বাবার বিয়ে

বাবার বিয়ে

মেয়ে হয়ে বাবা কে বিয়ে করিয়ে নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

পাড়াপ্রতিবেশি আত্মীয়স্বজনরা সকলে ছিঃ ছিঃ করছে, আড়ালে নয় সামনেও অনেকে হাসাহাসি করছে। অবশ্য এতে আমার কোনো আফসোস বা কোনো কিছু যায় আসছে না।

অনেক টা নিশ্চিন্ত মনে বাবার নতুন বউ অর্থাৎ আমার নতুন মাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছালাম। নতুন মা কে বরণ করার জন্য কেউ এগিয়ে আসলো না। কি আর করার, বাবা ও নতুন মা কে মিষ্টি মুখ করিয়ে আমি ঘরে তুললাম।

নতুন মা গাড়ি থেকে নামার পর থেকে একটা কথাও বলছেনা। তাকে দেখে বোঝার আর বাকি রইলো না, লজ্জা অপমানে কতটা শঙ্কিত হয়ে আছেন উনি।

ব্যাগ থেকে একটা সুতি শাড়ি বের করে উনার হাতে দিলাম।
– যান আপনি ফ্রেশ হয়ে নেন, আমি খাবার দিচ্ছি।
– আচ্ছা শোনো!
– হ্যা, কিছু বলবেন?
উনি চুপ হয়ে আছেন।
চিন্তার কিছু নেই আমি আছি। অন্যের কথায় কর্ণপাত করার দরকার নেই।
আমি আপনার দায়িত্ব নিয়ে এনেছি, ভয়ের কিছু নেই।

রুম থেকে বের হতেই আমার শাশুড়ির ফোন!
– বাড়ি ফিরছো কবে?
– এই তো মা কালকে বিকাল নাগাদ। আপনার ছেলে সকালে এখান থেকেই অফিসে রওনা দিবে, আমি দুপুর পরে চলে যাবো।
– এসেই বা কি করবা, মানসম্মানের তো কোনো তোয়াক্কা করলা না। সে যাই হোক বাড়ি ফেরো বাকি কথা পরে হবে।

কথা শেষ করে শাশুড়ি নিজেই ফোন টা কেটে দিলো।
এই পর্যন্ত তো কম কথা শুনিনি, এখন আর এসব কথা গায়ে লাগেনা।

মা মারা গেছেন দু বছর হয়ে আসলো। বাবার বয়স প্রায় পঞ্চাশোর্ধ। এই বয়সে আবার বিয়ে, বিষয় টা খুব হাস্যকর তাইনা?

সকলের কাছে হাস্যকর হলেও আমার কাছে এর জন্য যথাযত যুক্তি রয়েছে। অবশ্য এর জন্য আমায় অনেক লড়ায় কর‍তে হয়েছে।

আর এই লড়ায়ে সবসময়ের জন্য আমার স্বামী আবির আমার পাশে ছিল। ওর সাথে বিয়েটা হয়েছে মায়ের মৃত্যুর প্রায় বছর খানেক পর।

কত জায়গা থেকে সম্মন্ধ এসে বার বার ভেঙে গিয়েছে। এমন নয় যে আমি দেখতে খুব একটা কুৎসিত!

সকলে পাত্রি দেখতে এসে বলেছে, সংসারে তো ঢেকি নেই, ধান বানে কিভাবে জানবে কিভাবে!
কথাটা কেমন কটু শোনায়!
মা নেই সংসারে, বাড়ির কাজ কি, সংসার সামলানো শিখবে কিভাবে মেয়ে! আর তার চেয়ে বড় কথা জামায় আদর পাবেনা ছেলে। আরো কত কথা।

জানিনা ভাগ্যক্রমে আবির আমায় পছন্দ করে ফেলল। অবশ্য ওর বাড়ির লোকের এতে আপত্তি ছিল। কিন্তু একমাত্র ছেলের আবদার ফেলতে পারেনি ওর বাবা মা।

বাবা তো আমায় বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেলেন কিন্তু আমার চিন্তা দূর হবে কিভাবে?
আমাদের সংসারে আমরা দুটো মানুষই। ছোট কোনো ভাই বা বোন নেই, যে বাবার আরেকটা বিয়ের প্রয়োজন। এই যুক্তি সামনে রেখে সকলে আপত্তি জানিয়েছে।
এমনকি আমাকেও বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, সংসারে নতুন কেউ এলে নাকি আমি পর হয়ে যাবো। বাবা নাকি আমায় পর করে দেবে।

একদিন এক পরিচিতর মাধ্যমে আমার নতুন মায়ের সন্ধান পাই। মহিলা খুব সহজ সরল। জানিনা সেটা কতটা সত্যি!
তবে যে মেয়ে নিজের সংসার বাঁচাতে বাড়ির ঝিঁর মত থেকে যেতে চেয়েছিল, তার জীবনের দুঃখ টা হয়ত আর পাঁচ জনের তুলনায় বেশি। উনার স্বামী উনাকে তালাক দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল শুধুমাত্র উনার বন্ধত্যের কারনে। উনি কখনো মা হতে পারবেন না। এর চেয়ে কষ্টের একজন নারীর জীবনে কি বা আছে। এটা জেনে কেউই আর উনাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে রাজি হয়নি। উনার পরিবারে উনার বৃদ্ধ মা আর উনি থাকেন।

উনার সম্পর্কে জেনে শুনে আবির কে জানাই। আবির আমার মতে কোনো বাধা দেয়নি।
আপত্তি বেধেছিল বাবা কে নিয়ে। কিছুতেই বাবা রাজি হচ্ছিল না।

বাবা বারবার বলেছে, এই বয়সে বিয়ে সমাজে মুখ দেখাবো কি করে। আর আমি তো এই তোকে নিয়ে দিব্বি আছিরে মা।

– বাবা আমি তো এখন তোমার কাছে থাকিনা। বাবা তোমার একজন সঙ্গীর দরকার। যে তোমার সুখে দুখে মায়ের মতো তোমায় আগলে রাখবে। ভাবছ মেয়ে হয়ে এসব কিভাবে বলছি!

বাবা সবার আগে তুমি। তোমার কথা আমি ছাড়া কে ভাব্বে বলো। তোমার মেয়ের এখন সংসার হয়েছে। বিপদে আপদে হুট করে তো চলে আসতে পারবো না। আর সব চেয়ে বড় কথা বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন। কেউ যদি তোমায় ভালোবেসে তোমার সেবা করে জীবন কাটিয়ে দিতে পারে তুমি কেন পারবেনা।

শেষপর্যন্ত আমি বাবাকে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছি। পঁয়তাল্লিশ বছরের ওই মহিলার সাথে বাবার বিয়ের সম্মন্ধ করি।

নতুন মা কে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম। উনাকে প্রস্তাব দেই উনিও রাজি হয়নি। তবে উনাকেও বুঝালাম। আর সবচেয়ে বড় কথা উনি একটা মেয়ে পেয়ে যাচ্ছে আর আমি মা।

কথা টা শুনে সেদিন উনি আমায় জড়িয়ে ধরে সে কি কান্না। মা মেয়ে সেদিন একটু বেশি আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম।

নতুন মা বাবার সংসারে দু বছর হয়ে গেলো। এখন পাড়াপ্রতিবেশি আত্মীয়স্বজন কেউ কিছু বলার তো দূরে থাক বুঝতেও পারেনা যে আমাদের মাঝে কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। আছে সে তো আত্মার সম্পর্ক। মা যেন মেয়ে বলতে পাগল।
শশুর বাড়িতেও নতুন মায়ের সে কি গুনগান।

বাবা ও নতুন মা দুজনেই শেষ বয়সে দুটি বিশ্বস্ত হাত পেয়েছে। একে অপরকে আগলে রেখেছে। মেয়ে হিসেবে এর বেশি আর কি বা চাওয়ার থাকবে।

যাই হোক কারো ভালো থাকার জন্য হয়ত এর বেশি কিছু লাগেনা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত