অনুপস্থিতি

অনুপস্থিতি

দিদিকে শেষ দেখেছিলাম ১৩ বছর আগে। তখন দিদির সবে ১৮ আর আমার ১৪ ।বুঝতে শেখার মত যঠেষ্ট বড় হয়েছিলাম।আমার আর দিদির সম্পর্ক টা ছিলো সাপ আর নেউল।দুই ভাই বোন ছিলাম যেনো শত্রুর চেয়েও অধম। পৃথিবীর সব খারাপ আমার পছন্দ হলেও দিদি ছিলো আমার দু চোখের কাঁটা।আমার জ্ঞান বয়সে ওর সাথে বসে দুটো ঠিক করে কথা বলেছিলাম কি না তা এখন মনে করতে কষ্ট হয়।

ওর সাথে ঝগড়া ছাড়া তেমন কোনো স্মৃতিও নেই।দিদি আমার কাছে অপছন্দের হলেও আমি ছিলাম ওর প্রাণ। শুনেছি ছোট থেকেই ওকে আমি খুব জ্বালাতাম আর বোকাটা চুপচাপ মেনে নিতো।হয়তো বড় ভাই- বোন গুলো ওমনি হয়। না ভাই বোনের ভালোবাসা কেমন হয় আমি জানি না।আমার বড় বোন থাকা সত্ত্বেও ভাই বোনের ভালোবাসা আমার জানা ছিলো না।

কেনো মেয়েটাকে আমার অপছন্দ ছিলো তা আমি জানি না।কারণ খুঁজেও কখনো পাইনি। ও কিন্তু আমার সৎ বোন না।একদম নিজের মায়ের পেটের বোন।কিন্তু আমার সব হিংসে ছিলো ওকে নিয়ে।সৎ বোনের সাথেও বোধ হয় এরম টা হয় না। কি সুন্দর করে ভাই বলে ডাকতো মেয়েটা আর আমি খুব বিরক্তের সাথে উত্তর দিতাম।ও তবুও কিচ্ছুটি বলতো না। হয়তো অনেক বেশি ভালো বাসতো তাই কিছু বলতো না।ভালোবাসা বোধ হয় ওরমি হয়।

ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করতাম বাবা থাকাকালীন বাবা আমায় বকতো।কিন্তু মা কখনো না।মা সবসময় ওকেই বকতো।মা’র চোখে আমার কোনো দোষি ধরা পরতো না।আমি হাজার টা দোষ করলেও দুজনের ঝগড়ার বিচার টা শুধু ওর একার উপর ই পরতো।তখন আমার কি যে খুশি লাগতো।মা ওকে খুব পেটাতো আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে মজা নিতাম।

দিদি যে একা আমার কাছে অপছন্দের ছিলো তেমন না।আমাদের পরিবারের প্রায় প্রতিটা লোকের কাছেই ও অবহেলিতো ছিলো। প্রতিটা লোক যখন ওকে ডাকতো তাদের ডাকের সুরের সাথে একটা ধমক ভাব থাকতো যেটা বাকিদের বেলায় থাকতো না।সব দেখতাম কিন্তু আমি কিচ্ছু বলতাম না। কারণ ও তো আমার শত্রু।আর শত্রুকে অবহেলা করলে আমার খারাপ লাগার প্রশ্নই থাকে না। আমাদের বাবা মারা যাওয়ার পর পর মা’র অন্যায় যেনো ওর প্রতি বাড়তে থাকলো সাথে আমি সহ পরিবারের প্রতিটা মানুষের।সবার কাছে মেয়েটা অবহেলিত।আমি কখনো কাওকে ওর সাথে ভালোভাবে ভালোবেসে কথা বলতে দেখেনি।কিন্তু ওকে অবহেলা করার কারণ টাই জানলাম না আজ অবদি।

কোনো উৎসব ছাড়া ওকে আমি নতুন জামা পরতে দেখেনি কখনো।আবদার করে কখনো কিছু চাইতেও দেখিনি।আসলে ওকে উৎসব ছাড়া কিছু দেয়া হতো না।ফোন টা বোধ হয় বাবার কারণে কেনা হয়েছিলো।নাহলে ওর বলে কোনো জিনিস ই থাকতো না। পরিবারের প্রতিটা মানুষের অবহেলা দিনের পর দিন দিদি সহ্য করে গেছে।কখনো কাওকে মুখ তুলে একটা উত্তর দেয় নি।চুপচাপ ছিল খুব।কখনো কখনো ও আমাকে কিছু বলতে চাইতো কিন্তু আমি দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতাম।

দিনের পর দিন মানসিক ভাবে কম অত্যাচারিত হয় নি আমাদের দ্বারা।মা নিজেও কিন্তু পারতো মেয়েটাকে আগলে ভালোবেসে রাখতে।কিন্তু না।মা সকাল বিকাল মুখ ঝামটা দিতেই থাকতো।খেতে খোটা দিতো।বসতে খোটা,শুতে খোটা কিসে না খোটা দিয়েছে তা আজ খুঁজি।

ওর একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো।পাশের এলাকার ছেলেটা।আমি ওদের কথা আরো নানিয়ে বানিয়ে মা’কে বলে দেই।ওমাহ তারপর কি পেটালো দিদিকে।মেয়েটার জায়গায় আমি বা অন্য কেও হলে কিছু তো বলতো।কিন্তু না দিদি একটা কথাও বলেনি। মুখ বুজে সব সহ্য করে যেতো।

বাবা মারা যাওয়াতে আমাদের চাইতে অনেক বেশি কাতর হয়েছিলো দিদি।ও যতটা না চুপচাপ তার চেয়ে অধিক চুপ হয়ে গিয়েছিলো।প্রয়োজনের বাহিরে একটা কথাও বলতো না।ঠিকঠাক খেতোও না।তার কারণ ছিলো মা।খাওয়া নিয়ে কম খোটা তো আর দিতো না সাথে সে সব অকথ্য ভাষা। শুনেছি বাবার মৃত্যুর পর পর ই ছেলেটার সাথে ওর বিচ্ছেদ হয়ে যায়।চারদিক থেকে শুধু অবহেলা।ডিপ্রেশনে চলে যায়। ও তো মানুষ।মন তো ওর ও আছে। আর কত!কম তো সহ্য করেনি।

ডিপ্রেশন থেকেই ওরম একটা কাজ হয়তো করার সাহস পেয়েছিলো।৩ এই ফেব্রুয়ারি ২০০২ ও আত্মহত্যা করে।আমাদের ঘরের সকালের সব কাজ দিদিই করতো।মা সেদিন সকালে উঠে দেখে কোনো কাজ করা হয় নি। সকাল সকাল উঠেই গাল মন্দ করছে দিদিকে। অথচ ওদিকে যে মানুষ টা শেষ হয়ে আছে সে খবর কি আমাদের আছে।

বেলা ১০ টা বেজে গেছে কিন্তু সেদিন দিদির ঘরের দরজা খোলেনি।মা অনেকবার ডেকেছে কিন্তু খোলেনি।সবাই উঠে যার যার কাজে চলে যায় কিন্তু ওদিকে দিদি তখনো উঠেনি।আমার মন টায় কেমন যেনো মোচড় দিলো।আমি জানি না কেনো।আমি দরজা ধাক্কাই । সেই বোধ হয় ওকে প্রথম দিদি বলে ডেকেছিলাম।এর আগে কখনো ভুলক্রমেও ওকে দিদি বলে ডাকিনি। অনেকবার ডাকলাম দিদি দরজা খোল বলে কিন্তু খোলেনি।দেখতে দেখতে সকাল ১১ টা বেজে যায় কিন্তু ও দরজা খোলে না।

ততক্ষণে সবার মনে একটা প্রশ্ন এলো দরজা কেনো খুলছে না।সবাই ওর রুমের সামনে দাড়াই।সবাই ডাকছি কিন্তু দরজা খুলছে না। তারপর দরজা ভাঙা হয় আর ভাঙার পর যা দেখি তা দেখার জন্য আমরা কেওই প্রস্তুত ছিলাম না। দেখি ফেনের সাথে একটা লাস ঝুলছে। লাসটার দিকে তাকাতেই দেখি একটা অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।হ্যাঁ, ওই লাসটা আর কারো না আমার দিদির ছিলো।আমার শত্রুর ছিলো। কিন্ত কি আশ্চর্য তখন আমার খুশি হবার কথা অথচ আমি কাঁদছিলাম। তারাতারি করে ওকে নামাতে যাবো তখন ই দেখি খাটের উপর একটা চিঠি। যাতে লিখা ছিলো মা আমি আর তোমাদের বোঝা হয়ে থাকলাম না।ভালো থেকো। ভাই এর খেয়াল রেখো।

থমকে গেলাম আমরা সবাই।তারপর তারাতারি করে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাই কিন্তু বাঁচানো সম্ভব হয় নি।হাসপাতালে নেবার ৩ ঘন্টা আগেই ও মারা গেছে।বাড়ি ফিরি দিদির লাস নিয়ে।দিদির শেষ কাজ নিজ হাতে সমাধান করলাম৷ মা অজ্ঞান ছিলো।জ্ঞান ফেরে ১ দিন পর। এখন সবার কত কষ্ট। কত ভাবনা দিদিকে নিয়ে।কত কান্না সবার।অথচ বেঁচে থাকতে মেয়েটার উপর কম অন্যায় করিনি সবাই মিলে।কত অপমান টাই করতাম।

ওর কোনো বন্ধু বান্ধব ও ছিলো না যে ওকে বুঝাবে।কেও ছিলো না ওর।একা কি কখনো কেও বাঁচতে পারে।আজ মানি দিদি তোর সাথে কত অন্যায় করতাম।বেঁচে থাকতে তোর মূল্য বুঝিনি।মা এখনও প্রায় ই কাঁদে।কিন্তু কি লাভ। তুই বেঁচে থাকতে যদি একটু বুঝতো।তাহলেই হয়তো তোকে এভাবে যেতে হতো না।কত খারাপ ব্যবহার করেছি।কখনো দিদি বলে পর্যন্ত ডাকিনি।অথচ আজ তোর ভাই ডাকটাকে মিস করি। আসলেই একটা মানুষের অনুপস্থিতিতে আমরা তাকে বুঝতে পারি।প্রতিটা মানুষকে আমাদের বুঝা উচিত।হারিয়ে বুঝে কোনো লাভ নেই।ফিরে পাওয়া যায় না।সময় থাকতে বুঝা উচিত!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত