এগারতম বারের মতো আয়োজন করে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে এসেছি! আগের দশ বারের মেয়ে দেখার ঘটনাগুলো বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি কারণ সেই দশজনের ঠিক অর্ধেকজনকে আমার নিজের পছন্দ হয়নি, আর বাকী অর্ধেকের স্বয়ং আমাকেই পছন্দ হয়নি! আজকের এই সম্বন্ধটার খোঁজ এনেছেন আমার বাবার খুব কাছের একজন বন্ধু। আমার মেয়ে দেখা সংক্রান্ত ব্যাপারে বাবা প্রচণ্ড হতাশ ও বিরক্ত, তাই তিনি এবারে বলেই দিয়েছেন আমার মেয়ে পছন্দ হোক বা না হোক তাতে কিছু আসে যায়না, মেয়ের আমাকে পছন্দ হলেই বিয়ে ফাইনাল!
বাবার কথাটা আমার জন্য নিতান্তই অপমানজনক! আমার নাকি পছন্দ অপছন্দের কোন ব্যাপার নাই, বরং মেয়েরই নাকি আমাকে পছন্দ হতে হবে! এটা কোন কথা হতে পারেনা। কিন্তু পছন্দ যারই হবে হোক, বিয়েটা তো অন্তত হবে এই ভেবে বাবার এই নিতান্ত অপমানজনক কথাটাও আমার কাছে বেশ মধুর লেগেছে, কারণ আগের দশবারের চেষ্টাতেও বিয়ে না হওয়াতে বিয়ে নিয়ে আমি নিজেও একপ্রকারের হতাশার মধ্যে আছি।
মেয়ে দেখার আনুষ্ঠানিকতা চলছে। জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পর মেয়েকে নিয়ে আসা হলো আমাদের সামনে। মেয়ে দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়ে আমার পছন্দ হয়নি! এই মেয়ে অতিরিক্ত ফর্সা, এত ফর্সা মেয়ে আমার পছন্দ না। মেয়ে হওয়া উচিত কিছুটা শ্যামলাটে, শ্যামবর্ণের মুখে নিষ্পাপ সরলতা খেলা করবে, মিষ্টি হাসিতে তার মুক্তো ঝরবে, তার মায়াবী চাহনীতে হৃদয় দুলে উঠবে, বিয়ের পাত্রী এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু এমন কোন বৈশিষ্ট্য এই মেয়ের মধ্যে দেখতে পেলাম না। উল্টো এই মেয়ের নাক বোচা, ঠোঁট মোটা, চুল পাতলা আর দাঁত বাঁকা! মেয়ে আমার কিছুতেই পছন্দ হয়নি!
যে মেয়েকে প্রথম দর্শনে প্রেম জেগে উঠবেনা সেই মেয়েকে আর যাই হোক বিয়ে করা যায়না। কিন্তু আমার শ্রদ্ধেয় আব্বাজান আগেই বলে রেখেছেন, আমার মেয়ে পছন্দ বা অপছন্দ করাটা এই বিয়েতে কোন প্রভাব ফেলবে না। মেয়ের যদি আমাকে পছন্দ হয় তাহলেই নাকি বিয়ে ফাইনাল। সুতরাং এই বিয়ে না হতে হলে মেয়ের আমাকে অপছন্দ হতে হবে। অতএব এই এগারোতম বারে এসে স্বেচ্ছায় ব্যর্থ হতে হলে আমাকে এমন কিছু করতে হবে যাতে মেয়ে আমাকে অপছন্দ করে।
হালের রীতি অনুযায়ী কিছুক্ষণ পর আমাকে আর মেয়েকে আলাদা জায়গায় পাঠানো হলো কথা বলার জন্য। আমার জন্য এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ আমাকে কাজে লাগাতে হবে। মনে মনে ভেবে রেখেছি আমি নিজেকে এমন খারাপভাবে প্রেজেন্ট করবো মেয়ের সামনে যাতে মেয়ে নিজ থেকে বিয়েতে না করে দেয়! দুজনে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছি। মেয়েটা মুখ নীচু করে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম আমাকেই কথা শুরু করতে হবে।
ছোট্ট একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “তো আপনার নাম অনামিকা?” মেয়ে মুখ তুলে পরিষ্কার কণ্ঠে বললো, “জ্বি, আমার নাম অনামিকা।” “আচ্ছা আপনি কি আমার সম্পর্কে কিছু জানেন?” “না জানিনা। আপনি জানালেই জানতে পারবো।” একটু ফিসফিসিয়ে বললাম, “আচ্ছা শুনুন, আমার কিন্তু একটা রিলেশন আছে!” অনামিকা স্বাভাবিক কন্ঠে বললো, “বিয়ের আগে রিলেশন থাকতেই পারে। আজকালকার যুগে এটা একটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। আমার কোন সমস্যা নাই।”
এমন উত্তর শুনে আমি হতাশ হলাম। এই উত্তর আমি আশা করিনি। আমি আশা করেছিলাম রিলেশনের কথা শুনে মেয়ে হয়তো বলবে এই বিয়ে ভেঙ্গে দিতে। এবার আরো ফিসফিসিয়ে বললাম, “শুনুন, আমার কিন্তু ৩ টা এক্স আছে!” অনামিকা উদাস গলায় বললো, “প্রেম করেছেন যখন এক্স তো থাকবেই। আমার কোন সমস্যা নাই।” আমি এবার দ্বিগুণ হতাশ হলাম। নিজের সম্পর্কে আর কি খারাপ বলা যায় ভাবতে ভাবতে এবারে মোক্ষম হাতিয়ারটা মাথায় এসে গেল। বললাম, “শুনুন মিস অনামিকা, আমার কিন্তু এইডস আছে!”
এই কথা শুনে অনামিকার কি রিয়্যাকশন হতে পারে সেটা দেখার জন্য আমি আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে। কিন্তু অনামিকার মধ্যে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেলনা। বিরস গলায় অনামিকা বললো, “অপকর্ম যখন করেছেন এইডস তো হবেই। কিন্তু তাতেও আমার কোন সমস্যা নাই!” আমি এবার যারপরনাই হতাশ হলাম। হতাশার চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছে গেলাম আমি। এই মেয়ে দেখি আমাকে বিয়ে করেই ছাড়বে! নাছোড়বান্দা হয়ে বললাম, “মানে কি? মানে আমার কোন কিছুতেই আপনার সমস্যা নাই?”
“না, আপনার কোন কিছুতেই আমার সমস্যা নাই!”
“কিন্তু কেন?”
“কারণ আপনার সাথে বিয়ের পর আমি পালিয়ে যাব!” ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “কার সাথে পালাবেন?”
“আসিফের সাথে।”
“আসিফ টা আবার কে?”
“আসিফ আমার বয়ফ্রেন্ড।”
“তাহলে বিয়ের আগেই পালাচ্ছেন না কেন? শুধু শুধু নিজের পরিবারের সাথে আমার পরিবারটাকেও বিপদে ফেলবেন কেন?”
“কারণ আছে।”
“কি কারণ?”
“কারণ হচ্ছে আমার বয়ফ্রেন্ড গরীব।”
“বয়ফ্রেন্ড গরীব হওয়ার সাথে বিয়ের পর পালানোর কি সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক আছে। আমার বয়ফ্রেন্ড গরীব। আবার আমরাও অতোটা স্বচ্ছল না। কিন্তু আপনারা মোটামুটি স্বচ্ছল। বিয়ে হলে আমার আর আপনার পরিবারে যা টাকা পয়সা আর গহনাদি থাকবে সব নিয়ে পালানোর সুযোগ পাব। তাহলে আমার আর আসিফের টাকা পয়সার আর কোন সমস্যা থাকবেনা!” অনামিকার মুখে এরকম উত্তরশুনে আমার রীতিমতো ভয় ধরে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “যদি আমি পালাতে না দিই?” “তাহলে প্রয়োজন হলে আপনাকে গুলি করে মেরে ফেলব!” বলতে বলতে অনামিকার পিস্তল ধরা বামহাত আমার কপাল বরাবর উঠে এল। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই পিস্তলের ট্রিগারে অনামিকা চাপ দিয়ে বসলো!
ঘটনা এর বেশী এগুলো না। ধড়ফড় করে হাঁফাতে হাঁফাতে ঘুম ভেঙ্গে আমি বিছানায় উঠে বসলাম। পাশে মা দাঁড়িয়ে আছেন। তড়িঘড়ি করে কপালের গুলি লাগা জায়গায় হাত রাখলাম। না, কপালে গুলি লাগেনি। মা আসলে কপালে আর মুখে পানি ছিঁটা দিয়েছেন আমার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য! মা রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন। তারপর উনি হুংকার ছাড়লেন, ” লাটসাহেবের ব্যাটা উঠেন। বিয়ে বিয়ে করে তো সারাদিন বাড়ী মাথায় করে রাখেন অথচ মেয়ে দেখতে যাওয়ার বেলায় আপনার ঘুম ভাঙ্গে না। উঠে এক্ষুণি রেড়ি হয়ে নেন। অনামিকাদের বাসায় যাওয়ার সময় হয়েছে!”
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো ঘটনাটাই যে স্বপ্নে ঘটেছে সেটা ভেবে আমি মনে মনে বেশ শান্তি পেলাম। সাথে অনামিকার ব্যাপারে মনে একটা ভয়ও ঢুকে গেল। বাবার কথাটা মনে পড়ে গেল। আমার মেয়ে পছন্দ হোক না হোক, মেয়ের আমাকে পছন্দ হলেই বিয়ে ফাইনাল। বাবার কথার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। কারণ মেয়ে যেমনই হোক, আমার শুধু বিয়েটা হওয়া চাই। অলরেড়ি দশ বারের মেয়ে দেখায় বিফল হওয়ার সংখ্যাটা আমি আরো বাড়াতে চাইনা। মনে মনে ভেবে নিলাম এই মেয়ের সামনে এমন কিছু বলা বা করা যাবেনা যাতে মেয়ে বিয়েতে অরাজি হয়। মেয়ে একবার রাজী হয়ে গেলেই কেল্লাফতে!
এবারে আর স্বপ্নে না, সত্যি সত্যিই মেয়ে দেখতে এলাম। আতিথেয়তার কোন কমতি করা হলোনা। কিছুক্ষণ পর আমাকে আর অনামিকাকে আলাদা জায়গায় পাঠানো হলো বুঝাপড়া করার জন্য। অনামিকা মোটেই স্বপ্নে যেরকম দেখেছিলাম সেরকম না। মেয়ে যথেষ্ট রূপসী আর মায়াবতী। আমার চাওয়া যেমন ছিল এই মেয়ে তার চেয়ে কোন অংশে কম না, বরং আরো বেশীই হবে হয়তো!
আমি আর অনামিকা সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছি। অনামিকা হাসিহাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কি হলো জানিনা, হুট করে আমার মনে হলো এই মেয়ের সাথে আমার স্বপ্নে দেখা অনামিকার হুবহু মিল আছে। মাথাটা একটা চক্কর দিয়ে উঠলো। আমার মনে হলো অনামিকার পিস্তল ধরা ডানহাত আমার কপাল বরাবর উঠে স্থির হয়ে আছে।
অনামিকার সামনে হাতজোড় করে চাপা গলায় চিৎকার করে বলে উঠলাম, ” প্লিজ অনামিকা আমাকে মেরো না। আমার কোন রিলেশন নাই। আমার কোন এক্সও ছিলনা। আমার এইডসও নাই। ইচ্ছা হলে আমাদের সকল গহনাগাঁটি নিয়ে বিয়ের পর তুমি আসিফের সাথে পালিয়ে যেও। আমি কিছু বলবো না। প্রমিজ কিচ্ছু বলব না। তাও প্লিজ আমাকে মেরোনা অনামিকা। প্লিজ! দোহাই লাগে তোমার!” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলার একটু পর ঘোর কেটে যেতেই খেয়াল করলাম অনামিকা আমার থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
রাতে খবর এলো এই বিয়ে হবেনা। মেয়ের নাকি ছেলে পছন্দ হয়নি। মেয়ে জানিয়েছে সে সুস্থ মস্তিষ্কে একটা অসুস্থ মস্তিষ্কের উন্মাদ ছেলেকে বিয়ে করতে পারবেনা। খবরটা শুনে আমি যারপরনাই হতাশ হলাম। এবারেও আর বিয়েটা হলোনা আমার! আমার কিছু করার রইলোনা! মনে মনে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে যে, মোল্লার দৌড় নাকি মসজিদ পর্যন্ত, আমার দৌড় নাহয় মেয়ে দেখা পর্যন্তই থাক!