আমার হবু বর আর আমি একই রুমে সামনাসামনি বসে আছি। কদিন পরই আমাদের বিয়ে হবে। বিয়ের দিন প্রায় ঠিক হয়েই গেছে। পরিবারের ইচ্ছেতেই হচ্ছে এই বিয়েটা। বিয়ের পূর্বে দুজন দুজনকে ভালোভাবে চেনা ও জানার জন্যই আমরা আজ রুমবন্দি। এটা আমার বাবার সিদ্ধান্ত। ওনার মন্তব্য,, দুজন কথা বলে যদি কেউ একজন মনে করে আমরা সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে পারব না, তবে যেভাবেই হোক এ বিয়েটা আর হবে না।
কেউ কোনো কথা বলছি না। আমি কয়েকবার ওর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম। দীর্ঘশ্বাসের শব্দটা একটু বেশিই জোরে হয়ে গেছে মনে হয়। সেই শব্দে মনে হলো, নিস্তব্ধ রুমটা গুমোট হয়ে গেল। শব্দটা মেপে মেপে তিন হাত দূরে বসা আমার হবু বরের কর্ণে পৌঁছে গেল। আর এবারই তার মুখে কথা ফুটল। সে বলল — একটি দীর্ঘশ্বাস কখনো আপনা আপনি আসে না। দীর্ঘশ্বাস অতীতের কোনো না কোনো স্মৃতি নিয়ে আসে। এই মুহূর্তে দীর্ঘশ্বাস আপনার কী অতীত নিয়ে এসেছে? তার কথাগুলো শুনে আমার প্রথমেই যে কথাটা মাথায় এলো তা হলো, বাহঃ! মানুষটা ভালোই তো বুঝতে পারে সবকিছু!!
তারপর ভাবলাম, যার বোঝার ক্ষমতা এতটা পরিমাণ যে,, সে একটা দীর্ঘশ্বাস শুনে উপলব্ধি করতে পারে অতীত, সে নিশ্চয়ই আমাকেও বুঝতে পারবে। একবার তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম উত্তরের আশায় সে আমার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে৷ আমি আর তার অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ না করে উত্তর দিলাম — প্রতিটি মানুষেরই তো একটা করে অতীত থাকে। অতীত ব্যতীত তো কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। হ্যাঁ আমারও একটা অতীত আছে যা জঘন্য আর কুৎসিত৷ সে আমাকে অভয় দিয়ে বললো —- আপনার জীবনের গল্প শুনতে আমি ইচ্ছা প্রকাশ করছি। দয়া করে গল্প টা বলবেন কি? সত্যি কথা বলতে, জানালার দিকে তাকিয়ে আমি এটাই ভাবছিলাম যে গল্পটা ওনাকে বলে দেই। তাতে বিয়ে হয় হবে, না হয় না হবে। আর ঠিক সেই সময়েই দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এলো।
আমি বললাম —- আপনি মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনুন। বাবা বলেছে,, আমাদের মধ্যে কথা হওয়ার পর যদি একজনেরও মনে হয় আমরা এই বিয়ে করে সুখি হতে পারব না, তো বিয়েটা হবে না। আমার অতীত শুনে আপনার যদি মনে হয় আমাকে বিয়ে করা আপনার উচিৎ হবে না তো বিয়েটা আপনি করবেন না। আমার জীবনে কেউ ছিল। যাকে আমি খুব ভালোবাসতাম। হয়তো মিথ্যার আড়ালে সেও আমাকে একদিন ভালোবেসে ছিল। তবে সেই ভালোবাসা একদিন আমি নিজের চোখে মলিন হতে দেখেছি।। আমি যাকে ভালোবাসতাম তার নাম ছিল আবির। আমার থেকে এক ব্যাচ সিনিয়র ছিল ও। আমাদের রিলেশন ছিল তিন বছরে।। এইটুকু সময়ের মধ্যে আমি ওকে অনেক ভালোবেসে ছিলাম। আর তাকে বিশ্বাস করেছিলাম। ও আমাকে ভয় দেখাতো আমার জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়ার। আর ও বলত, যদি ওর সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করি তো ও আমার হবে। ওকে হারানোর ভয়ে একাধিকার ওর সাথে শারিরীক সম্পর্কে জড়িয়েছি।
আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম, কোনো প্রতিকূল পরিবেশেও আমরা আলাদা হব না। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে সব কেমন হঠাৎ করেই পাল্টে গেল। ও আমাকে আর সময় দিতে চাইতো না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম ও বদলে গেছে। হয়তো আমার মধ্যে ও আর ভালোবাসা খুঁজতে চাইতো না। আর ভালোবাসায় যদি একবার তিক্ততা আসে, সে সম্পর্ক কখনো টিকে থাকে না। তখন হাজারো মধুমাখা মিষ্টি কথাও তেতো লাগে। সেই তেতো কথা আমি আমার ভালোবাসার মধ্যে আনতে চাইনি বলে নিজে থেকেই আবিরের কাছ থেকে দূরে চলে আসছি। একনাগাড়ে কথাগুলো বলে আমি ব্যাস্ততম পরিবেশ শান্ত করে মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম। আমি বুঝতে পারলাম, আমার চোখদুটো ভিজে এসেছে। কিন্তু আমার বিচক্ষণ হবু বর সেটা বুঝতে পারলো না। সে আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল এটুকুই? আমি অবাক হয়ে মাথা উঁচু করে একবার তার দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, এতবড় একটা বিষয় কে সে এটুকুই বলছে কেন?
সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল হ্যাঁ, মানুষকে একটা বিশ্বাস করা উচিৎ নয়। এ জগতে তুমি যাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করবে, সে তোমাকে সবচেয়ে বড় কষ্টটা হতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাবে। আর হ্যাঁ,, তোমার গল্প টা আমি মন দিয়ে শুনেছি। হয়তো তোমার এই দুর্বলতার কারণে আমি তোমাকে বিয়ে করব না। কিন্তু বিয়ে করার জন্য আমার পাত্রী প্রয়োজন হবেই। আমি আরেকটা মেয়েকে দেখলাম।আধুনিক যুগেও সেও মেয়েও যদি তোমার মতোই আরেকটা গল্প আমাকে শোনায় তো তোমাকে বিয়ে করা আমার ক্ষতি কী? আমি তোমাকে দোষারোপ করব না৷ আমি দোষ দেব সেই সব মানুষদের, যারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে তোমাদের মতো মেয়েদের ব্যবহার করে আর নিজের প্রয়োজন মিটে গেলে করে অবহেলা।।
আমি শেষ কবে কেঁদেছি আমার মনে পড়ে না। আবির আমাকে অবহেলা ও আমার জীবন থেকে চলে যাওয়ার পরও আমি কখনো কান্না করি নি। কিন্তু আজ আসার হবু বরের কথা শুনে আমার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু মেঝেতে নিপাত হলো। আমার মনে হচ্ছে, আমার বাবা আমার জন্য পৃথিবীর সেরা মানুষটি কে খুঁজে বের করেছে। যে সত্যিই আমাকে খুব সুখে রাখতে পারবে ও আমাকে বুঝতে পারবে।
আমি একটু সংকোচ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আপনি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবেন? সে আগের চেয়েও শান্ত গলায় বলল হ্যাঁ।। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে।। যে মেয়ে তার নোংরা দুর্বলতার কথা স্বাধীন ভাবে প্রকাশ করতে পারে,, তাকে ভালো লাগবে নাই ই বা কেন? আচ্ছা আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি কি? আমি তড়িঘড়ি করে বললাম অবশ্যই…
—– আপনার পরিবারের কেউ কি বিষয় টি সম্পর্কে অবগত…??
—- না। বাসায় কেউ জানে না।
—- তাহলে আমাকেও বিষয়টি না জানালেই পারতেন। অহেতুক কেন আমাকে বললেন?
—– আসলে আমি আপনাকে ঠকাতে চাইনি। আজ যদি আপনাকে এসব না বলতাম, তো সারাজীবন আমি নিজের কাছে নিজেই অপরাধী হয়ে থাকতাম। কোনো অপরাধী হয়ে কি সারাজীবন বেঁচে থাকা যায় বলুন?
—- যার মনটা এত সুন্দর সে কখনো অপরাধী হতে পারে না পুষ্প। তার মুখে আমার নাম শুনে আমি একটু হেসে বললাম আপনার নাম কিন্তু আমি এখনো জানি না। সে একটু হেসে বলল আমার নাম বিবেক। তুমি বিবেকানন্দ বলে ডাকতে পারো!!