সৌরভের সাথে আমার সম্পর্কের যেদিন এক বছর পূর্ণ হলো, সেদিন ওকে নিয়ে বাসায় আসলাম বাবা আর মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। বাবা-মা’র সাথে আমার সম্পর্ক একেবারে বন্ধুর মতো, তাই কোনরকম ভনিতা ছাড়াই তাদেরকে বললাম,
— ও হলো সৌরভ। ভবিষ্যতে ও ই হবে তোমাদের একমাত্র মেয়ে জামাই। বাবা স্মিত হেসে বললেন,
— তোরা বসে গল্প কর, আমি আসছি এই বলে বাবা নিজের রুমে চলে গেলেন।
— আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি বলে মা ও ভেতরে চলে গেলেন।
আমি শ্রাবণী। বিত্তশালী বাবার একমাত্র সন্তান। আমার বাবা শুধুমাত্র ধনসম্পত্তির দিক দিয়েই বিত্তশালী ছিলেন না, মনের দিক দিয়ে এবং চরিত্রের দিক দিয়েও তিনি ছিলেন বিত্তশালী। সেই ছোটবেলা থেকেই আশপাশের সবার কাছ থেকে বাবার সততার গল্প শুনে আসছি। আমার মতে আমার বাবা হচ্ছেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। ছোটবেলা থেকেই আমার যতো আবদার, যতো গল্প- সব ছিলো বাবার সাথেই। তাইতো মাঝেমধ্যে মা অভিমান করে বলতেন,
— তুই তো শুধু তোর বাবারই মেয়ে! আমি তো তোর কেউ না তখন মায়ের রাগ ভাঙাতে মাকে জড়িয়ে ধরলে মা হেসে দিয়ে বলতেন,
— হয়েছে, হয়েছে… আমাকে আর ভুলাতে হবে না। তুই তোর বাবার রাজকন্যা হয়েই সুখে থাক– আমিও সেটাই চাই।সৌরভের সাথে বাবা – মায়ের পরিচয় করিয়ে দেয়ার বেশ কিছুদিন পরে এক সন্ধ্যাবেলা বাবা হন্তদন্ত হয়ে আমার রুমে এসে বললেন,
— আমার সাথে একটু বাইরে চল তো মামণি… আর একটা কথা — এখন আমাকে কোন প্রশ্ন করতে পারবি না। সময় হলে নিজেই উত্তর পেয়ে যাবি। বিনা বাক্য ব্যয়ে সাথে সাথে বাবার সাথে বাইরে বের হয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়িতে উঠে দেখি মা আগে থেকেই গাড়িতে বসে আছেন। ভীষণ অবাক হলাম যখন দেখলাম বাবা গাড়িটি সৌরভদের বাড়ির সামনে দাঁড় করালেন। এবার তিনি গাড়ির ভেতরে বসেই বললেন,
— যা, মা, বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখে আয় সৌরভ ছেলেটির আসল চেহারা। সৌরভদের বাড়িতে আমি এর আগে মাত্র একবার এসেছিলাম ওর সাথেই। সেদিন ও আমাকে ওর বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। সেজন্য ওদের দারোয়ান আঙ্কেল আমাকে বেশ ভালো করেই চেনেন। তাই আজ আমাকে দেখামাত্র একটা সালাম দিয়ে বললেন,
— যান আপামণি, ভেতরে যান। ভাইজানে ভিতরেই আছে।
অনেকগুলো প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। কেন বাবা কোন কিছু না বলে আমাকে ভেতরে আসতে বললেন? বাবা আমাকে এখানে আনার জন্য ডাক দেয়ার সময়ও তো আমি মেসেঞ্জারে সৌরভের সাথে চ্যাটিং করছিলাম। ও তো বলেছিলো ওরা ফ্যামিলির সবাই একসাথে গ্রামের বাড়িতে গেছে, তাহলে সৌরভ এখন বাসায় থাকে কি করে? বাড়ি যাওয়ার পথে সৌরভ আবার কোন এ্যাকসিডেন্ট করেনি তো? এসব ভাবতে ভাবতে একবারেই দোতলায় উঠে এলাম। বাড়িতে ওর বাবা-মা,বোন- কারোই সাড়া-শব্দ পেলাম না। ওরা বোধহয় গ্রামের বাড়িতেই গেছে। কোন গৃহকর্মীদেরও টের পেলাম না। হয়তো এই ক’দিনের জন্য ছুটিতে আছে। তাহলে কি সৌরভ এখন বাসায় সম্পূর্ণ একা? সৌরভের রুমের কাছে এসে দেখি রুমের দরজা আটকানো। নক করার জন্য হাত উঠিয়ে আমার হাতটা আটকে গেলো– একটা মেয়ের খিলখিল হাসিতে… হাসতে হাসতেই সে বলছে,
— ওহ… সৌরভ, তুমি এতো ভালো জোকস বলতে পারো আগে তো জানতাম না এবার সৌরভের কথা শুনতে পেলাম,
— তুমি তো আমার সম্পর্কে আরো অনেক কিছুই জানো না। কাল যখন আমরা দু’জন একসাথে কক্সবাজারে যাবো, তখন তুমি আমাকে কিছুটা হলেও জানতে পারবে এতো বড় প্রতারণা আমার সাথে! আর সহ্য করতে পারলাম না আমি। নক না করে একবারেই দরজাটা জোরে ধাক্কা দিলাম। দরজাটা শুধুই ভেজানো ছিলো। হয়তো বাসায় অন্য কেউ নেই বলেই দরজাটা লক করার প্রয়োজন বোধ করেনি ওরা। ভিতরে ঢুকে অপরিচিত একটি মেয়ের সাথে সৌরভকে যেভাবে দেখলাম, তাতে আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেলো। আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সৌরভের গালে কষে একটা চড় দিলাম। তারপর হুঙ্কার দিয়ে বললাম,
— তুই নাকি গ্রামের বাড়িতে গেছিস? এই তোর গ্রামের বাড়ি? জীবনে আর কোনোদিন যেনো তোর মতো ভন্ড-প্রতারকের এই মুখখানা আমি না দেখি সৌরভ মিনমিন করে কিছু একটা বলতে গিয়েছিলো, কিন্তু আমি নিজের কানে যা শুনেছি আর নিজের চোখে যা দেখেছি– তারপর ওর কোনো কথা শোনা তো দূরের কথা, ওর দিকে তাকাতেই আমার ঘৃণা হচ্ছিলো। আমি রুমের বাইরে এসে ওর মুখের উপরে দরজাটা ধরাম করে আটকে দিলাম।
অনেক চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারলাম না। রাগে, দুঃখে, অপমানে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে এলো। ওড়না দিয়ে মুছে ফেললাম চোখের পানিটুকু। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলাম। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। বার বার আমার দু’চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো। আমার ভালোবাসায় তো কোন খাদ ছিলো না, কোন অপবিত্রতা ছিলো না। তাহলে কেন আমার সাথে এমন হলো! ওদের বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা গাড়িতে উঠে মা’য়ের পাশে বসলাম। বাবা গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি মায়ের পাশে বসতেই বাবা এসে আমার পাশে বসলেন। এবার আর সামলাতে পারলামনা নিজেকে। বাবা-মা দু’জনকেই জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। মা আমাকে তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে রাখলেন। বাবা ড্রাইভার আঙ্কেলকে বাড়ির দিকে গাড়ি ঘুরাতে বলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত হতে বললেন। আরো বললেন,
— একদম মন খারাপ করিস না মা। আল্লাহ যা করেন, মঙ্গলের জন্য ই করেন নিশ্চয়ই তিনি এই ভন্ড-প্রতারক ছেলেটার চেয়ে হাজার গুন ভালো কাউকে তোর জীবনে এনে দেবেন এরপর বাবা বলতে লাগলেন আমাদের ড্রাইভার আঙ্কেল, সৌরভদের দারোয়ান আঙ্কেল আর বাবার পরিচিত কিছু লোকের মাধ্যমে তিনি কিভাবে সৌরভের আসল রূপ টি খুঁজে বের করেছেন। তিনি বলেই চলেছেন…
— আমার আদরের রাজকন্যা যার সাথে সারা জীবন কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাকে ভালো করে জানার জন্যই আমি ওদের সবাইকে দিয়ে ছেলেটার উপর একটু গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে ছেলেটার আসল চেহারা ধরে ফেলেছি বাবার কথা শুনতে শুনতে মনে হলো আমার বাবা একজন অনেক বড় ম্যাজিশিয়ান। কেমন ম্যাজিকের সাহায্যে আমাকে একটা ভয়ঙ্কর রাক্ষসের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিলেন! আমি বাবার কথা শুনছি আর মনে মনে ভাবছি শুধুমাত্র মেয়েরাই যে রাক্ষসের খপ্পরে পড়ে সেটা তো না, কখনো কখনো ছেলেরাও তো পড়ে যায় রাক্ষসীর কবলে! আহারে! পৃথিবীর সকল বাবা যদি আমার বাবার মতো এমন ম্যাজিশিয়ান হতেন, তাহলে পৃথিবীর সকল সন্তানদের জীবনও হয়তো রাক্ষস আর রাক্ষসীদের হাত থেকে এভাবেই রক্ষা পেতো!