মেয়েটা হুট করেই রান্নাঘর থেকে উঠে এসে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,’আচ্ছা, আমি যদি হঠাৎ করে মারা যাই তখন আপনি কী করবেন?’
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললাম, ‘নতুন একটা বউ নিয়ে আসব ঘরে।’
মেয়েটা ছলছল চোখ নিয়ে আমায় আবার বলল, ‘আপনি পারবেন আমার স্থানে অন্যকাউকে জায়গা দিতে?’
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম।
‘ওমা, না পারার কী আছে!’
‘সত্যিই পারবেন?’
‘অন্যকাউকে জায়গা না দিলে আমায় রান্না করে খাওয়াবে কে শুনি?’
‘খাওয়াটাই আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেলো আমার চেয়ে?’
‘শরীর ঠিক তো সব ঠিক।’
মেয়েটা আর কিছু বলল না। চোখ দিয়ে দু’চার ফোঁটা অশ্রু ফেলে রান্নাঘরে চলে গেলো।
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম, মেয়েটা এ যুগে বড্ড বেমানান। এত সহজ, সরল মানুষ এ যুগে সত্যিই পাওয়া যাবে যে কিনা আমার সব কথা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিবে??
আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে চুপিচুপি রান্নাঘরে গেলাম। রান্নাঘরে উঁকি দিতেই দেখতে পেলাম, মেয়েটা অঝোরে কান্না করছে আর তরকারিতে মরিচ দিচ্ছে।
‘তা বলছি, আমার উপর রাগ করে তরকারিতে মরিচ বেশি দেয়া হচ্ছে তাই না?’
হঠাৎ আমার আওয়াজ শুনে মেয়েটা খানিকটা ভয় পেয়ে গেলো। একবার পিছনে তাকিয়ে আবার রান্নায় মনোযোগ বসিয়ে দিলো। আমার কথার কোনো উত্তর না দিয়েই।
‘কথা বলবেন না আপনি তাই না?’
মেয়েটা তখনও চুপ করে আছে। আমি হুট করেই সামনে গিয়ে মেয়েটাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে ফেললাম। তারপর গালে একটা চুমু দিয়ে মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে আনলাম।
‘এত বোকা কেন তুমি?’
‘জানি না।’
মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে। একেবারে বাচ্চাদের মতো কান্না।
‘বলছি, তোমার স্থানে অন্যকাউকে জায়গা দেয়ার জন্য কী তোমায় বউ করে এনেছি?’
‘চুপ, একদম চুপ।’
‘এত সহজেই তোমায় হারিয়ে যেতে দিব নাকি!’
মেয়েটা মাথা নিচু করে আছে।
‘পোলাপানের নাম যে ঠিক করে রেখেছি সেগুলার কী হবে ম্যাডাম?’
মেয়েটা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘খালি দুষ্টামী তাই না? দেখাচ্ছি মজা।’
কথাটা বলেই মেয়েটা দু’চারটা ঘুষি বসিয়ে দিলো আমার বুকে। তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকে লুটিয়ে পড়ল।
আমি তার কপালে একটা চুমু দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। বয়স হলে কী হবে, স্বভাবটা এখনও একদম বাচ্চাদের মতো।
‘এই আমার মাথায় তেল দিয়ে দেন।’
‘উহু, পারব না।’
‘কেন পারবেন না?’
আমি মেয়েটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,
‘এখনও আমায় তুমি করে বলা শিখতে পারলে না?’
মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কেটে বলল,
‘উহু, পারলাম না।’
‘তাহলে তেল দিয়ে দিতে পারব না।’
ল্যাপটপে গতকালের বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদের খেলা দেখছি। খেলায় টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে। এ সময় বউয়ের মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া কেমন যেন বেমানান দেখায়।
‘আচ্ছা তুমি করে বলব আগে তেল দিয়ে দেন মাথায়।’
‘আচ্ছা এখানে বসো।’
মেয়েটা চুপচাপ আমার কাছে এসে বসে পড়লো। আমি খেলা দেখছি আর একটু একটু করে তার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছি। কিছুক্ষণ পর তেল দেওয়া শেষ হয়ে গেলে মেয়েটা উঠে চলে গেলো। আমি গামছায় হাত মুছে আবার খেলা দেখতে শুরু করলাম। শাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসার মতো সময় এখন হাতে নেই একটুও।
‘এই আপনি এদিকে তাকান।’
কোত্থেকে জানি বউ এসে তার দিকে তাকাতে বলছে। ধুর, বউয়ের দিকে তাকানোর সময় আছে নাকি এখন!
‘খেলা দেখছি। একটু পরে তাকাচ্ছি।’
বউ আমার চিৎকার দিয়ে বলে উঠল,
‘এখন তাকাতে বলছি না আমি, হ্যাঁ?’
বউয়ের চিৎকার শুনে আমি ভয়ে বিড়ালের মতো ম্যাও ম্যাও করে উঠলাম।
‘আমার মাথায় কী দিয়েছেন এগুলা?’
‘কেন বউ তেল দিয়েছি।’
বউ আমার হাতে ইশারা দিয়ে বলল,
‘এটা তেল?’
আমি বোতলের দিকে তাকিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ওইটা তেল ছিল না, শরীরে দেয়ার লোশন ছিল।
‘এত বড় শত্রুতা আমার সঙ্গে?’
‘বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে করি নাই।’
‘তাহলে কিভাবে করেছেন?’
‘খেলা দেখছিলাম। ওইটা তেল নাকি নাকি লোশন ছিল খেয়াল করিনি।’
‘আমার চুলের যদি কিছু হয় না তবে দেখতে পাবেন আপনার কী করি আমি।’
‘কী করবা বউ?’
‘আপনার সবগুলা চুল ছিড়ে ফেলব।’
‘আচ্ছা সমস্যা নেই। দু’জন মিলে একসাথে টাকলা-টাকলু হয়ে যাব। তারপর তুমি আমার টাকলা মাথায় টোকা দিবা আর আমি তোমার টাকলা মাথায় টোকা দিব।’
আমার কথা শুনে বউ ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর খাটের নিচ থেকে ঝাড়ুটা হাতে নিয়ে আমায় তাড়া করলো। আমি দরজা খুলে পাতালে দৌড়।
‘ফারাবী ভাই, সবাই নিচে গেছে। যাবেন না আপনি?’
ঈদের নামাজ পড়ে এসে রুমে বসে ডাইরিটা পড়ছিলাম। সালাম ভাই রুমে আসাতে ডাইরিটা পাশে রেখে তার দিকে তাকালাম।
‘হ্যাঁ ভাই, আসছি একটু পরে।’
সালাম ভাই আমার দিকে একবার তাকালেন। তারপর মাথা নিচু করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।
আজকে আমার বৃদ্ধাশ্রম জীবনের সতেরো বছর হয়েছে। সতেরো বছর আগে আমার বউ আমাকে একা করে না ফেরার দেশে চলে গেছে। মেয়েটার নাম ছিল অর্ন্যা। দেখতে অতটা সুন্দরী না হলেও চেহারার মাঝে একটা আলাদা মায়া ছিল, যা আমাকে তার প্রতি দুর্বল করে দিয়েছিল। আমাদের বিয়েটা ছিল প্রেমের। খুব শখ করে মেয়েটাকে বউ করে এনেছিলাম। প্রথমবারই আল্লাহ একটা পুত্রসন্তান দেওয়াতে পরবর্তীতে আর কোনো সন্তান নেইনি। এই একটাকেই মানুষের মতো মানুষ বানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ছেলের বউয়ের জন্য তা আর করা হয়ে উঠেনি। ছেলে বিয়ে করানোর পরই আলাদা হয়ে গেছে। আমরা বুড়ো-বুড়ি কোনোরকমে ডাল,ভাত খেয়ে দিন পার করতাম। বুড়িটাও সতেরো আগে আমাকে একা করে চলে গেছে। বয়স তখন সাতান্ন ছুইছুই। পড়ে গেলাম মহাবিপদে। ছেলের বউয়ের কাছে কাশি দিলে দোষ,বাথরুমে গেলে দোষ,ভাত চাইলে দোষ,নতুন পাঞ্জাবী চাইলে দোষ। সবকিছুতেই শুধু দোষ আর দোষ। শেষে ছেলে অনেক চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিলো আমায় বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে। আমিও কিচ্ছু বলিনি। বয়স অনেক হয়েছে আমার। ক’দিন পরই হয়তো উপরে চলে যাব। ছেলে আর ছেলের বউ বেঁচে থাকবে অনেক বছর। তাহলে শুধু শুধু আমার জন্য কেন তারা ঝগড়া করবে একে অপরের সাথে?? তার থেকে বরং ভালো আমি বৃদ্ধাশ্রমেই চলে যাই। কী শান্তি সেখানে! স্বাধীন জীবন, কোনো চিল্লাচিল্লি নেই, মারামারি নেই, নেই আমার প্রতি কারও অনিহা, বিরক্তি।
ছেলে-মেয়ে কখনও আপনার কষ্ট ঠিকমতো বুঝবে না। একটু হলেও তাদের মধ্যে কমতি থাকবেই। বাবা-মা বেঁচে থাকতে তারা আর বাবা-মা মারা যাবার পর নিজের স্বামী কিংবা স্ত্রী ছাড়া কেউ আপনার কষ্ট পরিপূর্ণভাবে বুঝবে না। ছেলে-মেয়ে দশটা কাজ করলে এগারো নাম্বার কাজে এসে একটু অনিহা প্রকাশ করবেই, কিন্তু আপনার স্বামী বা স্ত্রী দশটা না একশোটা কাজ দিলেও আপনার উপর বিরক্ত হবে না। আলাদা একটা সম্মান, আলাদা একটা ভালোবাসার জন্য এ বিরক্তিগুলো তাদের মাঝে একটুও কাজ করে না।
একটা সময় ছিল যখন ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে অর্ন্যা আমাকে নিজ হাতে সেমাই খাইয়ে দিত। খেতে না চাইলে বলত, ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে সেমাই খেয়ে যেতেই হয়। সেইটা হোক এক চামচ কিংবা তার বেশি, কিন্তু সেমাই খেয়ে যেতেই হবে। ভাবতেই অবাক লাগে, সেই সেমাই খাইয়ে দেয়া মানুষটা এখন আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। এখন ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে জোর গলায় কেউ আমাকে বলে না, ‘এই সেমাই খেয়ে যাও, এক চামচ হলেও খেয়ে যাও।’