জননী

জননী

স্যার আমাকে ছেড়ে দিন, আমি কিছু করিনি স্যার। স্যার দেখুন, আমি সাধারণ মানুষ। আর ওই ব্যাগটা আমার না স্যার। আমার পাশে যেই মানুষটা বসে ছিল ওই মানুষটার ব্যাগ ওটা। স্যার দয়া করুন। আমার আম্মা অসুস্থ। আমার বাবা নেই স্যার যে, আমার আম্মা কে দেখে রাখবে। স্যার দয়া করুন স্যার। আজ দুই দিন আমায় এখানে আটকে রেখেছেন। আপনাদের পায়ে পরি স্যার, আমার আম্মা মারা যাবে স্যার। আমারে ছেড়ে দিন স্যার। দয়া করুন স্যার।

—এই ছেলেটা কে??কমিশনার স্যার হাবিলদার কে প্রশ্ন করল।

হাবিলদার কিছুটা ভয়ে বলল, ইয়ে মানে স্যার, এই ছেলেটার ব্যাগ থেকেই তো ৪০ কেজি গাঁঞ্জা পেয়েছি স্যার। দেখেন দেখেন, দেখতে কি ভদ্র আর সভ্য বলে মনে হচ্ছে। আর কি সব বলে চলেছে আজ ২ দিন। স্যার ওসব মিথ্যা কথা। ওসব কথাতে কান দিয়েন না স্যার। কমিশনার স্যার আবার কাজের দিকে মনোযোগ দিল। আসিফ জেলরুম থেকে এক কথা বলেই চলেছে।

আসিফ। পেশায়, স্টুডেন্ট আর জবের মাঝামাঝি যার অবস্থান। অর্থাৎ, অনার্স কমপ্লিট করার পরই একটা চাকরি খোঁজার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হয়ে আছে জন্য একদিকে স্টুডেন্ট আর জব খুঁজছে বলে অন্যদিকে বেকারও বলা চলে। আসিফের বাবা গত হয়েছেন প্রায় ১২ বছর হতে চলল। গত ১০ বছর, আম্মা জয়নাব বেগম অনেক কষ্ট করে, জমির দেখাশোনা করে, আসিফকে পড়াশোনাটা করিয়েছেন। কিন্তু উনি বুঝে উঠতে পারেন নি, যে ওনার দেবররা, মানে আসিফের কাকারা ঠিক কি চাল চেলেছে। আসিফ মাত্র খেতে বসেছে। এমন সময় ওর চাচা জমির শেখ এসে দাঁড়ালো উঠানে। ডাকতে লাগল জয়নাব বেগম কে,

—হ্যাগো, আসিফের মায় বাড়িত আছো? আম্মা ইহা বড় একটা ঘোমটা দিয়ে, জি ভাই আছি। বাইরে দাঁড়াই আছেন কেন ভাই। ভিতরে আসেন। বসেন। আসিফের লগে কিছু খান।

—না না ভাবি। খাইতে আহি নাই। খালি কয়ডা কথা কইতে আইছি।কইয়াই চইলা যামু।

—কি কথা, কন ভাই। জয়নাব বেগম ঘরের চৌকাটে দাঁড়ায়ে বলল কথাটা।

–শোনেন ভাবি। আপনারা যেই জমির উপরে চাষ কইরা খাইতেছেন, ওইডা আপনাগোরে জমি না। আমাগোরে জমি। ভাই নাই জন্যি এই কয়েক বছর আপনারে জমিখানা দিয়ে রাখছিলাম। কিন্তু এহুন তো আসিফ আর ছোট নাই। মাশাল্লাহ, পড়াশোনাও শেষ। তাই কচ্ছিলাম জমিখানাতে এবার থেইকা চাষ করা বাদ দিয়েন। আসিফের মায়ের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। এইডা আপনে কি কন ভাই?? আমার স্বামীর জমি ওইডা। আমি বিয়ে হওয়ার পরতেই ওই জমিতে কাম কইরা খাই। আর আপনে এখন এইডা কি কন?

—শোনেন ভাবি, ভাই ছিল আমাদের বাপের আগের পক্ষের সন্তান। আমাদের বাপই তো আমাদের মায়ের সম্পত্তিতে বইসা বইসা খাইছে। তাইলে কি কইরা তার আগের বউ এর সন্তান আমার মায়ের সম্পত্তির ভাগ পাই কইতে পারবেন??

এর পরে জয়নাব বেগমের আর কিছু বলার ছিল না। আসিফ ঘর থেকে সবকিছু শুনেছে। প্লেটের একটা দানাও মুখে উঠেনি ওর যখন শুনতে পেল ওই জমির একটা কোনাও ওর বাবার না। জমির শেখ কথাগুলো বলার পরেই চলে গেল।

জয়নাব বেগম কেঁদে দিল। আমার এত বছরের কষ্টের ফল। এত কষ্ট কইরা জমিডারে দেইখা রাখছি। সে আমারে ভাসায় দিয়া গেল রে। শুনছোস আসিফ, তোর বাপে আমারে ডুবায় দিয়ে গেল। মায়ের কান্না কোন সন্তান সহ্য করতে পারে না। আসিফ নিজেও পারল না। খাবারের টেবিল থেকে উঠে পড়ল। মায়ের কাছে এসে বসতেই, মা জয়নাব বেগম আসিফকে ধরে কেঁদে দিল।

—বাবা আসিফ। এখন আমগোরে কি হইবো ক? আমার যে আর কিছুই রইল না বাজান।

—আম্মা তুমি কাঁন্না করো না। আর চিন্তা করো না আমিতো আছি। আমি কোন একটা কাজ জুটিয়ে নিবো।

—আসিফের মা তবুও শান্ত হলো না। এত দিন ধরে তিলে তিলে জমিটার প্রতি যে মায়া জন্মিয়েছে সেই মায়া কি এত সহজেই শেষ হয়ে যায়??

আসিফ, এর ৩ দিন পড়েই কাজের জন্য বেরিয়ে পরে। কয়েক জায়গায় ঘুরেও কোন কুল না পেয়ে এক কাঠের ব্রেঞ্চে বসে পড়ে। এত কষ্ট করে ২২, ২৩ বছর পড়াশোনা করে কি লাভ হলো?? একটা সাধারণ চাকরিও হলো না। ওদিকে চাচার কথাগুলো বলে যাওয়ার দিন রাতের ঘটনা।

আম্মা সারারাত কান্নাকাটি করে যা আসিফ পাশের ঘর থেকে বুঝতে পেরেছে। সকালের দিকে মায়ের শিয়রে গিয়ে দাঁড়িয়ে আসিফ অবাক হয়ে যায়। মায়ের মুখ থেকে কিছু একটা বের হচ্ছিল। আসিফ তাড়াতাড়ি করে ওর মাকে ধরে দেখে মায়ের শরীর টা অনেক ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। আসিফ জোরে জোরে আশেপাশের চাচিদের ডাকতে থাকে। ডাক্তার বলেছে আসিফের মা স্ট্রোক করেছে। এবং একটুর জন্য উনি বেঁচে ফিরেছেন। আসিফ যদি তাড়াতাড়ি হসপিটালাইজড না করতো তবে আসিফের মাকে বাঁচানো সম্ভব হতো না। ব্রেঞ্চে বসে এগুলোই ভাবছে আর ঠিক তখনি এক লোক এসে ওর পাশে বসল।

—কেমন আছেন ভাই?

—জি ভাই আছি। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না তবুও বলল আসিফ। তারপর মানুষ টা আর কিছু না বলেই উঠে চলে গেল। আসিফ কিছটা অবাক হয়ে গেল। মানুষ টা অদ্ভুত, আরো বেশি অবাক হলো যখন ওর পাশে একটা ব্যাগ দেখতে পেল।

–ভাই, এ, এই ভাই বলে ডাকতে ডাকতেই লোকটি রাস্তার ওপাশে চলে গিয়ে মানুষের ভিড়ে মিলিয়ে গিয়েছে।

আসিফ ভাবল মানুষ টা হয়তো ভুলে ওনার ব্যাগ টা রেখে গিয়েছে। কি করা যায়?? আচ্ছা পুলিশের কাছে গিয়ে বললে নিশ্চয় তারা মানুষটার জিনিস ওনাকে ফিরিয়ে দিবে। যেই মনে করা সেই কাজ। পাশেই পুলিশের কিছু লোককে রাস্তাতে বাইক চালকদের লাইসেন্স আছে কিনা যাচাই করতে দেখছিল। ব্যাগটা টেনে পুলিশের স্যারের কাছে গিয়ে, সব খুলে বলল আসিফ।

পুলিশের স্যার হাবিলদারকে ব্যাগে কি আছে জানার জন্য ব্যাগের মুখটা খুলতে বলল। হাবিলদার ব্যাগ খুলে দেখলো পুরো গাঁঞ্জার স্থুপ রয়েছে সেখানে। পুলিশের সুপার আসিফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হাবিলদার কে বলল আসিফকে গ্রেফতার করতে। হাবিলদার নিজের ডিউটি পালন করল। আজ ২ দিন হয়ে গিয়েছে মাকে দেখেনি আসিফ। হাসপাতালের বিলও তো পরিশোধ করার কেউ নাই ওর। মা কেমন আছে, ডাক্তাররা ট্রিটমেন্ট কি করছে?? যদি ট্রিটমেন্ট না করে আমার মায়ের?? কথাটা ভাবতেই আসিফ আবার জোরে জোরে বলতে লাগল,

—স্যার আমাকে ছেড়ে দিন স্যার। আমার মা মারা যাবে স্যার। দয়া করে আমারে ছেড়ে দিন। আরে আপনারা কিসের পুলিশ হয়েছেন?? আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাহায্যর জন্য কাজ না করে, কি বিপদে ফেলানোর জন্য পুলিশ হয়েছেন?? যে দোষী সে বাহিরে ঘুরছে আর আমি নির্দোষ হয়েও জেলেতে পড়ে আছি। কিসের পুলিশ হয়েছেন আপনারা?? আপনাদের কোন যোগ্যতাই নেই এই পুলিশের ইউনিফর্ম গায়ে উঠানোর। রাগে ক্ষোভে আসিফ এতগুলো কথা পুলিশ কমিশনার স্যারকে বলে দিল। স্যার কিছু একটা লিখছিল। এতগুলো কথা কোন মানুষ পুলিশ কে সরাসরি বলতে পারে তা ওনার জানা ছিল না। হ্যা পুলিশদেরকে মানুষ , অলক্ষ্যে,অগোচরে অনেক গালিগালাজ করে বলে জানে কিন্তু সরাসরি এইভাবে কেউ কখনো বলতে পারে বলে ওনার জানা ছিল না। কমিশনার স্যার উঠে দাঁড়াল।

—স্যার ওই পাগলের কথায় কিছু মনে কইরেন না ওরে আমি টাইট দিতেছি দাঁড়ান স্যার। হাবিলদার বলল।

—আমি তোমাকে বলেছি কিছু বলেছি??

–না না, স্যার।

—তবে চুপ থাকো

—জ,জি স্যার। কমিশনার স্যারকে আসতে দেখে আসিফ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে।

—স্যার বিশ্বাস করেন, আমি এসব কিছু জানিনা। আমিতো চাকরির জন্য শহরে আসছিলাম স্যার। আমার মা হাসপাতালের বেডে পড়ে আছে স্যার। আমার সার্টিফিকেট গুলো দেখেন স্যার আমি সত্যি একটা চাকরির জন্য এখানে এসেছিলাম স্যার।

এক এক করে কমিশনারকে সব কিছু খুলে বলে আসিফ। কমিশনার স্যার হাবিলদার কে বলল আসিফকে ছেড়ে দিতে, এবং গাড়িতে করে আসিফকে হাসপাতালে পৌছে দিতে। আসিফ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, স্যার কে সালাম দিয়ে চলে আসছিল। হঠাৎ পেছন থেকে স্যার আসিফকে ডাক দিয়ে, কিছুটা টাকা আসিফের হাতে গুজে দিলো। তাড়াতাড়ি যাও, বলে ওনার কাজের দিকে মনোযোগ দিলো। আসিফের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল। হাসপাতালে গিয়ে সব জায়গা আসিফ ওর মাকে খুঁজলো। কিন্তু কোথাও ওর মাকে না পেয়ে, শেষে ডাক্তারের কাছে গিয়ে মায়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ডাক্তাররা বলে,

–তোমার মা তো ঐদিনেই ১১ টার দিকে মারা গিয়েছে। লাশের কোন আত্মীয় পায়নি জন্য লাশকে মর্গে রাখা হয়েছে। আসিফের নিশ্বাস যেন আটকে গেল। ডাক্তার কি বলছে এগুলো। চোখের পানি ও কোনভাবেই আটকে রাখতে পারল না।

—আসলে ওনার স্ট্রোক টা অনেক বড় আকারের হয়েছিল কিন্তু আমরা ধরতে পেরেছিলাম না। ওনাকে আই-সি-ইউ তে রাখা আমাদের উচিত ছিল। কিন্তু, আই এম সরি, বলেই ডাক্তার চলে গেল।

আসিফ ফ্লোরে বসে পড়ল। মনে হচ্ছে ভেতরে থাকা কলিজাটাকে কেউ টেনে বের করে নিতে চাইছে। পরপর সেই একই ভুল আমার মায়ের ক্ষেত্রেও হলো?? আসিফ উঠে পড়ল। দৌড়ে মর্গের রুমে এসেই পা আটকে গেল। আস্তে করে রুমে ভেতরে প্রবেশ করল আসিফ। সারি সারি করে রাখা অনেকগুলো লাশের মাঝে নিজের মায়ের লাশটাকে খোঁজা যে কতটা কষ্টের সেটা শুধু সেই সন্তানই বুঝতে পারে। হঠাৎ একটা লাশের দিকে ওর চোখ পড়ল আসিফের। হাতে সবুজ রঙের চুড়ি দেখে আসিফ দৌড়ে লাশের কাছে যায়। হাত কাঁপছে ওর পুরোদমে, চোখ থেকে জল পড়েই চলেছে। সাদা কাপড় টা সড়াতেই আসিফের চোখের সামনে মা জয়নাবের চেহারাটা ভেসে উঠল।

আসিফ মা জয়নাবের মুখটাতে হাত বুলিয়ে দিলো। মায়ের কপালে চুমু দিলো, মায়ের বুকেতে মাথা রেখে বলল, মা, মাগো, ওমা। এতদিন তো আমি অর্ধেক দুনিয়া ছাড়া সন্তান ছিলাম মা। এখন যে আমি পুরো দুনিয়াটাই হারাই ফেললাম মা। ওমা, উঠো না। মাগো, মা এতক্ষণ কেউ ঘুমায়ে থাকতে পারে বলো। গত দু দিন থেকেই তো শুধু ঘুমাচ্ছো । সন্ধ্যা হতে চলল, উঠো না মা। ওমা, তুমিই তো বলতে, আসিফ সন্ধার সময় ঘুমাতে হয় না। জোর করে ঘুম থেকে উঠাইতা আমারে। চোখে পানি দিয়ে জাগাই রাখতা। ও মা, উঠো না মা। ওদের ভুলের জন্য তোমায় অনেক কষ্ট পেতে হইছে তাইনা মা, বলো। ডাক্তার নাকি বুঝতেই পারেনি তোমার স্ট্রোক টা কেমন হয়েছে। ওরা ডাক্তার কেমনে হয় মা?আসিফ হেসে দিলো। কিছুসময় পড়ে আবার কান্না করতে করতে এরকম হাজার কথা বলতে থাকল। আমায় ক্ষমা করে দাও মা। ওমা আমায় ক্ষমা করে দাও। একবার ফিরে এসো মা। ফিরে আসো না একবার। আমায় একবার আসিফ বলে ডাক দাও মা। তোমার ডাকটা আমায় একবার শোনার সুযোগ দাও
মা।

২ বছর পরে, ঘুমের ঘোরে জোরে চিল্লায়ে উঠল আসিফ। পাশে শুয়ে থাকা আসিফের স্ত্রী আনিকা ভয় পেয়ে লাইট টা অন করে তাড়াতাড়ি। আসিফকে পুরো ঘামতে দেখে টেবিলে রাখা পানিটা এগিয়ে দেয়। আসিফ পানিটা খেয়ে, কিছুসময় চুপ করে থাকে। আনিকা আসিফের কাধে হাত দিতেই আসিফ কেঁদে উঠে।

—মাকে মনে পড়ছে আবার? আসিফ কোন কথা বলতে পারছে না। শুধু কান্না করছে।

আনিকার নিজেরি কষ্ট হচ্ছে। মানুষটা প্রতিটা রাতেই এভাবে জেগে উঠে বাচ্চাদের মতো কান্না করতে থাকে। বিয়ের পরে আনিকার এগুলো বিরক্ত লাগলেও, কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিল, আসিফ ওর মাকে ঠিক কতটা ভালোবাসতো। এখনও ঘুমের ঘোরে আনিকা আসিফকে বলতে শুনে।

— আম্মা, আমায় একবার আসিফ বলে ডাকো। একবার আমায় তোমার কোলে মাথা রাখতে দাও।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত