বিকেলের পর পরই আমার কলেজ জীবনের বেষ্ট ফ্রেন্ডের থেকে অদ্ভুত একটা ইমেইল পেলাম, “চন্দন, আজকে রাতে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তোকে। খুবই, খুবই জরুরী, কিন্তু কাজটা আমি ঠিক যেভাবে বলছি সেভাবেই করবি, কোন রকম ভুল করা যাবে না। সাবধান। তোর হয়ত খুব অদ্ভুত লাগছে শুনে, লাগতেই পারে অস্বাভাবিক না, কিন্তু প্লিজ করে দে। কখনো যদি এখান থেকে আমি ফিরে আসতে পারি, তাহলে এই পাগলামিটা মনে করে যত খুশি হাসাহাসি করিস অসুবিধা নেই, আমিও হাসবো তোর সাথে।
কয়েকদিন আগে, নিউমার্কেটের কাঁসা পিতলের একটা দোকান থেকে, পিতলের খুব পুরনো একটা ফুলদানি কিনেছিলাম আমরা, মনে আছে তোর? ফুলদানির গায়ে অদ্ভুত কি সমস্ত চিহ্ন খোঁদাই করা ছিল? আমার বাসা থেকে সেই ফুলদানিটাই আনতে হবে তোকে, আর সেটা আজ রাতের মধ্যেই। প্রথমে যেটা করবি, কালো কালির একটা মার্কার পেন নিবি, তারপর দুই হাতের তালুতে দুইটা চোখ আঁকবি, মনে রাখিস, চোখের মনিগুলো তালুর ঠিক মাঝখানে যেন থাকে। তারপর একটা ব্যাগ আর মোমবাতি নিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে যা। ভিতরে ঢুকে দেখবি অসম্ভব অন্ধকার, কিন্তু কোনভাবেই লাইট জ্বালাবি না, মোমবাতিটা দিয়ে কাজ সারতে হবে তোকে।
আমার শোবার ঘরে ঢোকার সাথে সাথে ফিসফিস করে কথা বলার একটা আওয়াজ পাবি। ঠিক বুঝতে পারবি না কোথা থেকে আসছে। কিন্তু ভয় পাবি না একদম, পেলেই কিন্তু মহা সর্বনাশ। কান দিস না ওদিকে। যেটাই করতে বলুক না কেন, শুনবি না। মাথায় রাখবি, যা বলছে ওরা তার সবই তোকে ভয় দেখানোর জন্য আর বিপদে ফেলার জন্য।
যাহোক, আমার বিছানার পাশে ওয়াড্রোবের উপরেই পাবি ফুলদানিটা। দুইহাতে একসাথে ধরবি ফুলদানিটা আর হাতের তালুতে আঁকা চোখগুলো যেন ফুলদানিটার গায়ের সাথে লেগে থাকে, এটা কিন্তু খুব জরুরী, ভুলে যাস না আল্লাহর দোহায়। আর ঠিক এই সময় যদি মনে হয়, কিছু একটা তোকে ধরতে চেষ্টা করছে, পাত্তা দিস না, তোর কোন ক্ষতি করতে পারবে না ওরা।
এবার ফুলদানিটা কাঁত করে ভিতরের সব রক্ত ফেলে দিবি। সব ফেলে দিবি, সব। এক ফোঁটাও যেন না থাকে, সাবধান। রক্ত পড়ার সময় ভুলেও ফুলদানির ভিতরে তাকাবি না। আঙ্গুলও ঢুকাবি না খবরদার। ফুলদানি খালি হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি ব্যাগে ভরে বের হয়ে আসবি বাসা থেকে। এরপর ওটা এমন কোথাও ফেলে দিবি যেন কেউ কোনদিন খুঁজে না পায়। তোকে অনেক ঝামেলায় ফেলে দিলাম চন্দন, কিছু মনে করিস না প্লিজ। কিন্তু তুই ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করি না আমি, জানিসই তো! আমি এখন যা জানি এসব যদি আগেই জানতাম, তাহলে এইসবের কিছুই হতো না কোনদিন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে খুব তাড়াতাড়ি দেখা হবে আমাদের। সাবধানে থাকিস। মিথিলা।”
আগা মাথা কিছুই বুঝলাম না। ঠাট্টা কিনা কে জানে। নাকি ওর চিরাচরিত মজাগুলো করছে, যেন আমি অস্থির হয়ে লাফালাফি শুরু করি? ফোন করেই না হয় দেখি, আসল ঘটনাটা কি। ১২/১৩ বার ফোন করলাম, কিন্তু ধরল না একবারও। মেসেজ পাঠালাম, “মিথি, ফোন ধরছিস না কেন? তোর ইমেইল পরলাম কিন্তু কিছুই বুঝলাম না। তুই কেমন আছিস, খারাপ কিছু হয়নি তো? জানা আমাকে প্লিজ।” মেসেজ পাঠিয়েই আবার ফোন দিলাম, রিং হচ্ছে। যখন মনে করলাম এবারও ধরবে না ঠিক তখনই রিসিভ হল। ওপাশ থেকে চাপা একটা ফোঁপানির মত শব্দ হল, “বাঁচা আমাকে প্লিজ।” ভয়ে হাত থেকে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল ফোনটা। “মিথি?” প্রায় চিৎকার করে উঠলাম, “কি হয়েছে তোর?”
“বাঁচা আমাকে,” আবারো বলল মিথিলা, ফিসফিস করে কথা বলছে, যেন ভয় পাচ্ছে কেউ শুনে ফেলবে। ফোনের মধ্যে ঘস ঘসে একটা শব্দ হচ্ছে, আস্তে আস্তে বাড়ছে শব্দটা। “আমার ভয় লাগছে, আমার ভয় লাগছে, আমার ভয় লাগছে”। শব্দটা এতোই বেড়ে গেল, ওর গলার আওয়াজটাই এখন আর শোনা যাচ্ছে না। “মিথি, কি হয়েছে আমাকে বল।” চিৎকার করে যাচ্ছি আমি। এবার ফোনটা একদমই বন্ধ হয়ে গেল, হতভম্বের মত ফোনের দিকে তাকিয়ে আছি, ওর কথাগুলো কানে বাজছে। আবারো ফোন দিলাম, ফোন বন্ধ। টেবিলের ড্রয়ার থেকে মোমবাতি, কাঁধের ব্যাগটা আর গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলাম বাসা থেকে।
মিথিলার বাবা মা ঢাকার বাইরে থাকেন, চাকুরীর জন্য ঢাকাতেই থাকতে হয় ওকে। মালিবাগ চৌধুরী পাড়ার ভিতরে একটা চিপা রাস্তায় ৭ তলা একটা ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে, দুই রুমের ছোট একটা বাসায় ও আর এক সিনিয়র আপু থাকতো। আপুটার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ওকে এখন একাই থাকতে হচ্ছে। অফিস কাছে হওয়ায় অন্য কোথাও আর যায়নি ও। যাইহোক, যেতে হবে সেই মালিবাগ, যত দ্রুত সম্ভব জ্যাম কাটিয়ে যেতে থাকলাম, এতো রাতেও এইরকম ভয়াবহ জ্যাম কেন রাস্তায় কে জানে, আশ্চর্য। যেতে যেতে আরও কয়েকবার চেষ্টা করলাম ফোনে, কিন্তু এখনো বন্ধ বলছে।
গাড়িটা একটু দূরে রেখে দৌড়ে গেলাম ওর বিল্ডিঙের নীচে, কলাপসিবল গেট পার হয়ে এক এক লাফে দুইটা করে সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে চলে আসলাম ছাদে। ওর বাসার দরজার একসেট চাবি আছে আমার কাছে, মেইন দরজার চাবি বেঁছে নিয়ে তালায় ঢুকালাম। বড় একটা শ্বাস নিয়ে খুলে ফেললাম দরজা। হয়রানও হয়ে গেছি, জোরে জোরে হাঁপাচ্ছি। বাসার ভিতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার, এর থেকে অন্ধকার হওয়া সম্ভব না কোনভাবেই। দরজার পাশের দেয়াল হাতড়াতে লাগলাম লাইটের সুইচ অন করার জন্য, আর তখনই মিথিলার নিয়মের কথা মনে পরে গেল, “কোনভাবেই লাইট জ্বালাবি না। মোমবাতি দিয়ে কাজ সারবি।”
ব্যাগ থেকে মোমবাতি বের করে লাইটার দিয়ে জ্বালালাম। এবার ওর রুমের দিকে হাঁটা ধরলাম। মোমবাতির আলো এদিকে ওদিকে বেঁকে যাচ্ছে আর দেয়ালে অদ্ভুত আর বিদঘুটে সব ছায়া তৈরি হচ্ছে। গায়ের মধ্যে কেমন একটা সিরসির ভাব শুরু হল, অজানা ভয়ে সম্ভবত। “মিথি মিথিলা!” ফিসফিস করে ডাকলাম ওকে। বাসার ভিতরে কেমন যেন একটা গন্ধ। যতই ওর রুমের দিকে যাচ্ছি গন্ধটা ততই বেড়ে যাচ্ছে, আর অস্বস্তিটা আরও চেপে বসছে, মনে হচ্ছে, কোন কিছুই ঠিক নেই এখানে, অনেক বড় ঝামেলা আছে।
রুমের সামনে এসে নব ঘুরিয়ে খুলে ফেললাম দরজাটা। সাথে সাথে ফিসফিস শুরু হল, চাপা কিন্তু অসংখ্য মানুষ যেন একসাথে ফিসফিস করছে, একসাথে একই কথা বলছে, যেন গান গাইছে কোন। প্রথমে বুঝতেই পারলাম না কি বলছে, একটু পরে ধরতে পারলাম কি বলছে ওরা –“লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও।” অসম্ভব অন্ধকার রুমের ভিতরে। “লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও।” লাইট জ্বালাতে ইচ্ছে করছে খুব, মনে হচ্ছে ওদের কথাই ঠিক, আসলেই অনেক বেশি অন্ধকার। “লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও, লাইটটা জ্বালাও।”
ওদের কথা ফেলা অসম্ভব হয়ে উঠছে। মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে লাইটগুলো জ্বালিয়ে দেই। মোমবাতিটাও কেমন অদ্ভুত আচরণ করছে, শিখাটা লাফালাফি করছে, এদিক ওদিক বেঁকে চুরে যাচ্ছে, ঝড়ো বাতাসের মধ্যে যেমন করে, অথচ রুমের মধ্যে একফোঁটাও বাতাস নেই, বদ্ধ আর গুমোট একটা ভাব। মিথিলার কথামত ফুলদানিটা ওয়াড্রোবের উপরেই দেখলাম। পেটটা অনেক চওড়া, লম্বা গলা, উপরের দিকে চিকন হয়ে গেছে, মুখের কাছে এসে একেবারে ছোট হয়েছে, একসাথে বড়জোর দুইটা আঙ্গুল ঢুকবে। মোমবাতিটা ওয়াড্রোবের উপরে রেখে, দুহাত দিয়ে একসাথে ধরলাম ফুলদানিটা, ঠিক যেভাবে বলেছিল মিথিলা। হাল্কা গরম ছ্যাঁক লাগলো, যেন চুলা থেকে নামানো হয়েছে ওটা একটু আগে।
হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই, মোমবাতির শিখাটা দুইবার লাফিয়ে উঠেই দপ করে নিভে গেল। তীব্র অন্ধকারে ডুবে গেলাম আমি। নিজের হাতগুলোও দেখতে পাচ্ছি না। ফিসফিস বেড়ে গেল আগের থেকে। বাড়ছেই ক্রমাগত। আর আর কি যেন একটা … না না, একটা না, অনেকগুলো হাত যেন টেনে ধরতে চাইছে আমাকে। আতঙ্কে সড়সড় করে দাঁড়িয়ে গেল ঘাড়ের পিছনের চুলগুলো। মেরুদণ্ড বেয়ে একটা বরফের টুকরা গড়িয়ে গেল যেন নিচের দিকে। মেসেজে মিথিলা অবশ্য বলেছিল, ভয় না পেতে, ওরা নাকি কিছু করতে পারবে না, সত্যিই কি পারবে না?
ঠিক তখনই মিথিলার আরেকটা সাবধান বানী মনে পড়ে গেল। দুই হাতের তালুতে কালো মার্কার পেন দিয়ে চোখ আঁকতে বলেছিল। আর চোখগুলো যেন ফুলদানির শরীরের সাথে লেগে থাকে। মনে ছিল না আমার, বেমালুম ভুলে গেছি আমি। “এখন আর কিচ্ছু করার নেই। যা হওয়ার তাই হবে।” মনে মনে ভাবলাম। অন্ধকারের মধ্যেই ফুলদানিটা কাঁত করে ধরলাম, ঘন কিছু মেঝেতে পড়ার শব্দ শুনতে পেলাম, রুমটা বিচ্ছিরী পোড়া তামাটে গন্ধে ভরে যাচ্ছে, আগের গন্ধটার সাথে মিশে আরও উদ্ভট একটা গন্ধ তৈরি করছে। সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠলো আমার।
জানি না কতক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছি আমি, সময় সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। হয়ত এক মিনিট বা এক ঘণ্টা, নাকি আরও বেশি, কে জানে? টুপ টুপ করে পড়েই যাচ্ছে কিছু একটা, মিথিলা বলেছিল রক্ত! রক্ত কেন এর ভিতরে? কিসের রক্ত? ফিসফিস আওয়াজটাও থামছে না, হয়েই যাচ্ছে। আরও কতক্ষণ পর জানি না, রক্ত পড়ার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল একেবারে, সাথে সাথে ফিসফিস শব্দটাও থেমে গেল। কবরের নিস্তব্ধতা চারিদিকে। মনে হচ্ছে, পৃথিবীর একমাত্র জীবিত প্রাণী আমি। হঠাৎ উন্মাদের মত একটা ভয় চেপে বসল আমার মনে, হাত পা সহ সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে, মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে, প্রায় অসুস্থ হয়ে গেলাম। জীবনে এতো ভয় কোনদিন পাইনি আমি।
ঠক করে ওয়াড্রোবের উপর ফুলদানিটা রেখে পায়ের কাছ থেকে ব্যাগটা নিয়ে চেন খুললাম, ফুলদানিটা ভিতরে ঢুকিয়ে চেন আঁটকে হুড়মুড় করে বের হয়ে আসলাম বাসা থেকে। কোনরকমে তালা লাগিয়ে, লাফিয়ে লাফিয়ে নিচে নেমে আসলাম। তারপর এক দৌড়ে গাড়ির কাছে। গাড়ির ব্যাক সিটে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিলাম, তারপর ইঞ্জিন স্টার্ট দিলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে মোবাইলটা বের করে আবারও ফোন দিলাম মিথিলাকে, কিন্তু যে কে সেই! ফোন বন্ধ।
হঠাৎ আমার দুই হাতের তালু গরম হয়ে দপদপ করতে শুরু করল আর প্রায় একই সাথে ফিসফিস শব্দটা আবার শুরু হল। চারিদিক থেকে শব্দটা আসছে মনে হল, বাড়ছে ক্রমাগত, আমাকে ঘিরে ফেলল, আমার ভিতরে ঢুঁকে যাবে যেন।
অনেক রাত, রাস্তা শুনশান, ঝড়ের বেগে গাড়ি ছুটালাম হাতির ঝিলের দিকে, ঝিলের ভিতরেই ছুঁড়ে ফেলবো ফুলদানিটা, কেউ যেন খুঁজে না পায় কোনদিন। কিন্তু ফিসফিস শব্দটা বলে যাচ্ছে, আমার বাসায় যেতে, না শোনার চেষ্টা করছি কিন্তু মন ঘুরে যেতে চাইছে। “বাসায় যাও, বাসায় যাও, বাসায় যাও, বাসায় যাও, বাসায় যাও।” আর একটু গেলেই হাতে বাঁয়ে হাতির ঝিল আর সোজা গেলে আমার বাসা। ফিসফিস বেড়ে গেছে বহুগুণে, কোনভাবেই মনকে কন্ট্রোল করতে পারছি না। চলে এসেছে হাতির ঝিল, বাঁয়ে যেতে হবে এবার।
পারলাম না আমি, মেনে নিলাম ওদের কথা, ঠিক আগ মুহূর্তে সোজা রওনা হয়ে গেলাম আমি, আমার বাসার দিকে। পিতলের ফুলদানিটা নিয়ে বাসায় ঢুকলাম। ফিসফিসটা যখনই শুরু হয়, প্রত্যেকবার একই নিয়মে শুরু হয়। প্রথমে ফিসফিস, কখনো অনেক মানুষের ফিসফিস, কখনো একজন। কখনো মনে হয় আমার মা কথা বলছেন আবার কখনো মনে হয় মিথিলা কথা বলছে। ওরা কি বলে এখন আমি বুঝতে পারি। স্পষ্ট কথা। কখনো বলে, “খাওয়াও আমাদের, খাওয়াও আমাদের, খাওয়াও আমাদের, খাওয়াও আমাদের।” আবার কখনো, “লাইট জ্বালাও, লাইট জ্বালাও, লাইট জ্বালাও, লাইট জ্বালাও।” আবার মাঝে মাঝে বলে, নাহ আমি আর বলতে চাই না, শরীর হিম হয়ে আসে ভয়ে। ফিসফিসটা বাড়তে বাড়তে চরমে উঠে যায়, আমার সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়, ওদের কথা শুনতে বাধ্য হই।
হাত ফুলদানির মুখের উপর ধরে ছুড়ি দেয়ে কেটে রক্ত ফেলতে থাকি ফুলদানির ভিতরে। এভাবেই ওদের খাওয়াই আমি। ফুলদানির দাস আমি এখন। রাত দিন ওকে খাওয়াতে হয় আমাকে, ওটার মুখ পর্যন্ত, কানায় কানায় ভর্তি করতে হবে। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছি আমি, এতো দুর্বল হয়ে গেছি বলার মত না। কিন্তু ওটাকে খাওয়াতেই হবে, ওর খুদা লাগতে দেয়া যাবে না। খুদা লাগা ওর পছন্দ না মোটেও।
আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি মনে হচ্ছে। নিজেকে বিধ্বস্ত লাগে। তারমানে কি আমি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি? বলতে চাচ্ছি, উন্মাদ মানুষ তো নিজেদের উন্মাদ মনে করে না, নাকি করে? আপনার যদি নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়ে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে আপনি কিভাবে মানসিকভাবে অসুস্থ হবেন? আমি তো নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করতে পারছি, তাহলে এখনও ঠিক ওই পর্যায়ে যায়নি পরিস্থিতি, নাকি গেছে? উফ কিসব ভাবছি আমি, কাজ করছে না মাথা, একেবারেই করছে না।
ফিসফিস আওয়াজ শুরু হল আবার। ফুলদানিটা প্রায় ভর্তি হয়ে গেছে। আর একটু বাকি আছে, ওইটুকু ভর্তি হলেই সম্ভবত সন্তুষ্ট হবে ওটা, তারপর হয়ত আর খাবার চাইবে না! একটা ভুল, মাত্র একটা ভুলের কারণেই এই অবস্থা তৈরি হল। হাতের তালুতে চোখ আঁকাতে ভুলে গিয়েছিলাম আমি। বিছানা থেকে উঠে ধীরে ধীরে টেবিলে গিয়ে বসলাম। প্রিয় ডায়রিটা নিয়ে লিখতে বসলাম। থরথর করে কাঁপছে হাত, কিছুটা দুর্বলতার জন্য আর কিছুটা ভয়ে, মৃত্যুর ভয়ে।
“মিথি, জানি না এটা পড়বি কিনা। তুই নিশ্চয় বের হতে পেরেছিস এই মরণ ফাঁদ থেকে, বেঁচে গেছিস, আমার খুব খুশি লাগছে। আমি তোর কথামত কাজ করতে পারিনি, একটা ভুল করে ফেলেছিলাম আমি, অনেক বড় একটা ভুল, পারলে ক্ষমা করিস আমাকে। আর আমি যদি কোনদিন, পালাতে পারি এখান থেকে, তোকে ঠিক খুঁজে বের করবো, যেখানেই থাকিস না কেন, ঠিকই খুঁজে বের করবো, দেখিস তুই। আর তখন এই উদ্ভট পাগলামিটা নিয়ে দুইজনে খুব হাসবো। ভালো থাকিস আর সাবধানে থাকিস।