এমনিতে বৌ আমার খুব ভাল শুধু রান্নাতে হালকার উপর ঝাপসা। তোহাকে বিয়ের আগে ম্যাসে থাকতাম। তখন সপ্তাহের ৪ দিন ম্যাসের খালা গায়েব থাকতো। সেই সময় রান্নাটা শিখে নিয়েছিলাম। ম্যাসের বড় ভাইয়ারা আমার রান্না খেয়ে বলতো ‘তুহিন তুই ইন্জিনিয়ার না হয়ে রাধুনি হলে ভালো হতো৷ দোয়া করি তুই যেনো সারাজীবন রান্না করে যেতে পারিস৷ জানতাম না বড় ভাইদের দোয়া লেগে যাবে। তোহাকে বিয়ের পরেরদিন থেকেই নিজেকে ম্যাসের খালা রুপে আবিষ্কার করতে শুরু করেছি। আজ বৌয়ের জন্য গরুর কলিজা রান্না করছি। এমন সময় তোহা রান্না ঘরে হাজির, ‘ও আমার ময়না পাখি! কার সাথে কথা বলছো? ম্যাসের খালা আর আমার মধ্যে এই একটাই পার্থক্য ম্যাসের খালাদের কেউ আদর করে ময়না বলে ডাকে না কিন্তু আমাকে ডাকে।
-‘কই কারও সাথে কথা বলি না। রান্না করছি।
-‘শোনো না কলিজা গরুর কলিজাটা একটু ঝাল ঝাল করে রান্না করবে বুঝলা আমার কলিজার কলিজা। বাবাও খুব কলিজা খেতে পছন্দ করে। বাবাকেও আজকে রাতে খেতে আসতে বলেছি।
এই সর্বনাশ করেছে। তোহার বাবা আসা মানেই রান্নায় একশ একটা ভুল ধরবে। সেই বার হাঁসের মাংস রান্না করেছিলাম তোহা খুব শখ করে ওর বাবাকে ডেকেছে ছিল খেতে। খাওয়া শেষ করে সে বলে উঠলো মাংসতে নাকি লবণ হয় নাই। কেমন টা লাগে! তখন মনে হচ্ছিল আমার শ্বশুর কে যদি নিজের কলিজাও ভুনা করে খাওয়াই তাহলে ও সে বলবে কলিজায় লবণ কম। আজ সে আবার আসছে না জানি আজ সে কি কম বলবে। জীবনটা তেজপাতা করে ভাজা ভাজা করে দিল।
-‘জামাই, ও জামাই আজ নাকি তুমি তোমার কলিজা থুক্কু গরুর কলিজা ভুনা করেছো? সাথে কি খিচুড়ি রান্না করেছো? সবাই প্রথমে আগে জামাইয়ের খোঁজ খবর নেয় কিন্তু তিনি প্রথমেই জানতে চাইলেন খাবারের মেনু। নিজের চাপা কান্না নিজের ভেতরেই রেখে হাসি মুখে বললাম, “বাবা কেমন আছেন? না বাবা খিচুড়ি রান্না করিনি তোহা ত সাদা ভাত দিয়ে পছন্দ করে। আমার শ্বশুর আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন মনে হলো আমি কি একটা বলে দিয়েছি। খুব রেগে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” তুমি কি তোহা কে আমার থেকে বেশি জানো। ২০ টা বছর আমার মেয়েকে বড় করে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছি। মাত্র ১ বছরে তুমি আমার মেয়ে সম্পর্কে কি জানলা? আমি তার,কথা শুনে পুরোই ভ্যাবাচ্যাকা। তোহা পরিস্থিতি সামলে নিয়ে আমাকে ছোট একটা ইশারা করে বললো, -“বাবা তো ঠিকই বলেছে আমি খিচুড়ি খেতে বেশি পছন্দ করি। চলো আমরা খেতে বসি। তোহার কথা শুনে বাবা আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন আমাকে বলতে চাচ্ছেন ‘দিল গার্ডেন গার্ডেন হও গ্যায়া।
-“বাবা তাহলে খাওয়া শুরু করুন।
-“না একটু অপেক্ষা করো। আমার বন্ধু সারোয়ার আসবে।
-“বাবা সারোয়ার আংকেল কে? যিনি তার ছেলের সাথে তোহাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন? আমার শ্বশুর আমার দিকে তাকিয়ে খুব রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন,
-“ইয়েস।
এই র্সবনাশ করেছে। এখন আমার মান সম্মান সব কিছুই কলিজা ভুনার উপর নির্ভর করছে। কারণ আমার শ্বশুর তো কোনো দিন আমার প্রশংসা করবেন না। যাই হোক, পাচ মিনিটের মধ্যেই সারোয়ার সাহেব হাতে মিস্টি আর মুখে মিস্টি হাসি সাথে চোখে “ঘুঘু দেখেছো ফাঁদ দেখোনি এমন একটা ভাব নিয়া হাজির।
-কেমন আছো? ম্যাসের খালু প্রকৌশলী তুহিন রহমান।
-জ্বী ভালো আছি, কিন্তু ম্যাসের খালু মানে বুঝলাম না।
-আরে বাবা, যেসব ছেলেরা রান্না বান্না করে তারা তো ম্যাসের খালুই হয়।
এই বলেই অট্ট হাসি হাসলেন। আর আমি মনে মনে বললাম, ” হাসলে হাসলে আজ তেরা দিন হে। চলুন তাহলে সবাই খেতে বসি। পরম যত্নে শ্বশুর এবং সারোয়ার সাহেবকে খাবার পরিবেশন করলাম। কলিজা ভুনা খেয়ে সারোয়ার সাহেব তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো, বাহ চমৎকার! তুমি বাবা ইন্জিনিয়ার না হয়ে রাধুনি হলেই ভালো হতো।তাহলে তোমার রোজগার টাও বাড়তো। আজ যদি তোহা আমার ছেলের বৌ হতো তাহলে ভাড়া বাড়িতে না নিজের বাড়িতে থাকতো। আমার ছেলে তো এখন বিদেশে সেটেল্ড। নিজেকে একটু ছোট মনে হচ্ছিল। তোহার মুখটাও ছোট হয়ে গিয়েছিল। আমার শ্বশুর খেতে খেতে বললো,
-‘ তা সারোয়ার রান্না কেমন খেলে?
-“অসাধারণ। তোমার মনে আছে সালাম, আমাদের মেসের খালার কলিজা ভুনাও এমন স্বাদ হতো। বেছে বেছে জামাই এনেছো।
-“তা তোমার ছেলে কি রান্না করতে পারে এমন?
-“না। ও রান্না করে কি করবে। সবার তো আর মেসের খালা হওয়ার শখ নাই।
-“তা বটে। সবাই ত আর আমার জামাইয়ের মতো সর্বগুন সম্পূর্ণ হয় না।
সবাই তো আর আমার জামাইয়ের মতো অফিস থেকে ফিরে বৌকে রান্না করে খাওয়াতে পারবে না, সবাই তো আমার জামাইয়ের মতো বৌয়ের বাবা কে নিজের বাবার মতো আদর করতে পারবে না। সব থেকে বড় কথা সবাই তো নিজের বৌকে এতো ভালবাসতে পারবে না। এত গুলো কথা বলার পর তিনি একটু থামলেন। মনে হলো তার ঝাল লেগেছে। এক গ্লাস পানি তার দিকে এগিয়ে দিলাম। আর মনে মনে নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না৷ তোহা আমার দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি দিলো।
-“শোন সারোয়ার, টাকা থাকলেই সব হয় না বুঝলা। টাকা থাকলেই শ্রেষ্ঠ স্বামী হওয়া যায় না। শ্রেষ্ঠ স্বামী হওয়ার জন্য বৌকে ভালবাসতে জানতে হয়। আর হ্যা আমার জামাই সত্য ই শ্রেস্ট। আমার জামাই কে সত্যই আমি বেছে বুছে পেয়েছি। এমন জামাই তুমি তোমার মেয়ের জন্যও পাও দোয়া করে দিলাম।
এই প্রথম শ্বশুর এর কাছ থেকে এতো সুন্দর কথা শুনে নিজেকে মনে হচ্ছিলো আকাশে উড়ছি। আস্তে করে একবার সারোয়ার সাহেবের মুখের দিকে তাকালাম তার মুখটা দেখে বাংলা সিনেমার একটা ডায়লগ “আহো ভাতিজা, আহো ” বলতে ইচ্ছে করলেও নিজেকে কন্ট্রোল করে বললাম “আংকেল আরেক চামচ ভাত দিবো?। খুব বিরক্তি নিয়ে তিনি উত্তর দিলেন-” না।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে সারোয়ার সাহেব কে আমি আর বাবা মিলে বাড়ির গেট পর্যন্ত বিদায় দিয়ে ফিরছি। নিজের প্রশংসা শুনে আকাশে উড়ার ফিল নিয়ে বাবাকে বললাম, ‘বাবা যা দিলেন না! পুরাই হোয়াইট ওয়াশ। আই এম প্রাউড অফ ইউ বাবা। শ্বশুর খুব সুন্দর করে হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“সব কিছু ঠিকই ছিল জামাই। শুধু কলিজায় লবণ কম হয়ে গেছিল। লবণের মাপ টা তোমার শাশুড়ির কাছ থেকে শিখে নিও কেমন। গুড নাইট। মুর্হুত এর মধ্যে আমি যেন আকাশ থেকে ধপ করে মাটিতে পরলাম এমন একটা অনুভব হলো। আর মনে মনে বললাম, “তেঁতুল ও মিস্টি হয় কিন্তু আমার শ্বশুর কখনো বদলাবে না।