‘পৃথিবীর মধ্যে দুইটা জিনিস পড়া যায়। এক বই, দুই বর। প্রথমটা যতটা না সহজ, তারচেয়েও কঠিন দ্বিতীয়টা। প্রথমটায় আমি গাধাদের সর্দারনী হলেও দ্বিতীয়টা আমি সিআইএ এর প্রধান। আর সে প্রকৃত বউ, যে তার বরকে পড়তে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছো, যাও। মাস্টারি করবে, করো। কিন্তু সাবধান! কোনও উঠতি যুবতির দিকে তাকাবে না। যদি তাকাও, আর আমি তোমার চোখ দেখে তা পড়তে পারি। তাহলে আমি তোমার মাথা ফাটাই ফেলবো। কথাটা মনে থাকে যেন।’
আমি নাস্তার টেবিলে বসে নাস্তার পাশাপাশি নাস্তানাবুদ হয়ে বউর ঝাড়ি খাচ্ছিলাম। এসব কথায় বরদের হু হা ছাড়া আর কোনও সদুত্তর থাকে না, থাকতে নেই। আজ একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করবো। এজন্য তার এতো ভয়। অথচ আমার বউ হিসেবে তার সবচেয়ে খুশি থাকার কথা ছিল। তার দোষই বা কী! আজকাল নাটক, সিরিয়াল, সিনেমায়, গল্পে যেভাবে শিক্ষকের ওপর মেয়েরা ক্রাশ খাচ্ছে, সে অসহনীয় দৃশ্য দেখে তার এমন আচরণ বা সন্দেহ অযৌক্তিক নয়। কিন্তু মুশকিলের বিষয় হলো সে আমাকে পড়তে পারে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনে দুই একটা বজ্জাত মেয়ের যে ক্রাশ হবো না, তা কি হয়? আর যদি সে আমার দুচোখ দেখে তা পড়তে পারে, তখন সত্যি কি আমার মাথা ফাটাই ফেলবে?
এসব কথা ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বের হলাম। মনে অজানা ভয়, কী যেন হয়, কী যেন হয়! এতোটা ভয় বাসরঘরেও পাইনি। বউ আমার আগুন গরম। দেশে শীতকাল এলেও আমার ঘরে গ্রীষ্মকাল থাকে। মাঝেমধ্যে ভাবী, আমার পরহেজগার শ্বশুর- শাশুড়ির মেয়ে এমন কী করে হলো? এই ভাবনা আরও জোরালো হয় তখন, যখন জাম্বিয়ার ওই নার্সের নির্মম ঘটনা মনে পড়ে। যে কি না নিছক মজা করতে গিয়ে পাঁচ হাজার নবজাতক শিশুকে অদলবদল করেছিল! তবে কি আমার শ্বশুর- শাশুড়িও এমন কোনও ঘটনার শিকার?
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম ক্লাস। কিছুটা নার্ভাস। ঘেমে যাচ্ছি কি না জানি না, তবে লেকচার দিতে গিয়ে থেমে যাচ্ছি বারবার। কারণ, ক্লাসে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা বেশি, আর তাই আমার ওপর ক্রাশ খাবার আশংকাও বেশি। এতো এতো সুন্দরী যুবতিদের দেখে কিঞ্চিৎ মনে হলো, এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে না করলেও পারতাম। কী এমন দরকার ছিল বিয়ে করার? পর ক্ষণে ভাবলাম, ছি ছি, কীসব ভাবছি। বউতো আমাকে পড়তে পারে, যদি পড়ে ফেলে!
আসলে সে আমাকে পড়তে পারে। আমার চোখ দেখে অনেক সময় আমার জানা, সবার অজানা তথ্যও বলে দিতে পারে। তাই তার মুখোমুখি হলেও চোখাচোখি খুব কমই হই। আর হলেও চোখের ভূমিকা থাকে ইদ্রিস ছাতার মতো। ঝড়ো হাওয়ায় ছাতাটা যতবার টাঙানো হোক না কেন, তার অধিকবার অটোমেটিক অফ হবে। কিছুদিন আগে একটা অফিসের চাকুরী থেকে বহিষ্কৃত হলাম। বাসায় ফিরে চুপচাপ সোফাসেটে বসে আছি। বউ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
– জব চলে গেছে?
– হুম!
– মহিলা বসের হাত ধরতে গেলে কেন?
– ইচ্ছে করে ধরিনি! কলম নিতে গিয়ে একটা আঙুল ছুঁয়ে ফেলেছি।
– পা ধরলে না কেন? জব ছাড়া এ সংসার চলবে কেমনে?
– দেখি। কিছু একটার তো ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ হবে।
– হুম, তাড়াতাড়ি যেন হয়। যাও, ফ্রেস হয়ে নাও। আর হ্যাঁ, গালে সেভলন লাগিয়ে দিও।
বসনি যে আমার গালে থাপ্পড় মারছে সেটা বউ কী করে জানলো তা না ভেবে তার মুখে সেভলনের কথা শুনে দৌড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি বসনির পাঁচটা আঙুলের দাগ ঝকঝক করছে। মনের দুঃখে আয়নাটা ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অথচ দোষটা কি আমার ছিল? এটা অনিচ্ছাকৃত ঘটনা। হাত থেকে কলম নিতে গেলে হাত লাগতেই পারে, খুব স্বাভাবিক। তাই বলে চড়! চড় মেরেও বসনি ক্রান্ত হননি। গড়গড় করে বলে গেলেন, ‘ফিমেইল দেখলে টাচ করতে ইচ্ছে করে, না? আজ থেকে ইওর চাকরি নট! আন্ডারস্ট্যান্ড?’
আমি বসনিকে এ ঘটনার কড়া জবাব দেবার জন্য ওনার ফেইসবুক আইডি খুঁজতে লাগলাম। যেহেতু ওনি ওনার পার্সোনাল নাম্বার কাউকে দেন না, সেহেতু এ ছাড়া আর কিছু করার উপায় ছিল না আমার। দেড়ঘণ্টা খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে ওনার আইডি সনাক্ত করলাম। ওনার চড় খেয়ে যতটা না বুঝেছি ওনি সাংঘাতিক নারীবাদী, তারচেয়েও বেশি বুঝেছি ওনার প্রোফাইল স্ট্যাটাস দেখে। যেটা ছিল_”ধরি মাছ না ছুঁই পানি, এমন টাইপ পুরুষের হবো আমি খুনি।”
এইমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের প্রথম ক্লাস শেষ করলাম। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্রই জান্নাত নামের এক সুন্দরী ছাত্রী এসে বললো, ‘স্যার আজ আমার ২১তম জন্মদিন আর আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা জীবনের প্রথমদিন। এই দিনটাকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে আপনার মুখোমুখি বসে চোখাচোখি করে এক কাপ চা খেতে চাই। প্লিজ না করবেন না স্যার।’ আমি আবার কোনও সুন্দরী মেয়েদের কথা অগ্রাহ্য করি না। হয়তো করতে পারি না। এটা আমার হরমোনের সমস্যা, তবে আমার না। তাই আগেপাছে কোনও কিছু না ভেবে মুখের ওপর হ্যাঁ বলে দিলাম।
জান্নাতের মুখোমুখি বসে আছি। চোখাচোখি হচ্ছে। চায়ের মধ্যে মাদকতা ছড়াচ্ছে। আমি বেমালুম ভুলে যাচ্ছি আমার বউ যে আমার দুচোখ পড়তে পারে। নেশারঝোঁক কাটার আগেই জান্নাত বলে ওঠলো, ‘আমার চোখে তাকিয়ে নিশ্চয় হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্য জগতে? এভাবে অনেকে হারায়! জানেন স্যার? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কোনও রিকশাচালক বেশি ভাড়া চাইতে পারে না।’ আমি আমতাআমতা করে বললাম, ‘হুম, তোমার চোখে যাদু আছে।’ মেয়েটা মুচকি হাসি দিয়ে লাজুকতা ঠোঁটে এঁকে বললো, ‘না স্যার, যাদু নয়! এটাকে বলে মায়া।’ চা-বাজি শেষে গন্তব্যে ফেরার পথে মেয়েটা আমার হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে বললো, ‘বাসায় গিয়ে নিরিবিলি পড়বেন।’
আমি চিরকুট হাতে নিতেই অভ্যন্তরীণ পৃথিবীতে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেলো। এই রকম একটা চিরকুট পেয়েছিলাম স্কুল জীবনে। বইয়ের ভেতর তা লুকিয়ে রেখেছিলাম। একদিন আম্মু তা পেয়ে যান। আহ, সেদিন কী পেঁদানিটাই না তিনি দিয়েছিল। পেঁদানি খেয়ে জন্মের তরে পিরিতের নাম ভুলে গিয়েছিলাম। আর আজ যদি আমি বউয়ের হাতে ধরা খাই, তাইলে নির্ঘাত মরণ! হাঁটতে পারছি না, পা ভীষণ কাঁপছে। তাই তড়িঘড়ি করে একটা রিকশায় ওঠলাম। ওঠতেই রিকশাচালক বললো,
– স্যার, কই যাবেন?
– শনির আখড়া। আজ আমারে শনি-এ পাইছে।
– বুঝলাম না স্যার কী কইতাছেন?
– বুঝবার দরকার নাই। একটা হেলমেটের দোকানে নিয়ে চলো।
– হেমলেটের দোকান কোনখানে, মুই জানি না স্যার।
– না জানলে ট্রাফিকপুলিশকে জিজ্ঞাস করো।
– জ্বি আচ্ছা।
আমি মহাবিপদ সংকেত বুকে পোষে আর চোখেমুখে সুনামি আতঙ্ক নিয়ে চিরকুট খুলতে লাগলাম। গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মতো টুপটাপ ছন্দে মরণানন্দে পড়তে লাগলাম। শিরোনাম পড়েই কয়েকটা শুকনো ঢোক গিললাম_/আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই\
আপনি কি আমার ভুলে ভরা অতীত কে মেনে নেবেন? আমাকে ভালোবাসতে হবে না খুব বেশি। তবে আমার অনুভূতি গুলো যেন বোঝার চেষ্টা করেন। আমাকে অন্তত যেন ভুল না বুঝেন। আমাকে প্রায়োরিটি দেওয়ার দরকার নেই। আমি চাই আপনি আপনার বাবা-মা এবং ভাই-বোনের পরে আমাকেও আপনার পরিবারের একজন ভাবুন। আমার অন্যায় দেখলে শাসন করুন। আমি অনেকগুলো সন্তানের মা হতে চাই। আর এটাতে আপনি যেন এক পায়ে রাজি থাকেন। আমি চাই আপনি হোন আমার একাধিক সন্তানের বেস্ট বাবা। আমার বাচ্চাকাচ্চা অনেক ভাল্লাগে। এতদিন মনেমনে বোকাসোকা গাধা টাইপের সুদর্শন বর খোঁজছিলাম। আল্লার অশেষ রহমতে আপনাকে পেয়ে গেলাম। তাই এই চিরকুট লেখার দুঃসাহস করেছি। রাজি আছেন তো স্যার? চিরকুট পড়ে আমার মাথা ভনভন করতে লাগলো। মাথা ঘুরছে নাকি দুনিয়া ঘুরছে বুঝতেছি না। রিকশাচালককে ধমক দিয়ে বললাম,
– এখনো হেলমেটের দোকান পাওনি?
– না স্যার, টেরাফিক পুলিশ রে খোঁজতাছি।
– পাওনি?
– এখনো পাই নাই।
আর সব দিন ঘুষ খাওনের লাইগা যেখানেসেখানে দাঁড়াই থাকে। আজ দরকারে খোঁজতাছি, অখন সবকটা ইস্কয়ার কোম্পানির ঔষধ হই গেছে। কথা শেষ না হতেই রিকশাচালক বলে ওঠলো, ‘স্যার, ওই দেখা যাইতাছে পুলিশ। চিন্তা কইরেন না।’ ট্রাফিকপুলিশের সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে রিকশাচালক পুলিশকে বললো, ‘স্যার, হেমলেটের দোকান কোন দিকে? এই স্যারে খোঁজতাছেন।’ ট্রাফিকপুলিশ আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চেকিং দৃষ্টিতে চোখ বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– আপনার মোটরবাইক কোথায়?
– না, মানে! আমি এখনো কিনিনি!
– বাহ, আপনি তো বেশ সচেতন লোক। বাইক কেনার আগে হেলমেট কিনতে চাচ্ছেন। ইস, আপনার মতো যদি সবার এই শুভবুদ্ধির উদয় হতো, তাহলে দেশটা অনেক আগেই এগিয়ে যেতো।
– আসলে তা না। বউয়ের হাত থেকে মাথাটা রক্ষার উদ্দেশ্যে এই অভিনব পন্থার আশ্রয় নিতে যাচ্ছি। আজকে একটা মহা অন্যায় করে ফেলছি। এই অন্যায় থেকে আমার মাথার মাফ নেই। দোয়া করবেন।
ট্রাফিকপুলিশ আমার দিকে মারমুখী নজরে তাকিয়ে আছে। কী বলবে হয়তো বুঝতেছে না। রিকশাচালক পুলিশের অবস্থা বেগতিক দেখে জোরেশোরে প্যাডেল দিতে লাগলো। কিছুদূর যেয়ে বললো, ‘কথা খান গায়ে নিয়েন না স্যার। আমরা এক আজব দেশে বাস করি। যাগো মোটরসাইকেল আছে, তাগো হেমলেট নাই। আর যাগো মোটরসাইকেল নাই, তারা হেমলেট কিনবার চায় শুধুমাত্র বউর হাত থেকে মাথা বাঁচাইতে আর পিঁয়াজের ঝাঁজ ঠেকাইতে। মুই তাগো রে বিলাই মার্কা বেডা কই।
বুঝবার পারি না, কারা তাগো রে বিয়া করনের লাইসেন্স দেয়? আর তারা বউ চালানোর কী বালডা বুঝে! অবশ্যই এইডা তাগোর দোষ না, আমাগো সিস্টেমের দোষ। আমাগো জাতির সিস্টেমটাই হেমলেটের মতোন__রাস্তায় মাথা দিমু, তয় হেমলেট পরমু না।’ যদিও রিকশাচালকের কথায় অনেক যুক্তি আছে, তবুও আমার আত্মসম্মানে খুব লাগছে। কারণ আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এখন হেলমেট পরে বাসায় ঢুকছি। বউকে আজ মরে গেলেও চোখমুখ দেখানো যাবে না। আমাকে দেখামাত্র বউ উল্লাসে চিৎকার করে উঠলো,
– তুমি বাইক কিনেছো?
– না, শুধু হেলমেট! বউ রাগান্বিত হয়ে বললো, কেন?
– মাথায় শুধু ঘিলু থাকে না, শয়তানও থাকে। আর এই দুটোকে রক্ষা করা একজন বিবাহিত অর্ধমৃত পুরুষের নৈতিক দায়িত্ব। বউ আমার দুই বাহু ধরে বললো,
– দেখিতো তোমার মুখটা?
– না, চোখমুখ কোনটাই আজ তোমাকে দেখানো যাবে না।
আমার মুখের না মানে না। সে ভালো করেই জানে। আর তাই কুস্তিগিরের মতো আমাকে সে বিছানায় ফেলে দিয়ে তুমুল হাতাহাতির যুদ্ধ সহিত হেলমেটের মুখ খুলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্যর্থতার এক পর্যায়ে এসে নিজেই হেলমেট খুলতে বাধ্য হলাম। বউ আমার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি মনে মনে প্রার্থনা করছি আজ যেন সে আমার চোখকে পড়তে না পারে। যদি পড়তে গিয়ে সে জান্নাতকে পেয়ে যায়, তাহলে আমি শেষ, আমার সংসার শেষ। আমি ভয়ার্ত ইঁদুরের মতো মুখটা সরু করে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
– কী দেখছো অমন করে? সে আমার শার্টের কলার টেনে ধরে ডান কানটা তার মুখের কাছে নিয়ে বললো,
– এক টুকরো জান্নাত।