নিয়তি

নিয়তি

আমার প্রিয় ছাত্রীকে নিয়ে আজ আমি দেশ ছাড়া হয়েছি! রুপে গুণে বড় লোকের এক অনন্যা কন্যা আমার এই ছাত্রী। তারাহুরো করে এক বন্ধুর মেসেই উঠে পড়লাম। চিন্তা করে দেখলাম এরচেয়ে নিরাপদ জায়গা আর নেই । সাথী আমার জীবন সাথী। সাথী আহসান ওর নাম! পিতা রিজভী আহসান। তার একমাত্র কন্যা এই সাথী আহসান । কোনদিক দিয়েই আমি ওর যোগ্য নই। কিন্তু তবুও ও আমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবেসে আমার হাত ধরে বাবার ঐশ্বর্য ফেলে ঘর ছাড়া হয়েছে।

তাই ওর প্রতি আমার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা অনেক বেশি বেড়ে গেল। আমি নিজেকে কষ্ট দিতে রাজি কিন্তু ওকে নয়।আমি আমার বাবা মায়ের স্বপ্ন লেখা পড়া শেষ করে বড় চাকরি করবো। এবং তাদের গরীবি ঘোচানোর দায়িত্ব নেব কিন্তু প্রেমের টানে যে দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিলাম।

তাকি সঠিক হলো কিনা তা ভাবার সময় বা অবকাশ আমি পেলাম না। তাও আবার এমন সময় যখন আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল পরিক্ষা সামনে রেখে। কি করবো আমি পরিক্ষার চিন্তা করে যদি একাজ না করি তবে যে জীবনের পরিক্ষায় সারাজীবনের মতো আমি ফেল হয়ে যাবো।

সাথীর বাবা রিজভী আহসান তার বন্ধুর ছেলের সাথে যে তার মেয়ের বিয়েটা ফাইনাল করে ফেলেছেন। তাই একটা ফাইনাল মাথা থেকে ঝেড়ে আরেক ফাইনাল নিয়ে আমাকে ভাবতে হলো। যাক এখন আপাতত আমরা নিরাপদে আমার বন্ধু শাওনের মেসে আছি।

কিন্তু মাথায় চিন্তা পরিক্ষাটা কি করে দেই? নয়তো বাবা মায়ের স্বপ্ন যে একেবারে মিথ্যা হয়ে যায়! অনেক খবর নিয়ে জানতে পারলাম সাথীর বাবা! আমাকে ধরার জন্য সব রকম ব্যাবস্থাই করে রেখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে রোজ আমার জন্য নিয়মিত পাহারার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। তারা ওঁৎ পেতে আছে কখন আমি ওদিকে যাই। আর আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের ইচ্ছে মতো শোধ নেবে।

মনে মনে এবার পরিক্ষা দেবার চিন্তা বাদ দিয়ে। বন্ধু শাওনের কাছে বললাম একটা চাকরির ব্যাবস্থা করে দেবার জন্য। পেট দুটি তো চালাতে হবে? বন্ধু আমার ভরসা না দিলেও আশ্বাস দিলো চেষ্টা করবে। শাওনের রুমমেট চলে যাওয়াতে রুমটা এখন আমরা দুজনেই ব্যাবহার করছি। শাওন বলে, এখানে তো আর বেশি দিন থাকা যাবেনা। আর এভাবে বিয়ে করা ছাড়া তোরা দুজন এভাবে এক ঘরে রাতকাটানো ঠিক কেমন দৃষ্টি কটু। আমি বললাম বিয়ে যে করবো তার টাকাও তো আমার নেই!

শাওন বিয়ের সব ব্যাবস্থা,করে দিলো। আমাদের বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ে তো হয়ে গেল কিন্তু সংসার কি করে চালাবো তার চিন্তাই আমার মাথায় ভর করতে লাগলো। আমাদের বাসর হলো একটা মেসে! ছোট একটা চৌকিতে। কয়েকটি ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়ে বাসর ঘরের ভাব ফুটানো হলো। ভাবি, গরীবের বাসর এই ঢের! কিন্তু সাথী, সে চাইলে তার বাসর হতে পারতো শহরের আট দশটা বড়লোকের কন্যাদের মতোই। কিন্তু তাতেও ওর মুখে কোন অসন্তোষ প্রকাশ পায়নি। নিজেকে বড় ভাগ্যভান মনে হলো।

পরদিন শাওন এসে বলে, তোর জন্য একটা চাকরির ব্যাবস্থা করেছি। এখান থেকে একটু দূরে। মতিঝিল। তোর জন্য এটাই সুবিধা হবে। তোর শ্বশুরের দৃষ্টির আড়ালে লুকিয়ে থাকতে পারবি। আমি খুসি হয়ে গেলাম। একটা ট্রাভেল এজেন্সি। সেখানে সহকারী ম্যানেজার হিসাবে জয়েন করতে হবে। তারা আমাকে প্রশ্ন করে বেশ সন্তুষ্ট হলো আমিও চাকরি পাওয়ার আনন্দে বাড়ি মানে মেসে যাবার জন্য উতলা হয়ে উঠলাম মনে মনে। কিন্তু তারা আমায় ছাড়লো অনেক রাতে। রাস্তায় তখন লোকজন কমে এসেছে। আমি ক্লান্ত দেহে অলস ভাবে হাটছিলাম বাড়ির পথ ধরে।

হঠাৎই একটা দৌড়া দৌড়ি শুরু হয়ে গেল রাস্তায়। আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিনা। দৌড় দিবো নাকি হেঁটে যাবো? ঠিক এমন সময় একটা লোক আমার দিকে একটা ব্যাগ ছুড়ে মারে। আমি ব্যাগটা হাতে নিয়ে লোকটাকে ডাকলাম কিন্তু সে ফিরে তাকালোনা। মূহুর্তের মধ্যে একটা অন্ধকার গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আমি হতবাক হয়ে ভাবছি ব্যাগটা কেন আমার দিকে ছুড়ে দিয়ে লোকটা চলে গেল? কি আছে ব্যাগের ভেতর? একবার ভাবলাম খুলে দেখি আবার ভাবলাম না দেখাই ভালো। কিন্তু ব্যাগটা কি করবো? এসব নিয়ে যখন দ্বিধা দ্বন্দ্ব এ ভুগছি। ঠিক তখনই কয়েকটি পুলিশ দৌড়ে চলে এলো আমার কাছে।

আমাকে তারা সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বললো। ব্যাগের ভেতর কি আছে? আমি সত্যি কথাটা ভললাম, জানিনা! তখন পুলিশের সন্দেহ আরও বেড়ে গেল আমার প্রতি। একজন বললো, মিথ্যা বলার আর জায়গা পাসনা। তোর হাতে ব্যাগ আর তুই বলছিস জানিনা। তাও আমাদের বিশ্বাস করতে হবে? আমি বললাম সত্যি আমি কিছু জানিনা। ওরা বলে, তবে কি ব্যাগ আকাশ থেকে উড়ে এসে তোর হাতে পড়লো? আমি বললাম না! একজন লোক আমার দিকে ব্যাগটা ছুঁড়ে দিয়ে পালিয়ে গেল।

তখন একজন পুলিশ ব্যাগটা হাতে নিয়ে খুলে ফেললো। আমাকে ছাড়া সবাই দেখে জিজ্ঞেস করলো। বল এগুলো কোথায় পেয়েছিস? আমি না দেখেই বললাম। আগেই তো বলেছি। তখন একটা পুলিশ আমার হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে ফেললো। এবং ব্যাগের ভেতরটা দেখিয়ে বলে, তুমি কিছু জানো না জানো চাদু তা একটু পরেই বোঝা যাবে।

আমি তো ব্যাগের ভেতরের জিনিস দেখে রীতিমতো ঘামতে লাগলাম। ব্যাগে একটা পিস্তল আর অনেক গুলো হাজার টাকা বান্ডিল! আমাকে অনেক মারধর করা হলো। অবশেষে চালান করে দেওয়া হলো। আমি অনেক চেষ্টা করলাম ওদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কিন্তু পারলামনা। শাওনের মোবাইল বারবার বন্ধ দেখাচ্ছিল।

আমার পক্ষে কোন তদবিরের লোক না থাকায়। আমার জেল হয়ে গেল। আমি যে হাতনাতে অস্ত্র নিয়ে ধরা পড়েছি। তাও আবার পিস্তল থেকে দুটি গুলিও করা হয়েছিল! কোথায় কিভাবে কাকে গুলি দুটো করেছি তাই জানার জন্য পুলিশ মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু হাজার মারধর করেও ওরা কোন কিছু জানতে পারে না। আমি তখন পঙ্গু প্রায়!

একবার মনে হয়েছিল গ্রামে খবর দেই কিন্তু পরে ভাবলাম। আমার নিরীহ বাবা-মা, ভাই বোন একটা ঝামেলায় পড়ে যাবে কিন্তু কিছুই করতে পারবেনা। বরং আমাকে ছুটাবার জন্য ভিটে মাটি বিক্রি করে পথে বসবে! অথবা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে হৃদয়ে কষ্ট নিয়ে ফিরে যাবে। কারণ আমি যে এখন দাগী আসামি। তাই ললাটে যা ছিলো তাই মেনে নিলাম। মাঝে মাঝে সাথীর কথা মনে পড়ে। বসে ভাবি সাথী এখন কোথায় তার বাপের বাড়ি চলে গেছে নাকি শাওন আমার বাবা মায়ের কাছে তাকে রেখে এসেছে?

একদিন আমাকে আবার কোর্ট এ তলব করা হলো। এলজন আমাকে দেখে বললো হ্যা! এই লোকটাই হবে। অন্ধকারে সে আমাকে গুলি করে টাকার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছিলো। আমি বললাম আমি নই! কিন্তু কে আমার কথা বিশ্বাস করবে? আমার শাস্তি পাকা পোক্ত হলো। অপরাধের পর অপরাধের চিহ্ন লাগলো আমার গায়ে। আমাকে কড়া পাহারায় রাখা হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার ভালো ব্যাবহার দেখে কড়াকড়ি কিছুটা শীতল হলো। অনেকেই বুঝতে পারলো আমি বিনা অপরাধ করে শাস্তি পাচ্ছি। কিন্তু তাতে লাভ কি। কোন প্রমাণ তো নেই যে আমি নিরপরাধ!

শহরের অনেক গুন্ডা পান্ডাদের সাথে আলাপ হলো। সকলে আমার ব্যাবহারে তুষ্ট হয়ে বলে, বের হয়ে প্রয়োজনে যেন তাদের সাথে দেখা করি। এভাবে দিন যেতে লাগলো। বছর ঘুরে ঘুরে আট বছর পূর্ণ হয়ে গেল। আমি এভাবে বন্দী থাকতে থাকতে আশা ও কর্ম ক্ষমতা হারালাম। তার,সাথে হারালাম মনোবল! একদিন জেলার সাহেব সুসংবাদ নিয়ে এলেন। আমার শাস্তির মেয়াদ শেষ!

আমি ছাড়া পেয়ে আনন্দে ছুটে যাই সেই মেসে কিন্তু সেখানে তারা নেই। মুক্তি পাবার আনন্দে আমার মনেই ছিলোনা জীবন থেকে প্রায় একটা যুগ হারিয়ে গেছে! সব কিছু আর আগের মতো নেই। আশা করাও ঠিক নয়। আমি অনেকের কাছে জিজ্ঞেস করলাম ওদের কথা। কিন্তু কেউ বলতে পারলোনা ওদের কথা। সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারলাম না, সাথীর খবর নিতে তার বাবার কাছে যেতে। তাই মমতাময়ীর কাছে ছুটে গেলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে মনে আরেক ধাক্কা খেলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত