আমার ছেলেবেলা

আমার ছেলেবেলা

গায়ে স্কুল ড্রেস আর পকেটে পাঁচটি টাকা থাকলেই দুপুরে ডাউলভাত খাওয়া যায়। শুধু স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য দুপুরে ভাত খাওয়ার এই ‘প্যাকেজ’ চালু করেছেন রাজশাহীর আড়ানীর একজন হোটেল ব্যবসায়ী। তিন বছর ধরে তিনি পাঁচ টাকায় শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার খাওয়াচ্ছেন।

দৈনিক প্রথম আলোতে এই আর্টিকেলটা পড়ে হঠাৎ করে আমার স্কুল জীবনের মজার একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। নিজের মনেই হাসলাম কিছুক্ষণ, কি সুন্দর ছিল তখন জীবনটা, আনন্দের আর সুখের, তখন অবশ্য ভালো লাগতো না বলাই বাহুল্য। তখন শুধু মনে হত, “ধুর কবে যে শেষ হবে এই ছাতার পড়ালেখা, চাকরী করবো, টাকা থাকবে আর যা খুশি কিনবো, কত মজা হবে।” পড়াশুনা শেষ হওয়ার পরে না বুঝা গেল, কি কঠিন এই জীবন, বাস্তবতা কত নির্মম, ছাত্র অবস্থায়ই ভালো ছিল জীবনটা, সুখের আর আনন্দের দিনগুলো সব। যাক সে কথা, ফিরে আসি মূল ঘটনায়, যেটা আপনাদের সাথে আজকে শেয়ার করবো বলে ঠিক করলাম।

যশোর শহরেই আমার বেড়ে উঠা, স্কুল কলেজ সব কিছুই আমার যশোর কেন্দ্রিক। সবাই বলেন, “প্রাণের শহর ঢাকা”, আমি বলি “প্রাণের শহর যশোর”। এই শহরের অলিতে গলিতে আমাদের ছিল দুরন্ত পদচারণ। শহরের সব রিকশাওয়ালা, ভ্যানওয়ালা, দোকানদার, হোটেলওয়ালা, তাঁদের সব কর্মচারী, সবাই ছিল আমাদের “মামা”, সমস্ত শহর জুরে ছিল শুধু মামা আর মামা। মামার কাছে যেমন সব আবদার করা যায়, এদের কাছেও সব আবদার করা যেত, খুব নির্মম টাইপের মামা না হলে সবাই কমবেশি শুনতেন আমাদের আবদার। যেমন গরম গরম পুড়ি খাবো, “মামা, একটু মাংসের ঝোল দাও”, হোটেলওয়ালা নির্মম হলে বলতেন “ঝোল নাই মামা, এমনেই খাও।” কিছুক্ষণ পর দেখা যেত হোটেল মেসীয়র একটা প্লেটে একটু ঝোল দিয়ে যেত, সাথে ঠোঁটের গোঁড়ায় মুচকি একটু হাসি। কি এক ভালোবাসায় মোড়া সে আদর। আমার আম্মু প্রায়ই বলতেন, “শহর ভর্তি আমার ভাই, কতশত ভাই যে আছে আমার, কিন্তু কাউকে জীবনে দেখলাম না, চিনলামও না।”

আমি পড়াশুনা করেছি যশোর জেলা স্কুলে। ক্লাস সিক্স থেকে আমাদের ক্লাস শুরু হত সেই সকাল ১০টা থেকে আর শেষ হত বিকেল ৪.৩০ এ। মাঝখানের টিফিন পিরিয়ড, টিফিন করেই হৈচৈ দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যেত আমাদের। সরকারি স্কুল হওয়ার কারণে স্কুল থেকে টিফিন দেয়া হত, কিন্তু এতো লম্বা সময়ের কারণে ক্ষুধা লেগে যেত অনেক, তাই বাসা থেকে টিফিন আনতাম কিন্তু সেটা আরও নিচু ক্লাসে থাকতে, এখন যেহেতু বড় ক্লাস তাই ছেলে আমি বড় হয়ে গেছি, সুতরাং বাসা থেকে আর টিফিন আনতাম না, আব্বু টাকা দিতেন, বলাই বাহুল্য “বাজেট টাকা”, আমি পেতাম প্রতিদিন ৫ টাকা। আর ছোট আপু পেত ৫ টাকা, ওর স্কুলটা ছিল আমাদের পাশেই সরকারি গার্লস স্কুলে। টিফিন কিনতে স্কুলের সামনের দোকানে যেতাম, তখন তো এখনকার মত এতো বাহারি কেক পাওয়া যেত না, যেটা পেতাম সেটাই খেতাম, ওই বাজেটের ভিতরেই অবশ্যই।

কেক আর কতদিন ভালো লাগে, একই খাবার, একই স্বাদ। একদিন লক্ষ্য করলাম, আমাদের আর অন্য ক্লাসের কিছু ছেলে প্রতিদিন স্কুলের সামনে “গোলপাতা হোটেলে” গিয়ে ঢুকে। কৌতূহলে একদিন জিজ্ঞেস করলাম, ওরা বলল, “আমরা তো ভাত খাই ওখানে, রান্নাও খুব ভালো, খেয়ে দেখ একদিন।” আমি ভাবলাম, ভাত? ভাত খাওয়া কেমন না একটু? এতো ক্ষুধা তো আর না। পরেরদিন টিফিনে, ওরা খেতে যাওয়ার সময় আমাকে ডাক দিল, “কিরে যাবি নাকি?”

“কত লাগেরে খেতে? আমার কাছে তো ৫ টাকা আছে।”

“আরে ওতেই হবে। আয়।”

খুব অস্বস্তি নিয়ে একপা দুইপা করে গেলাম ওদের সাথে। হোটেলে ঢুকতেই মেসীয়র ঠকাস করে এক প্লেট গরম ধোঁয়া উঠা ভাত দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি খাবেন মামা?” বললাম, “কি আছে বলেন?” দুনিয়ার আইটেমের নাম বলা শুরু করলো। আমি বললাম, “আমার কাছে ৫ টাকা আছে, কি খাওয়া যাবে?” শুনেই ঘুরে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে, ওখান থেকেই জিজ্ঞেস করলো,

“ডাল খাবেন? ছোলার ডাল?”

“কত?”

“৩ টাকা।”

“আর ভাত?”

“২টাকা।”

হুম ৫ টাকায় তো হয়েই যাচ্ছে।

“দাও তাহলে।”

এক প্লেট ভর্তি কেবল নামানো গরম ছোলার ডাল দিয়ে গেল মেসীয়র মামা। খাওয়া শুরু করলাম, আহা কি সে স্বাদ! যেন মুখে লেগে আছে এখনো। খাওয়া কিছুদূর আগাতেই, ডালের প্লেটটা নিয়ে চলে গেল মেসীয়র, আবার অর্ধেক ভর্তি করে দিয়ে গেল। আমি কিছুই বুঝলাম না, তখন পর্যন্ত আমি জানতাম না “থোড়া” সিস্টেমটা কি, হোটেলে খাওয়ার মাঝখানে। চাইলে বা না চাইলেও আবার একটু তরকারি বা নিদেন পক্ষে একটু ঝোল দিয়ে যায় মেসীয়র, যেহেতু জীবনে প্রথম একা একা খেতে গিয়েছি হোটেলে, তাই ব্যাপারটা আমি জানতাম না একদমই। ভাবছি, আবার ডাল দিয়ে গেল, এখন তো বিল বেড়ে যাবে, আমার কাছে তো আছে মোটে ৫ টা টাকা। বেশি বিল হলে কিভাবে দিবো?

আমার মুখ দিয়ে আর্ত চিৎকার বের হয়ে আসলো, “আর লাগবে না, নিয়ে যান মামা।” মেসীয়র অবাক হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘটনা বুঝে ফেলল, একটু হাসি দিয়ে বলল, “খান মামা, সমস্যা নাই, ভালো করে খান।” যাক এভাবেই দিনগুলো যাচ্ছিল বেশ। প্রতিদিন টিফিনে “গোলপাতা হোটেলে” যেতাম আর ছোলার ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে ৫ টাকা বিল দিয়ে, তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে ক্লাসে ফিরতাম। ভালোই চলছিল দিনকাল, কিন্তু একদিন আবারো টেনশনে পড়ে যেতে হল।

সেদিনও খেতে বসেছি আরাম করে। গরম ভাত আর ডাল দিয়ে গেল মেসীয়র মামা। খাওয়াও শুরু করে দিলাম। খেতে খেতে রান্নাঘরে দিকে চোখ গেল, বাবুর্চি মামা ইলিশ মাছ ভাজছেন, ভাজা ইলিশ মাছের সুগন্ধে মৌ মৌ করছে চারিদিক আর আমি ডাল দিয়ে গরম ভাত খাচ্ছি, আর মাঝে মাঝে ফু দিয়ে ভাত ঠাণ্ডা করছি। হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই, মেসীয়র মামা একটা প্লেটে করে বিরাট একটা ইলিশের চাকাসহ পেটি ভাজা দিয়ে গেল সামনে। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম, কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার কাছে যে ৫ টাকার বেশি নেই সেটা এরা ভালো করেই জানে আর ইলিশের দাম তো অনেকই হবে কোন সন্দেহ নেই, এরা কি পাগল টাগল হয়ে গেল?

আমার মুখ দিয়ে সেই পুরনো আর্ত চিৎকার বের হয়ে আসলো, “এই মামা, আমি মাছ খাবো না। নিয়ে যাও। লাগবে না আমার।” মেসীয়র মামাও সেই আগের মত আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। কিন্তু উত্তরটা আসলো দরজার দিক থেকে, কাউন্টারে বসে থাকা হোটেলওয়ালা মামার থেকে। বলে উঠলেন, “আরে খাও। কি প্রতিদিন এক ডাল আর ভাত খাও তুমি? মাছটা খাও, বড় ইলিশের স্বাদই আলাদা। টাকার কথা চিন্তা করতে হবে না, আমি মামা আছি তো!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত