শাশুড়ি

শাশুড়ি

নতুন বউ ঘরে আসলো। দীর্ঘ সময় চেহারায় তাকিয়ে থাকলাম। ভালোবাসা নিয়ে। বড় বড় চোখ করে বলল, এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন, টিকলিটা মনে ধরেছে বুঝি? আমার মেয়ে নেই। একটাই ছেলে। খুব করে চেয়েছি একটা মেয়ে। মেয়ে নাকি ঘরের লক্ষী। মায়ের আপন হয়। একজন মা সব কথাই মেয়ের সাথে বলতে পারে। মায়ের পরম বন্ধু নাকি হয় মেয়ে। সে জন্য খুব করে চাইতাম। কিন্তু কোনো মেয়ে সন্তানই আমার হলো না। আমার স্বামী আমাকে শান্তনা দিয়ে বলতো, মেয়ে হয় নি তো কি হয়েছে? তুমি মন খারাপ করছো কেন, তোমার তো ছেলে আছে। ছেলেকে বিয়ে করালেই তো মেয়ে পাবে। আমি বললাম, সে কি আর পেটের মেয়ের মতো হবে? হবে, হবে, হবে না কেন। তার থেকেও ভালো হবে। তুমি তো খারাপ না। খারাপদের জন্য খারাপ জোটে। ভালোদের জন কখনো খারাপ আসে না।

স্বামীর কথায় আমি শান্ত হলাম। প্রতীক্ষায় থাকলাম ছেলের বউয়ের। প্রথম দিন আসার পর আমি ফাঁক খুঁজছিলাম। কখন ভালো করে মেয়ের চোহারাটা দেখবো। কখন ওকে জড়িয়ে ধরবো। মেহমান চলে গেলে বাড়িটা একটু ফাঁকা হয়। মেয়েটা বসে আছে বাসরে। আমি হাতের কাজ ফেলে রুমে ঢুকলাম। ঘোমটা তুলে অপলক নেত্রে তাকিয়ে থাকলাম। ওর চোখ, নাক, ভ্রু, কপাল সব খুটে খুটে দেখছি। কত আপন মনে হচ্ছে আমার। কত যুগযুগ ধরে ওকে আমি চিনি। ভাবনার সাগরে যখন হারিয়ে গেলাম তখন মেয়েটা বলল, এমন করে তাকিয়ে আছেন কেন, টিকলিটা মনে ধরেছে বুঝি?

আমি মুচকি হাসি দিয়ে বললাম, না, মা। টিকলি না। তোমায় মনে ধরেছে। আমি যেমন চেয়েছি তুমি একদম সেরামই। আপনাকে একটা কথা বলবো? হু, বলো! আমাকে একটু পানি খাওয়াতে পারবেন? অবশ্যই পারবো। পানি এনে ওকে দিলাম। একটা গ্লাসে করে। গ্লাসটা ও চোখের সামনে তুলে ধরলো। ভালো করে পরখ করলো। মুখ দিয়েও কেন যেন দিল না। পানি শুদ্ধ গ্লাসটা রুমের কোণায় ছুড়ে মারলো। বলল, এই ময়লা গ্লাসে কেউ পানি খায় নাকি? আমি বললাম, ময়লা ছিলো? দেখেন নি, বোধ হয় আপনি, না? না, আমি তো পরিষ্কারই দেখলাম। আমাদের কথার মাঝে আমার ছেলে রুমে ঢুকলো। হতবম্ব হয়ে বলল, কি হয়েছে মা? কি ভাঙ্গলো? কিছু না বাবা। গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে গেল।

আমি রুম থেকে বেরিয়ে এসে একটা গ্লাস পরিষ্কার করলাম ভালো করে। নতুন পানি নিয়ে বউয়ের সামনে দিলাম। হাসি দিয়ে বললাম, নাও, এবার পান কর। মেয়েটাও একটা হাসি দিল। মিষ্টি হাসি। হাত বাড়িয়ে আমার থেকে গ্লাস নিয়ে অর্ধেকটার মতো পান করে আমাকে দিল। বলল, শুকরিয়া। আর বেশিক্ষণ থাকা আমার জন্য সমুচিত হবে না। গ্লাসটা হাতে করে বেরিয়ে আসলাম। আমার বউকে কখনো বউ হিসেবে দেখি নি। আপন মেয়ের মতো দেখেছি। আরেক পরিবেশ থেকে এসেছে। আমরা থাকি এক পরিবেশে। আমাদের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে অবশ্যই তার কষ্ট হবে প্রথম প্রথম। কারণ আমিও তো একদিন বউ ছিলাম। আরেক পরিবেশ থেকে আমিও নতুন একটা পরিবেশে এসেছি। কত কষ্ট হয়েছিলো তখন আমার!

সেই সকালে ঘুম থেকে উঠতাম। একান্নভুক্ত পরিবার। সকালের নাস্তা ছিলো গরম ভাত। কাজে যাওয়ার আগে সবাই ভাত খেয়ে যাবে। আমি, আর শাশুড়ি সেই ফজরের সময় উঠতাম। রান্না বান্না সেরে সবাইকে খাইয়ে তবেই আমরা খেতাম। কাজ করতে মন চাইতো না। তারপরও করতাম। মুখ ফুটে শশুর শাশুড়ি কোনো কথা বলা লাগে নি। আগ বাড়িয়ে করেছি। সে সময়ের কথা ভিন্ন। এ সময়ের মেয়েরা তো আধুনিক। সবাই ভালো করে চলতে চায়। কাজ কাম একটু কম করতে চায়। আমার মেয়ে থাকলে সেও নিশ্চয় এমনই করতো। এ চিন্তা থেকে বউকে আমি কোনো কাজ করতে বলি না। যতটুকু তার মনে চায় অতটুকুই করে। নামাজ পড়তে উঠে আমি আর ঘুমাই না। নাস্তা তৈরি করি। ছেলেটা অফিসে যায় সকাল আটটায়। আটটার আগেই তৈরি হয়ে যায়। নাস্তা খেয়ে ও চলে যায় অফিসে। আমি টেবিলের উপর বউমার জন্য নাস্তা ঢেকে রাখি। এরপর বিছানায় পিঠ লাগাই। দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ ও উঠে। পরিষ্কার হয়ে নাস্তা খেয়ে টিভির সামনে বসে। দীর্ঘ একটা সময় বসে থাকে।

আজকে দুপুরে কি রান্না হবে? ফ্রিজে তো আছে কেবল মাছ, মাছই রান্না করবো। হু, একটু বেশি করে ঝাল দিয়েন। আমি বললাম, আমি তো ঝাল খাই না। তো? আমরাও খাবো না নাকি? আচ্ছা, ঠিক আছে, কোনো ঝাল দেওয়ার দরকার নেই। আপনি যেমন খান তেমনই রান্না করেন। আমার একটা ডিম ভাজি হলেই চলবে। না ডিমেও ঝাল দিয়ে বসবেন। ভাগ বসাতে! বউ মা, এমন কথা বলো না। আমি ভাগ বসাবো কেন? কেন বসান সে তো আপনিই ভালো জানেন, আমায় জিজ্ঞেস করছেন কেন? আর আপনি বাসায় চোখ দুটো সাথে নিয়ে চলেন তো নাকি? কেন বউ মা? তোমার কি মনে হয়? আমার তো মনে হয় আপনি চোখ বন্ধ করে চলেন। চোখে হাত দিয়ে চলেন। কেন এমন মনে হচ্ছে?

মনে হবে না কেন এমন? হু, কেন মনে হবে না। ঘর যে এমন নোংরা হয়ে আছে আপনি দেখছেন? চোখ সাথে থাকলে তো ঠিকই দেখতেন, কি দেখতেন না? কয়দিন হয়েছে ঘর মুছলেন, এতো সুন্দর ঘর সপ্তাহের আগা মাথায় মুছলে হয়? এই দেখেন এই, পায়ের তালু কেমন ময়লা হয়ে গেছে? এ বলে সোপায় বসে থেকে আমার চোখের সামনে ওর পায়ের তালু তুলে ধরলো। সত্যি, ময়লা হয়ে আছে। কালো হয়ে আছে। ওর সুন্দর ফকফকা শাদা পায়ের পাতা কেমন কালো বিশ্রি হয়ে আছে। বললাম, একি মেঝের ময়লার কারণে? ও বিদ্রুপ করে বলল, না, ছাদের ময়লার কারণে! দাঁড়াও এখনি আমি মেঝে পরিষ্কার করছি। শুধু পরিষ্কার করলে হবে না। ঘসে ঘসে ময়লা উঠাতে হবে। যান, বালতি করে পানি নিয়ে আসেন। দেখিয়ে দেই, কেমন করে পরিষ্কার করতে হবে।

আমি বালতি করে পানি আনলাম। হালকা একটু পাউডার দিলাম। আমার বউ আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি মেঝের দিকে মুখ করে ঝুকে দু হাতের শক্তি প্রয়োগ করে কালো দাগ তোলার চেষ্টা করছি। বউ পাশে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে ইশারা করছে। কোথায় কোথায় ময়লা দেখিয়ে দিচ্ছে। আমি আমার বউয়ের সব কথা শুনি। ও যা বলে আমি তাই করি। সংসারের কোনো কষ্ট ওকে সহ্য করতে দেই না। সব নিজের মাথার উপর নিয়ে নেই। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করি, এক দিন হয়তো আমার বউ আমাকে মা বলবে। আমার মেয়ে হয়ে যাবে। আমাকে বুকে টেনে নিবে।

পাঁচ বছর হয়ে গেল। মেয়ে হবার ছিটে ফোটাও আমি দেখি না। দিন দিন আগের তুলনায় আরো রুঢ় হয়ে যাচ্ছে ওর স্বভাব। শরীরটা আমার অসুস্থ্য হয়ে গেল। বার্ধক্যের কারণেই হবে। ঠিক মত ঘুম থেকে উঠতে পারি না। কাজ কামও করতে পারি না। ছেলেকে বললাম, একজন কাজের লোক রাখ। ছেলে বলল, হু, রাখবো। আমি আজকেই খোঁজ লাগাবো। এখন তো সব পাওয়া যায় মা, কেবল ঐ কাজের মেয়ে পাওয়া যায় না। গেলেও ওদের ডিমান্ড বেশি। তুমি চিন্তা করো না। এক দুদিনের মধ্যে আমি ব্যাবস্থা করে ফেলবো।

বউ বলল, কাজের মেয়ের দরকার নেই। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। আমার কোনো কাজ নেই। তোমার মায়েরও কাজ নেই। দু জন মিলে কাজ করলে তো কোনো কাজ থাকে না। ছেলে বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে তুমি আজ থেকে মাকে সাহায্য করো। আজ থেকে সাহায্য করো মানে কি? আগে আমি তোমার মাকে সাহায্য করতাম না? আহা! চটছ কেন? আমি তো বলি নি তুমি সাহায্য করতে না। না, তুমি এইটেই বললে। বুঝিয়েছো, তোমার মাই এ সংসারের সব কাজ করে। আমি কেবল বসে বসে খাই। দেখ! একবারও আমি স্পষ্ট করে তোমায় কিন্তু এরাম কিছু বলি নি। স্পষ্ট করে না বল, তোমার কথায় তো এটাই বুঝে আসে।

দরজায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনলাম। খুব জোরে হচ্ছিলো কথাগুলো। এমনিতেই শোনা যায়। হটাত করে দরজা খুলে গেল। আমি হকচকিয়ে গেলাম। আমার দিকে তাকিয়ে সাপের মতো ফোস ফোস করে ফনা তুলতে লাগলো আমার বউ। মুখটাকে দলা করে বলল, ও, বউ ছেলের ঝগড়া লাগিয়ে আবার কান পেতেও শোনা হচ্ছে, না? ছেলে কেমন করে বকে আমায় তাই শুনছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে! সংসারের সব কাজ আপনিই তাহলে করেন,তাই? আমি কিছু বলি নি। মাথা নিচের দিক করে ফিরে আসলাম। আমার একটা নাতি আছে। ছোট। ফুটফুটে। মিষ্টি চেহারার। ও আমার সাথে থাকতে পছন্দ করে। আমাকে নিয়ে ও মন মত খেলা করে। শহর তো, খেলার আর কোনো সাথি নেই।

ও আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। স্কুলে ভরতি হয়েছে। ও পড়তে চায় না। পড়লেও সারা দিন পড়ে না। কিছু সময় বসে। বাকি সময় আমার সাথে কাটায়। বিষয়টা ওর মায়ের কাছে খারাপ ঠেকলো। কম মিশতে দেয় আমার সাথে। আমি ডাকলে ধরে রাখে। দরজা লাগিয়ে একটা রুমে পড়াতে থাকে। আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলেও নাতি পারে নি। চুপি চুপি আমার কাছে চলে আসে। ওর মা সরলেই দৌঁড়ে আমার কাছে চলে আসে। আঁচলের নিচে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা এলিয়ে শুয়ে থাকে। এক দিন বউমাকে বলতে শুনলাম, বলছে, ছেলেটার পড়াশুনা হচ্ছে না। কেন?

সারা দিন কী সব গল্প করে। পড়াশুনা বাদ দিয়ে কেবল গল্প শুনে। আর তোমার মায়ের কোলে পড়ে থাকে। কি বলছো তুমি? হু, ঠিকই বলছি। বলি কি, যদি রাগ না কর তাহলে একটা কথা বলবো। বল, কি বলবা। তোমার মাকে কয়েক মাসের জন্য গ্রামে পাঠিয়ে দিলে হয় না? কেন? ছেলের সামনে পরিক্ষা। ভালো রেজাল্ট তো করা লাগবে। পরিক্ষার পর আবার না হয় নিয়ে এসো! আমার ছেলে কিছু বলল না। আমি আমার কাজে চলে গেলাম। কখন যে চোখে পানি চলে আসলো বুঝলাম না। নাতি ওর তুলতুলে কোমল হাত দিয়ে আমার চোখের পানি মুছে বলল, দাদি মা, তুমি কাঁদছো কেন? কথা ঘুরাতে বললাম, তুমি হাতের লেখা লিখেছো? হু, শেষ করে এলাম। যাও, টেবিলে গিয়ে বস। আরো কিছু লিখে নাও। না, লিখবো না। আস না, আমরা গল্প করি! হাতের কাজ শেষ হোক। আচ্চা, তুমি আস বারান্দায়। তোমার অপেক্ষায় আছি।

আমি জানি ছেলে আমাকে কোনো ভাবেই বাড়িতে রেখে আসতে চাইবে না। আমি নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিলাম চলে যেতে। আমার নাতি যদি শিক্ষীত হয়, রেজাল্ট ভালো হয় তবে তো আমারই গর্ব, তাই না? গ্রামের বাড়িতে বাবা মা না থাকলেও আছে আমার ভাই। আমি বললে ওদের সাথে আমাকে থাকতে দিবে। ওর সংসারের সদস্য করে নিবে আমাকে। ছেলেকে মনের কথা বললাম। আমাকে দিয়ে আসতে বললাম। ছেলে প্রথমে রাজি হচ্ছিলো না। পরে রাজি হলো। শুক্রবারে আমাকে আমার বাপের বাড়ি দিয়ে আসবে। বের হবার কিছুক্ষণ আগে আমার ছেলে আমাকে বলল, মা, তোমার কাপড় গোছাবে না? বললাম, হু, গুছিয়েছি। কোথায়, দেখছি না তো। দেখি তোমার ব্যাগ? আমি জানি ছেলে আমার কাপড় দেখতে ব্যাগ দেখছে না। বাসা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নিয়ে যাচ্ছি কিনা তাই দেখবে।

খাটের নিচ থেকে ব্যাগ বের করলাম। ব্যাগের সেইন খুলে মেলে ধরলাম। বললাম, দেখ, এই যে, এগুলো আমার কাপড়। ব্যাগটা মেঝেতে ঢাললো। কাপড় সব মেঝেতে পড়লো। কাপড়ের ভাঁজে লুকানো ছিল দুটো ছবি। খাট থেকে নেমে আমি জলদি ছবি দুটো বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম। দুটো তে আদর করলাম। ছেলে বলল, কার ছবি এগুলো? আমি কিছু বলি না। বুকের সাথে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ছেলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আমার চোখে তাকালো। আমার চোখ ভেজা। হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, তুমি কার ছবি নিয়ে যাচ্ছ?

আমি কিছু বলি না। আমার হাতের নিচ থেকে ছবি দুটো বের করলো। ওর চোখের সামনে তুলে ধরলো। একটা ছবি নাতির। আর একটা বউমার। আমার মেয়ের। ছেলেটা ছবি থেকে মুখ সরিয়ে আমার চেহারায় হা করে তাকিয়ে থাকলো। আমি একবার ওর চেহারায় তাকিয়ে মেঝেতে বসে গেলাম। কাপড়গুলো আবার ব্যাগ ভরতে লাগলাম। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। একটু দেরি হলেই যে ট্রেনটা মিস হয়ে যাবে!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত