স্বপ্ন বিভ্রাট

স্বপ্ন বিভ্রাট

–মিমি প্লিজ,তুমি এই ২দিন বাসা থেকে বের হবে না,আমাকে কথা দাও?

মেসেজটা দেখেই মিমির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
অনিক কদিন আগে ভোরবেলা স্বপ্নে দেখেছে,তার বউ বিয়ের আগে পালিয়ে যাবে! তার মা এর কাছে ছোটবেলায় শুনেছিল, ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়!
তাই অনিকের এই অদ্ভুত আবদার!
গত ৩দিন ধরে এই জন্যেই মিমি অনিকের সাথে দেখা করেনি। দেখা করলেই সেই এক কথা, মিমি আমাদের বিয়েটা না হওয়া পর্যন্ত তুমি বাসা থেকে বের হবে না,কথা দাও!
কিন্তু দেখা না করেও রেহাই পাওয়া যায় নি। সারাদিন রাত অনিক কল করে এই এক কথা বলেই যাচ্ছে। কল রিসিভ না করলে মেসেজ করে বলছে। দিনে প্রায় ৩০/৪০টা মেসেজ, শুধু এই একটা কথা!

মিমি আর অনিকের সম্পর্কটা বেশ অদ্ভুতভাবেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু অনিক ছেলেটা যে কতোটা অদ্ভুত, সেটা মিমির কল্পনার বাইরে ছিল।

একদিন সন্ধ্যেবেলা হঠাত অনিক কল করে বললো,
–মিমি আজ রাতে কি তোমার বাইরে যাওয়ার কোনো প্লান আছে??
–হুম, লুনার জন্মদিনের পার্টি আছে। এই একটু পরেই বের হব। কেন?
–তুমি আজ যেও না প্লিজ।
–কিহ? কেন যাব না? লুনা আমার সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। আর ওর জন্মদিনের পার্টিতে আমি যাব না?
–না,যাবে না। আজকের রাতটা তুমি বাইরে যেও না প্লিজ। অন্যদিন যেও।
–কি পাগলের মত কথা বলছো? কি আছে আজকের রাতে যে আজ বের হতে পারব না?
–আমি পেপারে দেখলাম, আজ তোমার রাশিতে সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হওয়ার কথা বলা আছে। তাই যেও না প্লিজ। আমার এইটুকু কথা শুনো?
–ওইসব আমি বিশ্বাস করিনা,সেটা তো তুমি জানো অনিক। আর সারাদিন যখন কিছু হয়নি,রাতেও হবেনা।
–প্লিজ মিমি,জেদ করো না। দূর্ঘটনা কখন কিভাবে হয়,কেউ তো জানেনা। দিনে হয়নি বলে রাতেও যে হবে না,এমনটা তো নয়। প্লিজ যেও না তুমি। প্লিজ মিমি। প্লিজ….
–উফফ আচ্ছা যাব না। রাখো ফোন।

এরকম আরেকদিন সকাল বেলা কল করে অনিক বললো,
–মিমি আজ তোমার কলেজ আছে??
–হু,কেনো?
–যাবে কলেজে?
–হ্যাঁ, আজ যেতে হবে। ইম্পরট্যান্ট একটা ক্লাস আছে। কেন বলো তো?
–না গেলে হয়না আজ? পরে কোনো বান্ধুবির কাছে দেখিয়ে নিতে?
–কাহিনি না করে বলবে কি হয়েছে??
–আসলে আমি স্বপ্নে দেখেছি, ভীষণ ঝড় হচ্ছে। আর তুমি কলেজে গিয়েছো। হঠাত একটা গাছের ডাল এসে তোমার মাথায় পড়েছে। তাই আর কি বলছিলাম….
–আমি আজকে কলেজ যাব না,তাই তো?
–হ্যাঁ মিমি। প্লিজ যেও না আজ।
–চুপ একদম। বাহিরে তাকিয়ে দেখেছো একবার?? কিরকম কাঠফাটা রোদ উঠেছে। আর তুমি বলছো, ঝড় আসবে এখন?? মাথা তো এতদিন হাফ খারাপ ছিল, এবার কি পুরোটাই গেছে?
–তুমি আমাকে যা ইচ্ছে বলো। মাথা খারাপ, পাগল সব বলো। যত ইচ্ছে রাগ দেখাও,তবু যেও না আজ কলেজে প্লিজ।
–আমি যাবই আজকে। দেখি কোন ঝড় আসে,আর কয়টা ডাল এসে আমার মাথায় পড়ে।
–এরকম করিও না প্লিজ। তোমার কিছু হলে আমার কি হবে বলো তো? তুমি কি আমাকে একটুও ভালবাসো না? প্লিজ মিমি,যেও না আজ।
–এগুলো অতিরিক্ত আদিক্ষেতা একদম করবা না। সহ্য হয়না আমার।
–আচ্ছা, আর বলবো না। কিন্তু তুমি বলো, যাবে না আজ কলেজে?
এর মধ্যেই অনিক ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। একটা ছেলে কি করে এত অতিরিক্ত মাত্রায় সেন্টিমেন্টাল হতে পারে,মিমি সেটাই বুঝে উঠতে পারেনা!
বাধ্য হয়েই মিমি সেদিন আর কলেজে গেলো না।

এরকম আরও অনেক কাহিনি গত ৫বছরে অনিক করেছে। মিমি বরাবরই খুব কঠোর আর বাস্তববাদী একটা মেয়ে। সে কি করে এরকম একটা ছেলের সাথে এই দীর্ঘ সময় রিলেশনশিপে আছে,এটা ভাবলেই মিমির নিজেকে এলিয়েন টাইপ কিছু মনে হয়!
আবার এর সাথেই ২দিন পর মিমির বিয়ে! দুই পরিবার থেকেই তাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছে। তাই বেশ ধুমধাম করেই বিয়েটা হবে। বেশ খুশিতেই ছিল মিমি।

হঠাত অনিকের এই অদ্ভুত কথাটা শুনে এখন তার মেজাজ ভীষণ খারাপ হয়ে আছে। এই ছেলের সাথে সারাজীবন সে কি করে থাকবে? বিয়ের কদিন পরেই না তার ঠিকানা পাগলাগারদ হয়ে যায়! যদিও অনিকের মত একটা অদ্ভুত রকমের পাগলের কাছে থাকার চেয়ে পাগলাগারদ বেটার অপশন হবে!

আচ্ছা, অনিক কি তখন পাগলাগারদে গিয়েও বলবে, মিমি আজ স্বপ্নে দেখেছি ডাক্তার তোমাকে ইয়ায়া বড় একটা ইঞ্জেকশন দিচ্ছে, তুমি পালাও এখান থেকে!

ফোনের রিংটোনে ভাবনায় ছেদ পড়ল মিমির। অনিক আবার কল করেছে।
–বলো, আবার কিছু দেখেছো স্বপ্নে?
–উহু । রেগে যাচ্ছো কেনো এভাবে? কোনো সমস্যা?
–তোমার মত এরকম বিরল প্রজাতির বফ যার আছে, তার আবার অন্য কোনো সমস্যা থাকতে পারে? কখনোই নাহ। কস্মিনকালেও না।

মিমি প্রশংসা করলো নাকি অন্যকিছু অনিক ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। তাই টপিক চেঞ্জ করতে বললো,
–আচ্ছা মিমি তোমার তো বিয়েতে নীল রঙ এর চুড়ি পড়ার ইচ্ছে ছিল। আমি কাল নিয়ে এসেছি সেটা।
–নিয়ে এসেছো মানে? আমার হাতের মাপ জানো তুমি? চুড়ি তো আমাদের একসাথে গিয়ে নেয়ার কথা ছিল।
–হ্যাঁ, ছিল। কিন্তু ওইযে ভোরবেলা স্বপ্নটা দেখলাম, তাই ভাবলাম আমি একাই নিয়ে আসি।
–মানে টা কি?? আমি পালাইলে কি তোমার সাথে বের হয়ে তোমার সামনে দিয়ে পালাবো?? এতোটা বোকা মনে হয় আমাকে? এই এত মাথামোটা ক্যান তুমি?
–এই মিমি, কি বলছো এসব?? পালাবে কেনো তুমি??এইই..?? তাহলে কি স্বপ্নটাই সত্যি হবে?? কিন্তু তুমিই তো বলছিলে, স্বপ্ন তো স্বপ্নই। তবে আজ এটা কি বলছো??? কথা বলছো না কেনো?? এই মিমি এইইই??

মিমি কিছু না বলে ফোনটা রেখে দিল। তার পাগলাগারদে যেতে যে আর বেশিদিন বাকি নেই, সেটা সে ভালই বুঝতে পারছে।

আজ মিমির বিয়ে। গত ২দিন সে ফোন অন করেনি। অনিকের সাথে কোনোরকম যোগাযোগও করেনি।
অনিক মিমির বাসায় কল দিয়ে অনেকবার মিমিকে চেয়েছে। কিন্তু মিমি তার মাকে বলে দিয়েছে, অনিক ফোন দিলে যেন বলে দেয়, মিমি ঘুমাচ্ছে কিংবা বিজি আছে। বিয়ের আগের এই ২দিন সে আর অনিকের সাথে কথা বলতে চায় না।

রাত ৯টায় অনিকদের আসার কথা। এখন সন্ধ্যে ৭টা। মিমি ফোনটা অন করে একটা মেসেজ লিখলো, তারপর সেটা অনিকের নাম্বারে সেন্ড করে দিয়ে আগে থেকেই গুছিয়ে রাখা জামাকাপড় এর ব্যাগ, আর নিজের জমানো কিছু টাকা নিয়ে বাসার পিছনের দরজা দিয়ে সবার অগোচরে বেড়িয়ে পড়ল।

রেলস্টেশনে বসে বাদাম খাচ্ছে মিমি। অনিককে পাঠানো মেসেজটা বের করে দেখলো একবার।

“অনিক, তোমার এইসব উদ্ভট কার্যকলাপ আমি আর নিতে পারছি না। ৫টা বছর তোমার মত একটা মাথা খারাপ ছেলের সাথে রিলেশনশিপে থেকে নিজের এতোটা সময় নষ্ট করলাম, সেটা ভেবেই আমার আফসোস হচ্ছে। তাই এই বিয়েটা আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। আজ রাত ১০টার ট্রেনে আমি যাকে সত্যি ভালবাসি,তার সাথে পালিয়ে যাচ্ছি।
তুমি ভাল থেকো। ”

মেসেজটা কয়েকবার পড়ে হেসে নিয়ে,আবার বাদাম খেতে থাকলো মিমি। হঠাত দেখলো, অনিক ছুটতে ছুটতে আসছে। মিমির সামনে এসেই বসে পড়লো অনিক।
বাচ্চাদের মত কাঁদতে কাঁদতে মিমির হাত ধরে বললো,
–তুমি এটা করতে পারো না মিমি। তুমি কি করে আমাদের এতদিনের সবকিছু ভুলে গেলে? আমি আর ওসব স্বপ্ন টপ্নের কথা বলে তোমাকে বিরক্ত করবো না। প্লিজ তুমি আমার সাথে বিয়েটা ভেঙে দিও না।
–বাদাম খাবে?
–এই তুমি এখন আমাকে বাদাম খেতে বলছো? এখন আমার বাদাম খাওয়ার সময়?
–আচ্ছা,আমিই খাই।
–না,তুমিও খাবে না। আগে বলো, তুমি যাবে না তো?
–যাব না কেনো? এইযে দেখো, টিকিট। ২টা। আমার আর আমার হবু বরের। আমরা রাঙামাটি যাচ্ছি। ওখানে গিয়ে বিয়ে করে নিব। তুমি একটা ভাল মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিও,কেমন?
–চুপ করো। তুমি যদি এরকমটা করো,আমি কিন্তু নিজেকে শেষ করে দিব।

মিমি মুচকি হেসে ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাড়ালো।
–এই কোথায় যাচ্ছো তুমি?
–ট্রেন চলে এসেছে, দেখতে পারছো না? আমাকে এখন যেতে হবে।
–আসুক ট্রেন। কোথাও যাবে না তুমি।

অনিক মিমির সামনে হাত বাড়িয়ে দাঁড়াল। মিমি অনিকের হাত সরিয়ে দিয়ে ট্রেনে উঠে গেল।

ট্রেন ছুটে চলেছে। মিমি বসে আছে জানালার পাশের সিটে। আর তার পাশেই অনিক।
পালিয়ে বিয়ে করার একটা সুপ্ত ইচ্ছে মিমির মনে আগে থেকেই ছিল। তাই অনিক যেদিন তার অদ্ভুত স্বপ্নটার কথা বললো, সেদিনই মিমি এই প্লানটা করে রেখেছিল। নিজের মনে হেসে উঠলো সে।
কটা চুল মিমির চোখের উপর খুনসুটি করছে। মিমি চুল কটা সরাতে গিয়ে দেখলো, অনিক হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

–ওই এভাবে মদনের মত আমার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছো?
–ভাবছি যে, বিয়ের আগে আমার বউ পালিয়ে যাবে,সেটা স্বপ্নে দেখলাম। কিন্তু বউ যে আমাকে নিয়ে পালাবে,সেটা কেন দেখলাম না, বলো তো??
মিমি রাগী চোখে বললো,
–আবার স্বপ্ন?????
–এই যাহ, না না। আর কোনো স্বপ্ন না। এইযে কান ধরেছি।

মিমি হেসে ফেললো। অনিক তাকিয়ে আছে আর ভাবছে, একটা মেয়ের হাসি এত সুন্দর হতে পারে…………..!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত