আনুমানিক চল্লিশ উর্দ্ধ এক মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে লাজুক লাজুক হাসি দিচ্ছে।। কিশোরি মেয়েদের হাসি যেমন হয়, তেমন করে হাসি দেবার ব্যর্থ চেস্টা।। মহিলার এই হাসি আপনাকে ধাঁধায় ফেলে দিতে বাধ্য।। মনে হবে আপনি তার চেনা মানুষ, কিংবা গোপন ভালোবাসা হয়ে উনার কাছে ধরা দিয়েছেন।।
আরো অদ্ভুত ব্যাপার খুব যত্ন করে সাজের বাহার গায়ে জড়িয়ে হাসপাতালে এই প্রথম কোন রোগীকে দেখলাম।। চোখে মোটা করে কাজল দেয়া, মুখের উপর গাঢ় মেকাপের প্রলেপ।। কপালে লাল টিপ, হাত ভর্তি চুড়ি।। পড়নে সোনালী রঙয়ের জামদানী শাড়ি, হাতাকাটা ব্লাউজ।। ঠোঁটে লাল লিপস্টিক।। চুলগুলো সদ্য আঁচড়ানো, মুখ আড়াল করে বার বার আমার দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে- এক ভয়ানক অস্বস্থিতে ফেলে দিয়েছে আমাকে।।
আমি রাহাতের অপেক্ষায় আছি।। রাহাত আমার বন্ধু, একজন সাইকোলজির ডাক্তার।। আমাকে সকালে ফোন করে হঠাৎ দ্রুত হাসপাতালে আসতে বললো।। আমি বাসা থেকে বের হয়ে হাসপাতালে ঢুকেই রাহাতকে কল দিলাম, ও বললো- আমি ২২০ নাম্বার ওয়ার্ডে আছি, তুই দুইতালায় আয়।। কিন্তু, ওয়ার্ডে এসে দেখি সে নাই।। দুইজন নার্স আছে।। তাদের জিজ্ঞেস করাতে, বললো- স্যার, ওয়াশরুমে গেলেন মাত্র, চলে আসবে আপনি বসুন।।
আমি এই ফাঁকে বসে বসে রোগীদের দেখছিলাম, বেশির ভাগ রোগীই ঘুমে।। তখন এই মহিলার সাথে আমার চোখাচোখি।।
ও শোভন তুই এসে গেছিস, আয় আমার রুমে আয়।। রাহাত ওয়ার্ডে ঢুকেই আমাকে দেখে বললো।।
রাহাত আর আমি ডাক্তার’স রুমে বসে আছি।।
রাহাত বললো- কি খাবি বল?
আমি খাবার প্রসংগে গেলাম না, উলটা বললাম- হাসপাতালে আসতে বললি কেন এত সকালে??
রাহাত একটু গম্ভীর হয়ে গেলো- অনেক দিন দেখি না তোকে তাই, আর একটা ব্যাপার নিয়ে আলাপ করতে।।
কি ব্যাপার?? আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম!!
রাহাত বললো- একটা রোগীর ব্যাপারে তোর সাথে শেয়ার করবো।। তবে, তোকেই কেন বলছি সেসব ব্যাখ্যা পড়ে দিবো।। তুই কি শুনবি??
আমি শুধু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম।।
রাহাত ফাইল হাতড়ে একটা কাগজ বের করে আমার সামনে দিলো।।
ডাক্তারি ভঙ্গিমায় রোগীর বিবরণ লেখা।।
রোগীর নাম- নাজনীন আক্তার।।
পিতা- আলাউদ্দিন খালাসি।।
মাতা- মৃত আমেনা বানু।।
ঠিকানা- ৩২১/১ কেল্লার মোড়, লালবাগ, ঢাকা।।
রোগীর ধরণ- ইরাটোমেনিয়া সিজোফ্রিয়ান রোগে আক্রান্ত।।
আরো হাবিজাবি লেখা আছে।। কিন্তু সেসব পড়তে মন চাচ্ছে না।। আমি এইগুলোতে চোখ বুলিয়ে রাহাতের দিকে তাকিয়ে বললাম-
রোগীর কাহিনী কি, বল তো দোস্ত-
রাহাত একটু কেশে নিলো- ২২০ নং ওয়ার্ডে একটা মহিলাকে দেখেছিস, সাজ গোজ করে বসে আছে।।
হু-
অই মহিলার বিবরণ এটা।। উনি এই ইরাটোমেনিয়া সিজোফ্রিয়ান রোগে আক্রান্ত।। এটা রোগটা মানসিক ক্যান্সারের মত।। এই রোগের রোগীগুলো ভয়াবহ মানসিক চাপে থাকে, এরা অদ্ভুত এক কল্পনা জগতে বাস করে।। বাস্তবতার বাইরে একদম ভিন্ন এক জগৎ, এরা কিন্তু আত্নহত্যাও করতে পারে না।। এদের এত মানসিক কস্ট যেটা তোর আমার কল্পনার বাইরে- তুই চিন্তাও করতে পারবি না।।
আমি বললাম- হুম তো!!
রাহাত বলে চললো- উনি আমাদের হাসপাতালে প্রায় ১০ বছর ধরে ভর্তি।। উনার এই ১০ বছরে বিন্দু মাত্র উন্নতি হয় নি, বরং বলা যায় অবনতি হয়েছে।। উনার সব খরচ এখন হাসপাতাল ফাউন্ডেশন বহন করে।। মূলত এই রোগীর জন্যে আমাদের আর কোন চিকিৎসা নেই।। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটা এক্সপেরিমেন্ট চালাতে চাচ্ছি, তার জন্যে তুই আমার বেস্ট চয়েজ।।
আমি একটু তব্দা খেলাম, পাগলের ডাক্তার বলে কি!! শেষে কিনা আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট।।
আমি বললাম- ভাই, বিস্তারিত বল তো।। কথার মাঝে আর থামিস না।।
রাহাত লম্বা দম নিয়ে শুরু করলো-
আমাদের বয়স কালে অনেক ধরণের সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার হতে পারে।। কিন্তু, সবচেয়ে কমন হচ্ছে-
ইরাটোমেনিয়া প্রাইমারি ডিসঅর্ডার।। সাধারণত দুই ভাবে এটা শুরু হতে পারে-
ধর তোকে একটা মেয়ে পছন্দ করে, তুই করিস না।। করিস না মানে একদম ইগনোর করিস, পাত্তা দিস না।। তবু মেয়েটা তোকে ভয়ানক পছন্দ করে।। এখন অই মেয়েকে তুই যত ইগনোর করবি তার ভালোবাসা তত বাড়বে, পাগলের মত তোকে চাইবে।। চূড়ান্ত মানসিক রোগীও হয়ে যেতে পারে, যদি তাকে কেউ এই ট্রমা থেকে বের করে না আনে।। আবার মজার ব্যাপার, তুই যদি তাকে পাত্তা দিস বা তার কথা মেনে নিস- তবে তোর প্রতি তার ভালোলাগা কমে যাবে।। তুই যত পাত্তা দিবি, সে তত মুডি হবে।। একসময় তোকে তার ভালো লাগবে না, সে তোকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইবে।। তুই হয়তো তখন বাধ্য হয়ে সরে যাবি, আবার সে তোর প্রতি আসক্ত হবে।। এটা একটা সার্কেলের মত ঘুরপাক খাবে।। ইভেন তুই অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেললেও রক্ষা নাই।। মেয়েটা ভেবেই নিবে তুই তার সাথে প্রতারণা করেছিস।। এই যন্ত্রনায় সে রাতদিন জ্বলবে, আর সবাইকে বলে বেড়াবে।।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনে যাচ্ছিলাম।। আমি লেখক মানুষ, এইসব সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার আমার মাথায় ঢুকে না।। তারপর রাহাত যে কথা শুনালো- মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে।। পেটে ক্ষুধা অনুভব হচ্ছে, সকালে খাই নি কিছুই।।
আমি কথা থামিয়ে দিয়ে বললাম- দোস্ত, এমন অদ্ভুত মানসিক সমস্যা আছে?
রাহাত ঝটপট বললো- অনেক আছে, আরেকটা ধরণ শুন।।
এইটাও অইটার কাছাকাছি- কিন্তু শুরুর প্যাটার্ন খানিকটা ভিন্ন।। এখানে ধর তুই মেয়েটার বন্ধু, খুব কাছের না হলেও স্বাভাবিক বন্ধু।। কিন্তু, মেয়েটা মনে মনে ভেবে নিবে তুই তাকে পছন্দ করিস।। তুই বন্ধু সুলভ যাই করবি, মেয়েটা সেগুলোকেই তোর অব্যক্ত ভালোবাসা ভেবে বসে থাকবে।। কিন্তু, নিজে কোনদিন প্রপোজ করবে না।। তোর কাছ থেকে প্রপোজাল আশা করবে।। ধর, তুই প্রপোজাল দিলি না- অন্য কারো সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ালি।। মেয়েটা আস্তে আস্তে ভয়ানক হয়ে উঠবে- তোর বা তোর প্রেমিকার ক্ষতিও করতে পারে, তুই হয়তো টেরি পাবি না।। কিন্তু, সবচেয়ে বাজে ব্যাপারটা হলো- তুই যদি ওকে প্রপোজ করতি- সে তোকে সোজা না করে দিতো।। তোকে ভর্ষনা করতো, তুই বন্ধু হয়ে এটা কি করলি।। কিভাবে তাকে প্রপোজ করলি, ছি ছি করতো রাত দিন।। তোর থেকে দূরে সরে যেতো, তুই যতবার তাকে রাজী করাতে যাবি সে তত তোকে অবজ্ঞা করবে।। আবার, যদি মেয়েটার ছি ছি শুনে তুই দূরে সরে থাকিস- সে তোকে আবার ভালোবাসবে।। মনে মনে ভাববে, যদি ভালোইবাসে আমার কাছে কেন আবার ফিরে আসে না।। এটাও একটা চক্রবূহ।।
বুঝলি কিছু- শোভন।।
আমি ঝিম মেরে বসে আছি, সত্যিই আমার মাথা ঘুরাচ্ছে।। কেনো যেনো বমি আসছে, গ্যাস্ট্রিকের আক্রমণ কিনা কে জানে।। শুধু বললাম- আচ্ছা, দুইটা ব্যাপারেই তুই মেয়েদের দিয়েই উদাহরণ দিলি কেনো?
রাহাতকে খুশি দেখাচ্ছে, সে বুঝে গেছে আমি তার কথার আগ্রহী শ্রোতা।।
শুন শোভন, আমাদের দেহে ডুপামিন হরমোন এই রকম ডিসঅর্ডারের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে।। আর এই ডুপামিন হরমোন ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের কয়েকগুণ বেশি থাকে।। প্রতি ১০০ মেয়ের অনুপাতে ১ টা ছেলে এই সমস্যায় পরে, তাই আর কি।।
আমি সত্যিই এত হিসাব মিলাতে অক্ষম।। আমার শরীর আরো খারাপ হচ্ছে, বুক ধরফর করা শুরু হয়েছে।। রাহাতকে বললাম তোদের ক্যান্টিনে চল, আমাকে দ্রুত কিছু খেতে হবে।।
………..
বাসায় বসে আছি, মাথার মধ্যে ভয়ানক চাপ।। টিপ টিপ ব্যাথা করছে।। রাত গভীর, একটা ডিসপ্রিন গুলিয়ে খেয়েও রক্ষা হচ্ছে না।।
রাহাতের কথাগুলো আবার ভাবতে বসলাম।। কি বিশ্রী এক অনুরোধ করে বসে আছে রাহাত।। আমাকে নাকি ওর অই রোগীর সাথে সময় দিতে হবে, প্রেম প্রেম ভাব বিনিময় করতে হবে।। আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার ছাত্র, আমি নাকি যতটা সহজে এই অভিনয়ের কাজ পারবো আর কেউ নাকি তা পারবে না।। তাই বলে, বাস্তবে এমন একজন যে কিনা প্রায় মায়ের বয়সী মহিলা, তার সাথে প্রেমের অভিনয়- ভাবা যায় না।। আমার রাজী না হয়ে উপায়ও নাই- রাহাতের সাথে বন্ধুত্বের বাইরেও অন্যরকম একটা সম্পর্ক আছে।।
পরদিন সকালে আবার হাসপাতালে গেলাম।। চাকরী বাকরি কিছু করি না, লেখালেখির কারণে সব বাদ দিয়ে বাপের ঘাড়ে চেপে ভালোই চলছিলো।। মাঝে রাহাতের এই উৎকো এক্সপেরিমেন্টের ফাঁদে পা দিতে হলো।। ভাবলাম, একটা জিনিস ভালোই হবে- অন্তত কিছু অভিজ্ঞতা হবে।। যত অভিজ্ঞতা লিখে তত মজা।। তবে, আমার প্রেমিকাকে কিছুতেই আগে থেকে জানানো যাবে না, সে রাগ করতে পারে বা সোজা এই কাজ না করে দিবে।। অথচ, এখান থেকে আমার অনেক কিছু শেখা যেতে পারে।।
আমি নাজনীনের পাশে বসে আছি।। ভয়ানক সাজ, গতকালের সাজের সাথে আজকের সাজের পার্থক্য পেলাম একটা।। গায়ের শাড়িটা পাতলা শিপন কাপড়ের।। এই বয়সের মহিলাদের সাজলে এত ভালো লাগে না, আচ্ছা ভালো কথা- এই সাত সকালে উনাকে সাজিয়ে দেয় কে?
২২০ নাম্বার ওয়ার্ডে মোট ১০ জন রোগী।। সবাই ঘুমে আচ্ছন্ন, শুধু নাজনীন আমি আর খানিক দূরে রাহাত চেয়ার পেতে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।।
আমি নাজনীনকে বললাম- নাজু কেমন আছো?
লজ্জার আভা গালে মেখে জবাব দিলো-
ভালো না, তুমি কেমন আছো?
কি সাবলীল শুদ্ধ কন্ঠ।। অথচ আমি ভেবেছিলাম, পুরান ঢাকায় যেহেতু বাসা- হয়তো কথায় ঢাকাইয়া টান থাকবে।।
আমি অনিচ্ছাকৃত ভাবে অভিনয়ের হাসি হেসে বললাম- ভালো আছি।। তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে।।
নাজনীন আরো লজ্জা পেয়ে আমার বুকে আলতো ধাক্কা মেরে বললো- ধুর!! তোমার মুখে কিছুই আটকায় না ঝিনুক।।
নাজনীনের হাত ভর্তি কাঁচের চুড়িগুলো এলেমেলো ঝংকার দিলো।।
আমি জানি, আমি আজ থেকে নাজনীনের ঝিনুক।।
আমি কথার ফাঁকে ফাঁকে রাহাতের দিকে তাকাচ্ছি।। ডাক্তার সাহেব এক দৃস্টিতে আমাদের পর্যবেক্ষণ করছে।।
নাজনীন আমাকে আবার বললো- তোমাকে বলেছিলাম না, অই ছেলেটা আমাকে পছন্দ করে।। দেখো কেমন বেহায়ায় মত আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে।। তুমি ওকে বকা দিয়ে আসো, যাও এখুনি।।
রাহাত সব শুনতে পেয়ে ওয়ার্ড থেকে উঠে বের হয়ে গেলো।। নয়টা ঘুমন্ত মানসিক রোগী আমাকে ঘিরে আছে, আর হাত ছোঁয়া দূরত্বে জাগ্রত এক প্রেমিকা।। আমি ভয় পাচ্ছি।। উঠে সোজা রাহাতের বেরিয়ে যাওয়া পথের অনুসারী হলাম।।
দৌড়ে রাহাতের রুমে গেলাম।
রাহাত বললো- এভাবেই চলুক শোভন।।
………..
পরদিন আমি হাসপাতালে একটা কেবিনে বসে আছি।। কেবিনে আমি আর শুধু নাজনীন বসা।। রাহাত কেবিনের বাইরে চেয়ার পেতে বসে আছে।। আমার মেজাজ অত্যাধিক খারাপ, নাজনীনকে কেনো ওয়ার্ড থেকে নিয়ে কেবিনে এনে আমার সাথে বসিয়ে দিতে হবে।।
একটাবার আমার অস্বস্তির কথা ভাবলো না রাহাত।।
নাজনীন আজ আরও সাজ সেজেছে, গাঢ় লিপিস্টিকে ঠোঁট ভরিয়ে ফেলেছে।। নীল শাড়ি পড়া-
যথারীতি গৎবাঁধা কিছু আলাপ চারিতা শেষে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলাম।।
রাহাত সব জানতে চাইলো, আমি আলাপের অংশ বিশেষ বললাম।।
রাহাতকে খুশি মনে হলো, সে নাজনীনকে কেবিনেই রাখবে।। তাহলে আমাদের প্রণয় জমবে ভালো।।
আমার মনের মধ্যে হাজারও প্রশ্ন।। সেগুলোর উত্তর জানা আবশ্যক, তবে রাহাত বলেছে সব উত্তর পরে দিবে।। সবথেকে বেশি অবাক লাগে, আমাকে ঝিনুক ডাকে কেনো নাজনীন?? নাজনীনের অতীত ঘটনা জানতে হবে, রাহাত আমার একমাত্র ভরসা।।
……..
আজ নবম তম দিন।। এর মধ্যে প্রতিদিন সকালে আমি নাজনীনের সাথে দেখা করেছি।। আমি বিরক্ত হয়ে গেছি, প্রতিদিন কেবিনে বসে ১৫-২০ মিনিট আজাইরা প্যাঁচাল পারা আর তারপর রাহাতকে রিপোর্ট করা- ধ্যাৎ আর সহ্য হচ্ছে না।। কিন্তু একটা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আশায় আমি রাহাতকে না করতে পারি না।।
আজ নাজনীন বললো- তোমার বুকটা একটু দেখাবে?
আমি খুব অভিনয়ে পারদর্শী হয়ে গেছি, আমি বললাম- জামা খুলে দেখাবো।।
নাজনীন মুচকি হেসে বললো- না, ছুড়ি দিয়ে কেটে দেখাও না, ওখানে কে কে আছে?
আমি একটু ভয় পেলাম বটে, তবুও বললাম- কে কে আবার, তুমি একাই আছো।।
নাজনীন রাগ দেখালো, চট করে বালিশের তলা থেকে চকচকে একটা চাকু বের করলো।। আমি মূহূর্তেই ভয়ে পিছিয়ে গেলাম।।
আমার দিকে তাকিয়ে নাজনীন চাকু বাড়িয়ে দিয়ে বললো- ঝিনুক বুকটা কেটে দেখা না সোনা, ওখানে কি শুধু আমিই আছি।। একটাবার দেখা না সোনা।।
আমার দম বন্ধ হয়ে আছে, হাত পা সমানে কাঁপছে।। কেবিন থেকে দৌড়ে বের হয়ে আসলাম।। বাইরে দেখি রাহাত চেয়ারে বসা, ওকে ফেলেই সোজা হাসপাতালের নিচে চলে এলাম।।
রাহাত পিছন পিছন এলো।। আমি হাঁপাচ্ছি।।
রাহাত খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো- কাল থেকে তোকে আর আসতে হবে না, এই রোগী আর ঠিক হবে না রে।।
……..
পরদিন আমাকে হাসপাতালে দেখে রাহাত অবাক।। বললো- আবার এলি যে।।
আমি বললাম- নাজনীনের জন্যে মায়া লাগছে কাল সারারাত।। এক ফোঁটা ঘুমাতে পারি নি।। আমি এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে যেতে চাই।। যত কস্টই হোক, উনাকে সুস্থ্য করতে চাই।।
রাহাত পুলকিত হাসি দিলো, কিন্তু সে হাসিতে মিশে ছিলো, ব্যাপারটা এমন হবে সে যেনো জানতো।।
রাহাতের সাথে হাসপাতালের ক্যান্টিনে বসে আছি।। রোজ সকালে ইদানিং এখানেই নাস্তা করি, আমার অবাক লাগে এটা ভেবে- রাহাত এই হাসপাতালে জয়েন করেছে মাত্র ২ মাস।। এরমধ্যে সব বাদ দিয়ে এই রোগীর পিছনে এত সময় কেন দিচ্ছে।। নাকি ও নতুন কোন মানসিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিস্কার করতে চাচ্ছে।।
রাহাত, আমাকে একটু উনার ঘটনা বল তো।।
রাহাত খেতে খেতে বললো- দেখ, নাজনীন ইডেন কলেজে পড়াকালীন একজন শিক্ষককে পছন্দ করতো।। প্রচন্ড গোপন পছন্দ করতো, তা ধর ২০ বছর আগের কথা।। অই শিক্ষক ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে, নাজনীনকে ইগনোর করা শুরু করে।। নাজনীন এই ইগনোর থেকে আস্তে আস্তে ইরোটোমেনিয়া প্রাথমিক রোগী হতে থাকে।। স্যারের ইগনোরের সাথে সাথে নাজনীনের ভালোবাসা বাড়তে থাকে, একসময় স্যার এসবে পাত্তা না দিয়ে বিয়ে করে ফেলে।। নাজনীন স্যারের নামে যৌন হয়রানীর অভিযোগ করে, আগে ব্যাপারটা এত সিরিয়াস ভাবে নিতো না কেউ।। কিন্তু, লজ্জায় অই স্যার চাকরী ছেড়ে দেশের বাইরে চলে যায়।। নাজনীন পড়াশোনা বাদ দিয়ে অনুতপ্ততায় ভুগতে থাকে- ধীরে ধীরে আজকের এই পর্যায়ে চলে আসে।। মাঝে আরো কিছু ব্যাপার ঘটে যায়, আস্তে আস্তে জানাবো তোকে।।
আর একটা তথ্য দেই, এই নাজনীন কিন্তু রাতে সম্পূর্ণ অন্য রুপে থাকে।। তখন সে পুরুষ মানুষ ভয় পায় কিংবা ঘেন্না করে।। সকালে আবার এই রুপ।। উনাকে এক নার্স খুব ভোরে সাজিয়ে দেয়, এই সাজানোর ব্যাপারটাও চলছে কয়েক বছর ধরে।। বিকেল পর্যন্ত এভাবেই থাকে, পরে আস্তে আস্তে উনি কাপড় খুলে নগ্ন হতে চায়।। তখন, রাতে উনাকে আমরা অই কেবিনে নিয়ে আসি- উনি সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ঘুমায়।। আবার সকালে কেবিন থেকে নার্স তাকে সাজিয়ে ওয়ার্ডে দিয়ে আসতো।। এখন তো, রাত দিন কেবিনেই থাকে।। যে কোন পুরুষ দেখলেই উনি মনে করেন, লোকটা তাকে পছন্দ করে।।
আবার আমার গা গুলাচ্ছে।। সামনের খাবারগুলো বিস্বাদ মনে হচ্ছে।। আমি নাজনীনের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি নাকি, করুণা।।
…….
রাতে আমি নাজনীনের কথা ভেবে অস্থির হয়ে গেছি, মনে হচ্ছে নাজনীনের গায়ে কোন কাপড় নেই- আমার মাথায় খুব সুক্ষ্ণ ভাবে এটা ঢুকে গেছে।। আস্তে আস্তে নিজে সব কাপড় খসিয়ে ফেললাম, রুমের দরজা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।।
সকালে, যথারীতি আবার হাসপাতালে গেলাম।।
আমার মধ্যে বিশাল এক পরিবর্তন, আমি দামী পোষাক পড়ে- বাবু সাহেব সেজে এসেছি।। রাহাত আমার মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ্য করলো।। আমাকে বললো- তুই কি নাজনীনের প্রেমে পড়ে গেছিস।।
আমি মাথা নিচু করে বললাম- হ্যাঁ।।
একটা কাজ করবি, আজ রাতে নাজনীনের সাথে থাকবি কেবিনে।। আমি জানতে চাই সে রাতে তোকে এলাউ করে কিনা।।
আমি কেঁপে উঠলাম ভয়ে।। আমি রাহাতের এই প্রস্তাবে ঘামছি।।
আমার সাহসে কুলাচ্ছে না।। রাহাতকে না করে দিলাম।।
নাজনীনের সাথে দেখা করে, আজ অনেকক্ষণ সময় কাটালাম।।
রাহাতকে রিপোর্ট করে ১২ টার দিকে বাসার পথ ধরলাম।।
রাতে, দরজা বন্ধ করে কান্না করছি।। এখন কারণ ছাড়াই আমার কান্না পায় অথবা কারণ ছাড়াই আনন্দ লাগে।। আমার প্রেমিকাকে আর ভালো লাগে না, সারাদিন নাজনীনের চিন্তায় বিভোড়।। মাথার ভিতর থেকে কিছুতেই রাহাতের রাত থাকার প্রস্তাবের কথা ঝেরে ফেলতে পারছি না।। নাজনীনের গায়ে কাপড় নেই চিন্তা করে পুলকিত হচ্ছি।। নিজের গায়ের সব কাপড় খুলে বিছানায় শুয়ে, সিদ্ধান্ত নিলাম।। আগামীকাল রাতে আমি নাজনীনের সাথেই থাকবো।।
………
সকালে রাহাত আমাকে দেখেই বললো, শোভন- খারাপ খবর।।
আমি বললাম- কি?
নাজনীন বেঁচে নেই, গত রাতে মারা গেছে।। খুব ভোরে আত্নীয় স্বজন এসে তার লাশ নিয়ে গেছে।। তোকে ইচ্ছে করেই কল দেই নি, তুই এমনিতেই একটা মানসিক রোগী।।
রাহাতের কথা কানে অদ্ভুত শোনালো, সত্যি কি আমি মানসিক রোগী।। আমার তো নাজনীনকে দেখতে মন চাচ্ছে, আমার ভীষণ দেখতে মন চাচ্ছে।। আমি দৌড়ে গেলাম, নাজনীনের কেবিনে।।
কেবিনের দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া, আমি বললাম খুলে দে- আমি নাজনীনকে দেখবো।।
রাহাত আমার সাথে দৌড়ে এসেছে, আমাকে বললো- শান্ত হ শোভন, এই রুমে নাজনীন নেই।।
আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম।। তালা খুলে দে হারামজাদা।।
আমার চিৎকারে হাসপাতালের আশেপাশের লোকজন ডাক্তার নার্স আয়ারা ছুটে আসলো।। রাহাত কাকে জানি নির্দেশ করলো তালা খুলে দিতে।।
দরজা খুলার সাথে সাথেই আমি ভিতরে ঢুকে গেলাম।। নাজনীন বিছানায় সেজে গুঁজে বসে আছে, অথচ রাহাত আমাকে মিথ্যা বলেছিলো।।
আমি নাজনীনের পাশে গিয়ে বসলাম।
কেবিনে রাহাত সহ অনেকেই ঢুকে আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।। রাহাত বললো- তুই কি নাজনীনকে দেখতেছিস নাকি।। আমি দাঁত মুখ খিচিয়ে বললাম- কেন হারামজাদা ডাক্তার, তুই দেখিস না।।
রাহাত শুধু বললো- ডিলিউশন, ডিলিউশন বলে রুম থেকে সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।।
……….
আজ কয়েকমাস কেটে গেছে।। আমি হাসপাতালের এই কেবিনেই দিনরাত যাপন করি।। নাজনীনের সাথে বেশ সুখেই আছি, এই কয়মাসে একবারও আমরা কেবিন থেকে বের হই নি।। কেবিনের সাথে লাগোয়া বাথরুম আর কেবিনেই আয়ারা এসে খাবার দিয়ে যায়।।
নাজনীন কখনো কিছু খায় না, ও নাকি না খেয়েই বেঁচে থাকতে পারে।। কেবিনের মধ্যে একটা আয়নায় মাঝে মাঝে নিজেকে দেখি চুল দাঁড়ি সব বড় হয়ে অদ্ভুত দেখায় নিজেকে।।
……..
জয়িতা এসেছে আমাকে দেখতে।। এর মধ্যে আমার বাবা মা এসেছিলো কয়েকবার, আমি কেবিনে এদের প্রবেশ দেখলেই চিৎকার চেঁচামেচি করতাম।। এরা এখন আর আসে না, জয়িতা ছিলো আমার ভালোবাসার মানুষ।।
ওকে দেখে আমি চমকে উঠলাম।।
জয়িতা কেবিনে এসে বললো- কেমন আছো লেখক?
আমি মাথা নিচু করে বললাম- নাজনীন, দেখো কে এসেছে।।
জয়িতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, হয়তো জানে আমি পাগল।।
জয়িতা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো- নাজনীন আপনি কেমন আছেন?
নাজনীন কিছু বলে না, সে রাগ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।।
আমি নাজনীনের রাগ কমাতে বললাম- নাজনীন, আমি এখন শুধু তোমাকে ভালোবাসি জয়িতাকে না।। সে আমার অতীত, তুমি আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ।।
জয়িতা আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো- নাজনীন আমি শোভনকে নিয়ে একটু বাইরে যাই?
নাজনীন চুপ করে আছে!!
অনেক দিন পর কেবিনের বাইরে বেরিয়ে সব অচেনা লাগছে।। আমি আর জয়িতা হাসপাতালের ফ্লোর ধরে হেঁটে চলছি- এমন সময় দেখলাম, নাজনীন ডাক্তারের এপ্রোন পরে আমাকে দেখে পালিয়ে গেলো।। আমি বললাম, জয়িতা অই তো নাজনীন।। ও রাগ করে অইদিকে কই গেলো??
জয়িতা সে দিকে তাকিয়ে বললো- উনি তো ডাক্তার শিরিন।। শোভন, তোমার নাজনীন কি দেখতে এমন?
আমি বললাম- কি সব বলো, অইটাই নাজনীন, ওইদিকে চলো তো দেখি কই গেলো!!
আমি আর জয়িতা, ডাক্তার’স রুমের দিকে গেলাম।। রুমে ঢুকার আগে জয়িতা আমার হাত টেনে ধরলো- আমাকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে বললো।। রুমের পর্দা টেনে দেয়া, দরজা খানিকটা চাপানো।।
রাহাতের উত্তেজিত কন্ঠ শোনা যাচ্ছে ভিতর থেকে-
-কি লাভ হলো ম্যাডাম এত কস্ট করে, কি লাভ হলো বলেন?
ডা: শিরিন বলছে- তোমার বোনকে এখানে আসতে দিলে কেনো?
– আরে, আমি আসতে দেই নাই।। আমি তো জানিই না সে আসবে।। তাকে বলেছি শোভন এখন বদ্ধ উম্মাদ।। তাকে তালা দিয়ে রুমে আটকে রাখি।। জয়িকে এই থার্ড ক্লাস লেখক ফেককের চক্কর থেকে বাঁচাতেই তো এত এত নাটক করা লাগলো।। পুরা হসপিটাল ম্যানেজ করে, এই কাজ করলাম আর এখন জয়ি এখানে।। ড্যাম ইট-
ডা: শিরিনের কন্ঠ- তাহলে জয়িতা কিভাবে এখানে এলো, আবার বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে অই ছেলেকে নিয়ে।। আমি তো ভয়ে আছি, আমাকে দেখে ফেললো কিনা??
– দেখলে সমস্যা নাই, সে মারাত্নক ডিলিউশন ঘোরে আছে।। সে আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে না।। জয়িতা এসেছে, দেখুক তারপর চলে যাবে।। চোরের সাথেও ঘর করা যায় কিন্তু মানসিক রোগীর সাথে না।। আচ্ছা ওরা এখন কোথায়-
ডা: শিরিন বললো- বাইরেই তো দেখলাম।। একটু পর তুমি বের হয়ে জয়িতাকে চলে যেতে বলো আর অই ছেলেকে দ্রুত রুমে ঢুকিয়ে দাও।।
জয়িতা প্রায় আমাকে টেনে নিয়ে কেবিনে চলে আসলো।। আমি কিছুই বুঝলাম না, কেবিনে এসে দেখি নাজনীন নেই।। আমাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে জয়িতা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে হাঁফাচ্ছে।।
খানিক বাদে রাহাত এসে বললো, এই জয়ি দেখলি তো পাগলটাকে, যা বোন এইবার বাসায় চলে যা।।
জয়িতা গগণ বিদারি চিৎকার দিয়ে বললো- তুই যা এই রুম থেকে হারামজাদা ডাক্তার, আমি জয়িতা না, আমি নাজনীন।। তুই নাজনীন আর শোভনকে কোনদিন আলাদা করতে পারবি না।। আমরা এই রুমেই আজীবন কাটাবো-