পকেটমার স্ত্রী

পকেটমার স্ত্রী

– ভাইয়া বিয়ের করার পর থেকে প্রায় খেয়াল করতাম, ভাবী আমাদের ঘরের জন্য অনেক নতুন নতুন জিনিস
কেনাকাটা করতো। বেশিরভাগই আসবাবপত্র।
– মাঝেমাঝে আমার কলেজ ভাড়াও উনিই দেয়। কিন্তু আমার মনে তখন থেকে একটা কৌতূহল হতো।
আচ্ছা , ভাবী জবও করেনা।
এছাড়া ভাইয়ের বেতনের পরিমানটাও এত বড় নয় যে, মাসে মাসে ভাবীকে হাত খরচের আলাদা টাকা দেবে।
কিন্তু ভাবীর কাছে টাকা চেয়ে আমি কখনও ফেরত যাইনি।
তবে ভাবীর এই টাকার উৎস কি!

এই কৌতুহল নিয়েই প্রায় আমার কলেজ লাইফটা শেষ করলাম। তারপর ভার্সিটিতে এ্যাডমিশন দিলাম।
এরপর মেসে উঠলাম।
– বাড়ি থেকে যে টাকা দিতো, তাতে আমার টেনেটুনে চলতো। কিন্তু বন্ধুরা যখন বিভিন্ন ট্যুরে যেতো বলতো তখন আমি প্রথমে ঠিকই না করে দিতাম, যাবো না ।
– পরে ভাবীর সাথে শেয়ার করলে ভাবী বলতো, চিন্তা করিস না। আমি আছি না! আমিই তোর যাওয়ার ব্যবস্থা করবো।
এরপর ভাবী ভাইয়ার থেকে ছেয়ে কারো কিছু টাকা নিয়ে আমাকে ঠিকই পাঠিয়ে দিতেন।
– কিন্তু আমার রহস্য কমেনা, বরং বাড়ে।
সেদিন আমাকে টাকা পাঠিয়ে ভাইয়া নাকি ভাবিকে খুব জেরা করছিলো। তুমি এত টাকা পাও কোথায়!
মাঝেমধ্যে দেখি আদির হাত খরচ দাও, ঘরের টুকটাক জিনিস কেনো।
ভাবি কাচুমাচু করে এড়িয়ে গেলো।
– ভাইয়াও নাকি আর জোর করে জানতে চায়নি। এর কিছুদিন পর, আমি একদিন বাড়ি আসলাম।
বাড়ি এসে দেখলাম, ভাইয়া ভাবীর প্রচুর ঝগড়া হচ্ছে।
ঝগড়ার এক পর্যায়ে মা ও বলছিলো, এত টাকা তোর বউ পায় কই?
আমার তো আর রাজার ভান্ডার নাই যে, চাইলেই টাকা খসে পড়ে। এই মেয়ের নিশ্চয়ই এমন বাজে কোন স্বভাব আছে। যা দিয়াই টাকা পয়সা পায়।

আমি মাকে রেগে গিয়ে বললাম, ছিঃ মা। তোমার ছেলের বউয়ের নামে এগুলো বলতে তোমার খারাপ লাগছেনা মা!
– মা চিৎকার করে বললো, নাহ খারাপ লাগেনা। ও টাকা কই পায় বললেই তো হয়!
আমার মাথায় তখন একটা কথাই আসলো। আচ্ছা, এত মানুষ এত কিছু বলছে, ভাবী কেনো সত্য কথা বলছেনা!
ভাবী মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে গেলো।
দুপুরে, রাতে সেদিন আর কিছু খায়নি ভাবী ।
– পরদিন ভাবী সকালবেলা বাবার বাড়ি রওয়ানা হলো।
অমনি মা অসুস্থ হয়ে গেলো। ভাইয়া আর আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম। আমি ভাবির হাত ধরে বললাম, ভাবী এই দুঃসময়ে তুমি অন্তত আমাদের ছেড়ে যেওনা।
ভাবী রয়ে গেলো।

যেহেতু মাসের শেষ ছিলো। ভাইয়ের হাতেও তেমন টাকা পয়সা ছিলোনা। মাকে নিয়ে কি করবে, ভাইয়া দিশেহারা হয়ে গেলো।
একসময় ভাবীর দু ‘হাত ধরে ভাইয়া বলল, রাইসা তুমি দেখোনা কোন টাকা পয়সায় ব্যবস্থা করতে পরো কিনা!
মাস শেষ, ছোট চাকরি করি চাইলেও তো কারো কাছে এই মুহুর্তে ধার পাবোনা।

ভাবী ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে কিচ্ছু না বলে রুমে চলে গেলো। অনেকগুলো দশ, বিশ টাকার নোট নিয়ে ভাইয়ার হাতে দিলো।
আমরা অবাক হয়ে খুচরো টাকাগুলো গুনছি, দেখলাম প্রায় তিন হাজার টাকার মতো।
– তুমি এত টাকা কোথায় পেলে রাইসা?
তাও আবার সব খুচরো টাকা!
– ভাবী তখন বললো, তুমি সকালবেলা যখন প্রতিদিন গোসলে যেতে আমি তোমার পকেট থেকে দশ, বিশ টাকা আলাদা করে রাখতাম।
কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি চোর না।
তোমার সংসারের টানাপোড়েনের কথা ভেবেই আমি এটা করতাম। মনে হতো, কিছু টাকা সেইভ করলে হয়তো একসময় আমাদেরই কাজে লাগবে।
– আমি ভাবীর মুখে এ কথা শোনার পর , অবাক হয়ে গেলাম। একটা নারী চাইলে কত ভাবে সংসারে অবদান রাখতে পারে!
ভাইয়াও চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, তোমাকে আমি অনেক ভুল বুঝেছি। প্লিজ ক্ষমা করে দিও আমায়।
আর চোর হবে কেনো তুমি? আমার টাকা কি তোমার টাকা নয়!
হয়তো আমি নিজ থেকে দেইনি, কিন্তু তুমি যে বুদ্ধি করে এই টাকা আলাদা করে রেখেছো এইতো অনেক।
তাছাড়া তুমি তো নিজের জন্য খরচ করোনি। বরং, আমার পরিবারের জন্যই সবটা চেষ্টা করেছো।
– এখন কথা বলার সময় নয়, মাকে আপাততঃ একটা ডাক্তার দেখাও। পরে খারাপ ভালো কিছু হলে আগামী মাসে হসপিটালে এ্যডমিট করিয়ে দিও ভাবী বলল।
পরে আমি আর ভাইয়া মাকে হসপিটালে নিয়ে গেলাম। তেমন কোন সমস্যা মায়ের ধরা পড়েনি। বয়সের ভারে শারীরিক দুর্বলতা এইটুকুই।
সেদিন ভাবীকে নিয়ে আমি খুব গর্ববোধ করেছিলাম ভেতরে ভেতরে।

আজ আমার স্ত্রী নামিরাকে নিয়ে করি। ও কিন্তু ভাবীর মতো পকেট থেকে টাকা নেয়। ভাবীরটা ভাইয়া দেখতোনা। কিন্তু নামিরার টাকা নেওয়া আমি প্রতিদিনই দেখি।

ভেতরে ভেতরে হাসি। কোনদিন কিচ্ছু বলিনি। কারণ আমার জবটা ভালোই। তাছাড়া শহুরে সংসারের খরচ বেশি বলে ওই প্রায় অনেকটা সামলে নেয়।
আমি সবটা বুঝি তাই চুপ করে ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখি আমাদের সংসারটাকে।

বিঃদ্রঃ (প্রত্যেক সংসারে এক সময় এরকম পকেটমার স্ত্রী ছিলো। যখন হয়তো আমাদের ছোটবেলাটা সোনালি ছিলো। আজকের সময়ে এসে এরকম পকেটমার স্ত্রী আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি সত্যিই থেকে থাকে,তবে সংসারের কিছুটা হলেও তাদার অবদান আছে। তাদের প্রতি সম্মান আমার বরাবরই। কারণ এরকম মায়েরা ছিলো, আছে বলেই আজও অনেক সন্তানকে বাবার কাছে টাকা চাইতে হয়না। মায়ের আঁচল কিংবা লুকানো টাকায় তাদের এক মাত্র ভরসা হয়ে ধরা দেয়। একদিন এরকম সংগ্রামী মায়েদের সন্তানেরাই হয়তো, বিজয়ের পতাকাটা ওড়নায়)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত