উনিশ বছর বয়সে আমার বিয়ে হয়ে যায়। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার রেজাল্ট তখনো বের হয়নি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার স্বপ্ন নিয়ে কোচিংএ ভর্তি হই। এক বিকেলে কোচিংএর ক্লাস টেস্টের জন্য নিজেকে তৈরি করছিলাম। দেখি ছোটখালু হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন।
ছোটখালু সেদিন আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন বাবার কাছে।
“ছেলে মাশাআল্লাহ দেখতে শুনতে খুবই ভালো। লম্বাচওড়া, ফর্সা! ছেলে আবুদাবি থাকে, একটা ভালো কোম্পানিতে ভালো পোষ্টে আছে, মোটা অংকের বেতন পায়। প্রতিবছরই একমাসের জন্য দেশে আসে। খুব ভালো ইনকাম যে করে, ঘরবাড়ি দেখলেই বুঝা যায়”! ছোটখালু খুব উৎসাহ আর উত্তেজনা নিয়ে বাবা আর মাকে বলতে শুনি।
এসব কথা বলার সময় ছোটখালু এতটাই উত্তেজিত ছিলেন যে, চায়ের কাপে উনার বিস্কুট পরে যায়। ধপাস করে বিস্কুট পরার সময় গরম চা ছলকে খালুর সাদা পাঞ্জাবীতে পরে! খালু তখনো আবুদাবি প্রবাসী সুপাত্রের গুণকীর্তনে ব্যস্ত। সাদা পাঞ্জাবী একটা গেলে দশটা আসবে! আবুদাবি প্রবাসী পাত্র হাত ছাড়া করা যাবে না! কিছুতেই না!
“পাত্র পরিবারের বড় ছেলে। ছোট ভাইবোনগুলো এখনো পড়ালেখা করছে। বোনটা নিলুর সমবয়সী, মিলেমিশে ভাইবোনের মতোই থাকবে। মা বাবা এখনো যথেষ্ট শক্ত। তারমানে সংসারের ভারী দায়িত্ব নিলুকে এখনি নিতে হবে না! পাত্র আগামী মাসেই দেশে আসছে। ছেলের মা বাবা চাইছে এবারই বিয়েটা করিয়ে দিতে। কোন দাবিদাওয়া নাই। শুধু সেদিন এক বিয়েতে মেয়েকে আর পরিবার দেখেই তাদের খুব পছন্দ হয়েছে বলে তাদের অনেক আগ্রহ! ছেলেপক্ষ সবকিছু দিয়ে সাজিয়ে মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে। আমাদের মেয়ের সোনার মত ভাগ্য “!!
ছোটখালুর উচ্ছ্বাস ভরা কথাগুলোতে আমার সোনার মত ভাগ্যের কথা চিন্তা করে আমার মা আর বাবার দুইজোড়া চোখ সোনার মতোই চকচক করে উঠে। তাদের মেয়ের সোনার মতন ভাগ্য আর রাজকীয় ভবিষ্যৎ তারা ছোট খালুর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপে তৃপ্তি করে চুমুক দেয়াতেই দেখতে পান!
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন তখন খালুর চায়ের কাপে ডুবে থাকা বিস্কিটের সাথে নরম হয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকে!
তারপর কিছুদিনের মধ্যেই দুবাই থেকে আনা চল্লিশ ভরি ওজনের বাইশ ক্যারেট সোনার গয়না আর মিরপুরের বেনারসিপল্লির ভারী বেনারসির চকচকে জালে আটকে সারাজীবনের জন্য আমি বন্দী হয়ে পরি সংসার নামক এক জেলখানাতে।
আমার স্বামী রাহাত ভীষণ ভালবেসে আমাকে প্রেম দিয়ে বুকে টেনে নেয়! শশুর শাশুড়ি তাদের প্রথম পুত্রবধূকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেয় সংসারের উত্তরসূরি হিসেবে! দেবর আর ননদ ওদের রোজকার খুনসুটি আর সুখদুঃখ ভাগাভাগি করার জন্য আরেকজন নির্ভরযোগ্য সঙ্গী পায়! মা বাবা, আত্মীয়স্বজন সবাই আমার সোনার মত ভাগ্যের প্রশংসা করে।
আমি একজন প্রচণ্ড রকমের সুখী, ঝঞ্ঝাটবিহীন সংসারী বউ হয়ে যাই রাতারাতি।
আমার আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া হয়না। শিক্ষক হবার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। সব ভুলে আমি হয়ে যাই এক সুখী সংসারী গৃহবধূ!
যে সময়টাতে আমার বন্ধুরা ক্যাম্পাসে ডিবেট করছে, আমি সেই সময়টাতে কাঁচাবাজারে দাঁড়িয়ে সবজিওয়ালার সাথে কাঁচামরিচের দামাদামি করছি। আমার বন্ধুরা যখন দল বেঁধে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে, আমি তখন চুলার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেবরের বন্ধুদের জন্য ফুলকপির পাকোড়া ভাজছি। আমার বন্ধুরা যেই সময়ে ক্লাসরুমে বসে লেকচার শুনতে শুনতে নোট টুকে নিচ্ছে, আমি তখন বুয়াকে কাপড় কাঁচার জন্য সাবান কিনতে দোকানে পাঠাচ্ছি।
আমি সংসার নামক সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছি …মিলিয়ে যাচ্ছি …ধীরে ধীরে …আমি আমাকেই ভুলে যাচ্ছি ……!
ছোট দেবর রাতুল কাঁটাওয়ালা মাছ খায় না, ওর জন্য বড় মাছের পেটের দুই টুকরো কড়া করে ভাজতে হবে। মেঝদেবর রিপন আবার বেশি করে ঝাল দিয়ে ছোট মাছের ঝোল খেতেই বেশি পছন্দ করে। একমাত্র আহ্লাদী ননদ রিতু মাছ ছুঁয়েও দেখবে না, ওর জন্য প্রতিদিন টেবিলে মুরগী থাকা চাই।
শশুরআব্বা ডাল ছাড়া ভাত খান না। শাশুড়ি রাতে পাতলা করে বানানো চারটা লাল আটার রুটি খায়। সেই রুটি আবার বুয়া বানালে মোটা করে ফেলে, ভাজতে গেলেও পুড়ে ফেলে। রুটি ঠিক মত ফুলেও না। সুতরাং আমাকেই বানাতে এবং ছেঁকতে হবে।
“বৌমা তুমি রান্নাবান্নায় হাত না দিলে আমরা কেউ পেট ভরে ভাত খেতে পারতাম না”
শশুর আব্বা একদিন খেতে বসে আদর ভরা গলায় সবার সামনে বলে।
শাশুড়িআম্মা বলে, “আমার সাতজন্মের ভাগ্য, আমার বৌমা একটা সোনার টুকরা মেয়ে। একেবারে খাঁটি সোনা”।
দেবর ননদরা দুষ্ট হেসে বলে, “ভাবি, বন্ধুরা সেদিন তোমার পাকোড়া আর পুডিং খেয়ে জানতে চায়, তোমার কোন ছোট বোন আছে নাকি”!
সবার পাতে ধোঁয়া উঠা গরম খাবার তুলে দিতে দিতে আমার মনে বাষ্প জমে। আমার গলা ধরে আসে।
শ্বশুরআব্বাকে বলতে ইচ্ছে করে,
“বাবা, আমার হাতের তুলিটাও সুন্দর চলে”!
শাশুড়িকে বলতে ইচ্ছে করে, “মা, খাঁটি সোনা কোন কাজের না। কিছুটা খাদ না মিশালে, কারিগরের হাতে না পরলে যে এই সোনার কোন মূল্য নাই!! লকারেই নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদে জীবন যাবে খাঁটি সোনার”!
দেবর ননদের বলতে ইচ্ছে করে, “পাকোড়া আর পুডিং ছাড়াও আমি যে ছন্দ জমাতে পারি! মনের ভিতরে ছুটোছুটি করা একটা একটা শব্দ ধরে ধরে আমারো যে কাগজে কলমেও ঝড় তুলতে মন চায়!”
আমি বাষ্পে ভাসতে থাকি। অভিমানের বাষ্পে ভিজতে থাকা শুকনো খটখটে গলায় কিছুই বলতে পারিনা। বাষ্পের অভিমান একসময় মিলিয়ে যায় বাতাসে…ঝরে পরার আগেই। আমিও দিব্বি ভুলে আমার সোনার সংসারে ডুবে যাই।
প্রতিরাতে আমার স্বামী রাহাত ফোন করলে প্রেম প্রেম গলায় ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে,
“এই, একটা গান শুনবা? আমার ভীষণ প্রিয় একটা গান। খুব ইচ্ছে ছিলো আমার, কেউ একজন আমার সামনে বসে থাকবে আর আমি এই গানটি গেয়ে শুনাবো। আমার গানটা শুনতে শুনতে সে আমাকে ভালবাসতে শুরু করবে ……
আমারে মনেরো তৃষিত আকাশে
কাঁদে সে চাতক আকুলো তিয়াসে
কভু সে চকোর শুধা চোর আসে
নিশিথে স্বপনে জোছনায় “।
রাহাতকে আর বলা হয়না আমার পিয়াসী মনের কথাগুলো।
রাহাতের সাথে প্রতিরাতে ঘণ্টা খানেক ধরে আমার কথা হয়, “মায়ের ডায়বেটিস বেড়েছে আবার। বাবা মনেহয় লুকিয়ে সিগারেট খায়। সেদিনও বুয়াকে কাপড় ধুতে দেবার সময় আমি লাইটার পেয়েছি বাবার পাঞ্জাবীর পকেটে। রিতুর জন্য আমেরিকা প্রবাসী পাত্রের খোঁজ এনেছে বড় মামা। সে পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছে, মাস্টার্স না করে বিয়ের কথা ভাববেই না”।
আমি সংসারের কথা বলতে থাকি …আমার সংসারের …আমাদের সংসারের।
আমার কথার মাঝখানেই কোন একদিন হটাত রাহাত গভীর গলায় জানতে চায়,
“এবার একটু নিজের কথা বল! তুমি কেমন আছো নিলু? আমি ভীষণ মিস করি তোমাকে। আমাকে মনে করোনা তুমি” ?
আমার গলায় আবারো শুকনো খটখটে বাষ্প জমতে শুরু করে। গলার কাছটায় শক্ত ঢেলাটাকে কোনমতে অগ্রাহ্য করে আমি নিচু গলায় বলি,
“একটা নীল সাদা ছাপা ফুলের শাড়ি কিনেছি। লাল টকটকে ফুল স্লিভ ব্লাউজ বানিয়েছি। এবার যখন তুমি আসবে, বর্ষা থাকবে। আমি সেই শাড়ি পরে তোমার সাথে নৌকা ভ্রমণে যাবো। খোঁপায় কদম ফুল পরবো, হাতে জড়ানো থাকবে বেলি ফুলের মালা”।
আমার কথা শুনে রাহাত হো হো করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
“বোকা মেয়ে! আমি তোমার জন্য এবার পান্না বসানো একজোড়া চুড়ি আনবো। কুন্দনের একটা সেট সেদিন খুব পছন্দ হয়েছে। তোমাকে বেশ মানাবে। আর শোন নিলু, এবার আসলে আমরা কিন্তু একটা বেবি প্লান করব। কি! চুপ করে আছো কেন? লজ্জা পেয়েছো”?
আমি কিছুই বলতে পারিনা। আমার শব্দগুলো আমার কাছে আর ধরা দেয়না!! আমার মনের ইচ্ছেগুলো বিশাল এক সমুদ্রে ডুবে যেতে দেখি!
রাহাতকে ভীষণ বলতে ইচ্ছে করে, “আমি যে সোনা, পান্না, কুন্দনে ভাসিনাগো! আমার খোঁপাতে একটা কদম তুলে দিও তুমি। একটু বেলির সুবাস চাই উপহারে শুধু! একটা নীল সাদা তাঁতের শাড়িতে সেজে তোমার পাশে বসে নৌকা নিয়ে মাঝনদীতে ভাসতে চাই” !
কড়া করে ভাঁজা মাছের পেটি …ছোটমাছের ঝাল ঝোল … ডাল, পাকোড়া, পাতলা রুটি … সোনা, পান্না, কুন্দন ……বাচ্চা… আমার নতুন এক পরিচয় রচিত হতে থাকে দিনে দিনে…!
আমি ধীরে ধীরে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। নিজেকে বিলিয়ে দিই অন্য এক সমুদ্রে! সেই সমুদ্রের অসীম জলরাশিতে সবাই সৌন্দর্য খুঁজে, আকাশের বিশালতার সাথে মিলাতে গিয়ে কাব্য খুঁজে, লোনা জলে পা ধুয়ে আসার সময় কেউ কেউ আবার নুড়ি আর ঝিনুকও কুড়োয়! কিন্তু আমার স্বকীয়তা, আমার স্বপ্ন, আমার না বলা কিছু গল্প, সুর হারানো কিছু গান, ছন্দ থেকে ছুঁটে যাওয়া কিছু অপ্রকাশিত কবিতা সেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে সাথে মিলিয়ে যেতে কেউ দেখে না ……কেউ না!!