে জ্বালাচ্ছেন ।

এই বলে পারভেজ নামের ছেলেটা আমার দৃষ্টির অগোচরে হারিয়ে গেলো।অজান্তে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো ! ছোটদের কাছ থেকেও যে শেখার অনেক কিছু আছে তা এই ছেলেকে না দেখলে বুঝতাম ই না । অথচ কিছুক্ষণ আগে আমি আমার মা বাবার সাথে রাগারাগি করে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছি । আর এই বাচ্চা ছেলে নিজের মা, ভাইবোনদের জন্য অকৃত্রিম হৃদয়ভরা ভালবাসা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে । দু’হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে হাঁটতে শুরু করলাম।উদ্দেশ্য বাড়িতে ফিরে যাওয়ার। বাড়িতে ফিরে আমি অবাক হয়ে যাই মা’কে দেখে ! কারণ মা আমার সামনে চার হাজার টাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।চোখমুখ লাল, দেখতে বিষণ্ণ লাগছে ।

–এই নে বাবা,তোর চার হাজার টাকা । মা টাকাটা এগিয়ে দিয়ে আমাকে বললেন।

–মাগো , এই টাকা তুমি কোথায় পেলে ?

–তোর বাবা উনার ব্যবহার করা সাইকেলটা পাশের বাড়ির মিনার বাপের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে । উনি এই চার হাজার টাকা দিয়েছেন ।

সাইকেলে চড়ে বাবা দেড় কিলোমিটার রাস্তা অতিবাহিত করে কর্মস্থলে গিয়ে হাজির হতেন।সেই কষ্টের টাকায় কেনা সাইকেলটা বাবা আমার জন্য বিক্রয় করে দিয়েছেন। আমি টাকাটা হাতে নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।বাবার চোখেমুখে প্রশান্তির ছায়া । মুখভর্তি হাসি নিয়ে বললেন,

–মাফ করে দিস, বাপ। তোদের জন্ম দিয়েছি ঠিকই কিন্তু চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারি না রে । সামর্থ্য নেই যে ! কথাটা বলে বাবা অনুতপ্ত হয়ে মাটির সাথে সন্ধি করে নিলেন। আমি বাবার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বললাম,

–জীবনে আর কিছুই চাই না বাবা।কেবল হাজার বছর ধরে তুমি আর মা আমাদের মাথার উপর ছায়া হয়েই থেকো।

আমার কথা শুনে বাবা মাথাটা উপরের দিকে তুলে অবাক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন।আর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। চার হাজার টাকা নিয়ে মিনা আপুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।আমার বাবার সাইকেল টা ফিরিয়ে আনার জন্য।আর মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা করলাম,জীবনের প্রথম উপার্জন দিয়ে বাবা’কে একটা বাইক উপহার দিবো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত