বড্ড উদাসীন

বড্ড উদাসীন

মিহিনের একটা বাজে অভ্যেস আছে। পড়ার মতো কিছু একটা পেলেই পড়তে শুরু করে দেয়। যেকোনো জায়গায়, যেকোনো কিছু। ব্যাপারটা যতটা বাজে ঠিক ততটাই ভালো৷ ছোট বেলা থেকেই তার এই অভ্যেস। প্রচণ্ড গম্ভীর একটা মেয়ে৷ নিজের চারপাশটা সব সময় গম্ভির করে রাখে সে৷ সবার সাথে কথা বলে না৷ বললেও কম। দশ কথায় তার জবাব হবে একটা৷ ক্লাসের অনেক মেয়েই এই বোরিং টাইপ মেয়েটাকে দেখতে পারে না৷ কেমন জানি৷ বড্ড উদাসীন। সে নিজেও ঠিক নিজেকে বুঝতে পারে না। কিন্তু হঠাৎ করেই এই অদ্ভুত মেয়েটার কিছু পরিবর্তন দেখা দেয়। পরিবর্তনটা শুরু হয়ে সেদিনের ট্রেন করে বাসায় ফেরার পর থেকে৷ ওকে ভার্সিটি থেকে ফিরতে হলে ট্রেনে করেই ফিরতে হয়ে৷ অবশ্য অন্য আরেকটা রাস্তাও আছে৷ কিন্তু সে রাস্তায় বেশি যায় না ও৷ ট্রেনে করেই ফিরে। এক টানে চলে আসে। সময় বেশি লাগে না৷ এছাড়া অন্য কোনো কারণ আছে কী না জানা নেই। মিহিন তখন নিজের সিটে চুপচাপ বসে ছিল। সেদিন খানিকটা ভীড়ও ছিল বটে৷ ঠিক তখনই ও ছেলেটাকে দেখল। ফর্সা করে ছেলেটা৷ লম্বা,সরু চোখ, গালে খোচাখোচা দাঁড়ি৷ বেশ স্মার্ট। কিন্তু তার চুলের স্টাইল চেহারার সাথে একদমই যায় না৷ ছেলেটা কেমন জানি। অন্য রকম। মিহিনদের ক্লাসে পড়ে৷ নাম তাসফি। শাকের আহমেদ তাসফি। নাম মনে করেই মিহিন খানিকটা হেসে ফেলল। কেন হাসল তা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না৷ সে এটাও বুঝতে পারল না যে ওই ছেলের নাম জানে কীভাবে সে? তার সাথে তো ওর কথাও হয়নি৷ এমনকি ক্লাসের প্রায় অনেক ছেলে মেয়ের নামই জানে না ও। তাহলে এই ছেলেরটা জানল কীভাবে? ছেলেটা প্রায় মিহিনের মতোই৷ কারো সাথেই সে কথা বলে না৷ এত গম্ভীর যা বলার মতো না৷ মিহিন সরাসরি দেখল এবার ছেলেটাকে৷ ঠিক তখনই খানিকটা ধাক্কা লেগে ছেলেটার হাতে থেকে একটা ডায়েরি ট্রেনে মেঝেতে পড়ে যায়৷ একটি কালো রঙের ডায়েরি। ডায়েরিটা হাত থেকে পড়ে গেলেও তাসফি বুঝতে পারেনি যে সেটা পড়ে গিয়েছে। ও কোথাও ডুবে ছিল যেন৷ কোনো কিছু নিয়ে ভাবছিল ভীষণ ভাবে। গভীর ভাবনায় লিপ্ত ছিল৷ মিহিন সে সুযোগে ডায়েরিটা নিয়ে নিল। জানে এভাবে কারো ডায়েরি নিয়ে নেয়া ঠিক না। তবুও ও কেন জানি নিয়ে নিল। সম্ভবত ছেলেটার প্রতি খানিকটা কৌতূহল ছিল তার৷ মিহিন ওখানে বসেই ডায়েরিরটা খুলল। প্রথম পেজ উল্টাইতেই একটি নাম দেখল সে। মেয়ের নাম। মীরা। সাথে তাসফি নাম লেখা৷ মিহিনের বুকের ভেতরটা হঠাৎই মুছড়ে উঠল। কেন উঠল তার সঠিক ব্যাক্ষা সে খুঁজে পেল না। আচমকা তার কেমন জানি লাগতে থাকল৷ খানিকটা অস্বস্তি গ্রাস করে নিল তাকে। মিহিন ডায়েরিটা দ্রুত বন্ধ করে ফেলল৷ তারপর সেটিকে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে থাকল৷ কোনো এক বিচিত্র কারণে হঠাৎই তার কান্না করতে ইচ্ছে হলো। বুকের ভেতরটা কেমন জানি করছে৷ মিহিন বহু কষ্টে বসে থাকল। ওর দম আঁটকে আসছিল যেন৷ ও তখনও বুঝতে পারেনি আসলে ওর হয়েছেটা কী? কেন এমন লাগছে? এত অস্থিরও বা লাগছে কেন? ট্রেন থেকে নেমে রিক্সা নিল। বাসায় এসেই নিজের বিছানার উপর লাফিয়ে পড়ল। তারপর হঠাৎই বালশির উপর মুখ গুঁজে কান্না শুরু করে দিল ও। কান্না করতে করতে তার কখন ঘুম চলে এল সেটা সে টেরই পেল না৷ মেয়েরা আসলেই বড় অদ্ভুত জাতি। এদের বুঝা খুবই মুশকিল। এরা রহস্যময়ি হয়। অনেক কথা গোপনে লুকিয়ে রেখে কাঁদতে জানে। তবুও মুখ ফুটে তা স্বীকার করে না৷ মিহিনের বেলায়ও সম্ভবত তাই ঘটেছে। তাসফিকে নিয়ে কি তার মাঝে কোনো অচিন অনুভূতি আছে কি না সেটা কারো জানা নেই৷ একমাত্র যার অনুভূতি সেইই জানে। মিহিনের ঘুম ভাঙ্গল সন্ধ্যারও পরে। ভাঙ্গত না যদি না ওর আম্মু এসে ওকে না জাগাতেন৷ মিহিন ঘুম থেকে উঠে খানিকটা ভাবতে থাকল। সে হঠাৎই এমন বিচিত্র ব্যবহার করছে কেন সেটা বুঝতে পারছে না সে৷ কী হয়েছে তার? শরীর স্বাস্থ্য তো ঠিকাছে৷ তাহলে এমন লাগছে কেন ওর? কান্নাও বা করছে কেন? মিহিন ভাবতে পারছে না আর। তার মাথা ভারী হয়ে আসছে। কেমন জানি লাগছে। ট্রেনে ডায়েরির ভেতর মীরা নামটা দেখার পর থেকেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সেই অনুভূতিটা এখনও পিছু ছাড়েনি। আঠার মতো লেগে আছে। মিহিন কি করবে বুঝতে পারল না। ফ্রেশ হয়ে নিল। ওর আম্মু এসে নাস্তা করতে বলে গেলেন৷ ও নাস্তা করতে গেল না। নিজের ঘরের ভেতরই বসে থাকল। একটু নড়লও না৷ ওর আম্মু আবার এসে নাস্তার জন্যে বলে গেলেন। খানিকটা বকেও গেলেন। মিহিন তা গায়ে নিল না। ও যেন শুনতেও পাচ্ছে না৷ হঠাৎই মিহিন উঠে দাঁড়াল। কিচেনে গিয়ে নিজের জন্যে এক কাপ কফি বানিয়ে নিল৷

মিহিন বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিল৷ জানালার পর্দা টেনে দিয়ে টেবিলে বসল। পাশে কফির মগ রাখা৷ মগ থেকে ধোঁয়া উড়ছে৷ মিহিনের সামনে ডায়েরিটা রাখা৷ পড়বে কি পড়বে না, সেই দ্বীধায় আছে ও। তারপর হঠাৎ করে কি মনে করে ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা উল্টালো। উল্টাতেই মীরা রহমান এবং শাকের আহমেদ তাসফির নামটা দেখল। বড় বড় অক্ষরে খানিকটা স্টাইলিস করে লেখা৷ মিহিনের সেই অস্বস্তিটা ফিরে এল আবার। তার ইচ্ছে হলো সে এই পৃষ্ঠা ছিড়ে ফেলে। কিন্তু কী ভেবে জানি ছিড়ল না৷ পৃষ্ঠা উল্টাতে থাকল। ডায়েরিতে তেমন কিছু লেখা নেই৷ অল্প কয়েক লাইনের কবিতায় ঠাসা। মিহিন প্রথম থেকেই কবিতা গুলো পড়তে থাকল।

প্রিয় নীল,
যে খামে চিঠি লিখি,
যে খামের ভেতরে এক বুক প্রেম লেখা,
অজস্র রংধনু মিলে যেখানে প্রেমের দ্যুতি ছড়ায়,
আমি সেই ছড়িয়ে পড়া দ্যুতি দিব তোমায়,
যদি তুমি হও আমার।
আমি অজস্র প্রেম দিব,
রক্তিম গোধুলি লগ্নে সঙ্গ দেব,
ভাঙ্গা কণ্ঠে গান শোনাবো,
যদি তুমি হও আমার,
আমি শিশির ভেজা সকাল দিব
এক মুঠো বসন্ত দিব,
যে বসন্তে কোকিল ডাকে,
ফুল ফোটে, প্রেম বয়ে বেড়ায়,
আঙ্গিনায় আঙ্গিনায়,
যদি তুমি হও আমার
প্রতি বর্ষায় এক গুচ্ছো কদম দিব
এক সাথে ভিজে বেড়াব,
যদি তুমি হও আমার,
প্রিয় নীল,
যদি তুমি হও আমার,
আমি নিজেকে বিসর্জন করে দিব৷
তোমার নামে।

(হুদাই! আমি কবিতা টবিতা লিখতে পারি না৷ এখন লেখলাম আরকি। গল্পের স্বার্থে। আসলে আমি পারিই না৷ হয় না৷)
অগোছালো লেখা৷ তবুও যেন মিহিনের মন ছুঁয়ে গেল একদম। এতো ভালো লাগল যে বলে বোঝাতে পারবে না৷ হঠাৎই ওর মন ভালো হয়ে গেল৷ ও যেন একটু হাসলও। মিহিন একে একে সব গুলো কবিতা পড়ে ফেলল। ছেলেটাকে দেখে বুঝাই যায় না যে সে কবিতা লেখে৷ মিহিন ভীষণ অবাক হলো। তার অবাকের সীমা থাকল না। তারপর হঠাৎই শেষ পাতায় এসে থমকে দাঁড়াল সে। প্রথম লাইনটা দেখেই ওর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল৷ মীরা নামটা যেন ওর চোখের বিষে পরিণত হয়েছে। মিহিন পড়তে থাকল,

“আমি মিরাকে আবারো ফোন দিলাম৷ সে ফোন তুলল না। এতক্ষনে বহুবার ফোন দেওয়া হয়ে গিয়েছে৷ তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমি খানিকটা টেনশনে পড়ে গেলাম৷ অথচ আমার টেনশনটা একদমই অপ্রয়োজনীয়। অযথা। জানি না, কেন অযথাই মেয়েটার জন্যে এত টেনশন হয়৷ কেনইবা তার সাথে কথা বলার জন্যে এত আকাঙ্ক্ষা। এত টান! আমি বুঝতে পারি, আমার বুকের ভেতর কী ভীষণ অস্থিরতা কাজ করে তাকে নিয়ে৷ তার কিছু হলেই আমি অস্থির হয়ে যাই৷ আমার হার্টবিট বাড়তে থাকে৷ বুকের ভেতর এক অদম্য যন্ত্রণা অনুভব করি। আমি বুঝতে পারি, তাকে কতটা ভালোবাসি আমি। সে আমার কতটা জুড়ে আমি তা অনুমান করতে পারি। অথচ মেয়েটা এসব কিছুরই ভ্রুক্ষেপ করে না আজকাল৷ ফোন দিলে ফোন তুলে না৷ তুললেও কথা বলতে চায় না৷ আমাদের দেখা হয় না আজ অনেকদিন। ওর কী হয়েছে আমি সেটাও বুঝতে পারছি না৷ ভীষণ টেনশন হচ্ছে আমার। আমি আবারও মিরাকে ফোন দিলাম। রিং হলো৷ হঠাৎই খট করে একটা শব্দ হয়৷ শব্দটা একদম কলিজায় গিয়ে লাগে৷ একঝাঁক প্রশান্তি ঝেঁকে বসে যেন আমাকে ঘিরে। আমি অস্থির হয়ে বলি,
-কী ব্যাপার। ফোন তুলছো না কেন তুমি?
সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি৷
ও খানিকটা ভাবলেশহীন ভাবে বলে,
-দেখেছি। তুলিনি ইচ্ছে করেই৷ পড়ছিলাম৷
-সারাক্ষণ পড় নাকি?
-সন্দেহ করছ?
-তা কখন বললাম?
-তাহলে জানতে চাচ্ছো কেন যে সারাক্ষণ কী করি?
-জানতে চাওয়ার অধিকার কি আমার নেই?
ও এই প্রশ্নটার জবাব দিল না৷ ভারী একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ পাওয়া গেল। সেই দীর্ঘশ্বাসটা আমার কাছে বড় কষ্টদায়ক লাগল। যেন আমাকে হেয় করা হয়েছে। আমার মনটা কেমন জানি করে উঠল৷ মিরা বলল,
-মেডিক্যাল আমার স্বপ্ন। জানো তো?
-তোমার কোনো স্বপ্নের কথা কি আমার অজানা?
-আমাকে পড়তে হয় সারাক্ষণ।
-বেশি পড়লে মাথা হ্যাং হয়ে যায়। জানো?
-জানি৷ তবে কী করব বলো৷ প্রেশারই কমাতে পারি না।
-আমার বড় হিংসে হয় জানো! তুমি আমার থেকে ওই মেডিক্যালকে গুরুত্ব দাও বেশি। আমার খোঁজই রাখো না।
-রাখি কী করে বলো? আমি আসলে আমার স্বপ্নটা যেকোনো মূল্যে পূরণ করতে চাই। একজন ভালো ডাক্তার হতে চাই। তাই সব ফোকাস সেদিকেই দিচ্ছি৷ তুমি মন খারাপ করো না কেমন?
-এভাবে বললে আমি মন খারাপ করতে পারি?
-বিকেলে একটু দেখা করতে পারবে?
আমি যেন হাতে চাঁদ পেলাম৷ এত খুশি লাগল যা বলার মতো না৷ আমি বললাম,
-তুমি কেবল বলো কোথায় দেখা করতে হবে?
-আমরা একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করব। রেড রোজ রেস্টুরেন্ট। ঠিকাছে?
-হ্যাঁ। ঠিকাছে। আমি চলে আসব৷
-আচ্ছা৷ বিকেল চারটা৷ দেরি করা চলবে না৷

আমার আনন্দের সীমা থাকল না৷ অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে থাকল আমার৷ কতদিন পর মেয়েটাকে দেখব! আমার বুকের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে৷ শিরশিরে একটা অনুভূতি হয়৷ আমি প্রচণ্ড আনন্দ অনুভব করি৷ পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন আমার চারপাশে খেলা করতে থাকে৷ আমি ঘিরে রাখে৷ আমি বেশ ভালো লাগা নিয়েই রেড রোজ রেস্টুরেন্টে গেলাম৷ সময় তখন দুটো৷ বেশ জলদিই গিয়ে উপস্থিত হলাম। আমার অপেক্ষার যেন শেষ হয় না৷ আমি অধীর আগ্রহে আমার প্রিয়তমার অপেক্ষা করি৷ মেয়েটা কখন আসবে? কখন তাকে দেখব আমি। আমার পিপাসু হৃদয় তাকে দেখার জন্যে অস্থির হয়ে আছে৷ সময় গড়িয়ে যায়। মিরার দেখা মেলে না৷ চারটা বেজে গেলেও সে আসে না৷ আমি ভীষণ মন খারাপ করি৷ দুপুর থেকে যে ভালো লাগাটা আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছিল তা যেন দ্রুতই আমায় ছেড়ে চলে যেতে থাকে। আমি মন খারাপ করে বসে থাকি৷ এমন সময় একটা ফোন আসে। স্ক্রিনে মিরার নাম। আমি দ্রুত ফোন তুলি৷ ওপাশ থেকে মিরা বলে,
-সরি৷ আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি কি আমার হোস্টেলের দিকে আসতে পারবে? আমরা পাশের পার্কে দেখা করব৷
-আচ্ছা আসছি।

আমি সেখান থেকে বেরিয়ে মীরার হোস্টেলের দিকে যেতে থাকলাম। পার্কের ভেতর ঢুকতেই মিরাকে দেখতে পেলাম৷ সে চুপচাপ বসে আছে। মোবাইল টিপছে। আমি প্রাণে যেন পানি এল। আমার তৃষ্ণার্ত হৃদয় যেন মহানন্দে লাফাতে থাকল। আমার তখন এক অনিন্দ্য অনুভূতি হচ্ছিল৷ অথচ আমার জানা ছিল না সেই অনিন্দ্য অনুভূতি মিরার প্রতি আমার শেষ অনুভূতি ছিল৷ আমি গিয়ে ওর পাশে বসি। বলি,
-এত শুকিয়ে গিয়েছো কেন তুমি? কী হয়েছে?
-এই পড়ার চাপ আরকি। বাদ দাও৷ তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বলার জন্যে ডেকেছি আমি। মন দিয়ে শুনবে। আমাকে ভুল বুঝবে না৷ ঠিকাছে?

আমি যেন হঠাৎই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। কিছুই বলতে পারলাম না৷ আমার মনের ভেতর তখন কেমন একটা অনুভূতি হলো৷ আমার মনে হলো কিছু একটা ঠিক নেই৷ আমার সাথে বেশ খারাপ ধরনের কিছু হবে। মিরা নিজের চুল গুলোকে কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলল,
-তাসফি, আমি আসলে পারছি না৷ এই প্রেমের বোঝা আমি আর নিতে পারছি না৷ একে তো পড়ার চাপ, তার উপর তুমি, তোমাকে সময় দেয়া, কথা বলা, সম্ভব হয়ে উঠে না আমার পক্ষে। বয়ে নিতে পারছি না আর। ইটস ঠু হার্ড ফর মি।
আমি স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি৷ আমার প্রাণ বায়ু নিয়ে যেন কেউ খেলা করছে৷ আমার মনে হলো আমি মারা যাবো৷ এক অসহ্য যন্ত্রণা আমায় ঘিরে ধরতে শুরু করল। মিরা আবার বলে,
-তুমি আর কত করবে? একজনের পক্ষে একটা সম্পর্ক পরিনতি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না। অসম্ভব। তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি?

সত্যি বলতে আমি একদমই নিশ্চুপ হয়ে গেলাম। একদম নিষ্প্রানের মতো৷ মিরা বলল,
-আমি জানি, আমি কাজটা ঠিক করছি না। কিন্তু আমার কাছে আমার কেরিয়ারটা মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট তাসফি। আমি তোমাকে কীভাবে বুঝাই বলো৷ আমি চাইছি না আর এই রিলেশন। আমি সব এখানেই থামিয়ে দিতে চাই৷ অনেক হয়েছে। আর না৷ আমরা দেখা করব না আর৷ ফোন করব না৷ সব যায়গা থেকে মুছে ফেলব দুজন দুজনকে। কেমন?

মিরার গলাটাা ভারী শোনাল। আমার বেশ কিছু বলার ইচ্ছে জাগল৷ মনে অনেক কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে করছিল, কেন তাহলে আমার সাথে প্রেম করলে? তুমি নিজেই তো প্রপোজ করলে। আমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করলে। কেন? আমার দোষ কি? এখন কেন আমায় চলে যেতে বলছো। কেন? আমার তো একটা হৃদয় আছে৷ আমারও তো কষ্ট হয়৷ কেন এমন করলে? আর মুছে দিতে বলছো? এত সহজ মুছে দেয়া? এটা কোনো সাদা কাগজে কালো কলম দিয়ে লেখা প্রেম নয় যে তুমি চাইলেই ফ্লুইড দিয়ে মুছে ফেলতে পারবে। এটা আমার মনের গভীর থাকা কোনো এক নিষ্পাপ পবিত্র অনুভূতি। একে তুমি চাইলেও পৃথিবীর সমস্ত ফ্লুইড দিয়ে মুছে ফেলতে পারবে না। সম্ভবই না। এমন অনেক গুলো কথা বলার ছিল আমার। অথচ আমি এর কিছুই বলতে পারছি না৷ পারি না৷ মুখ দিয়েই আসে না৷ আমি যেন কথাই বলতে পারি না। বোবা হয়ে গিয়েছি৷ মিরা আমার হাতের উপর হাত রাখল। বলল,
-নিজেকে ঘুছিয়ে নিও৷ ভালো থেকো৷ আর পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও৷

কি মিস্টি করে একটা সম্পর্কের শেষ করে গেল মেয়েটা। ইশ! যদি এর কষ্ট গুলোও এভাবে মিস্টি করে শেষ করা যেত! কতো ভালোই না হতো৷ মিরা হাঁটতে থাকল সামনের দিকে৷ আমি বেঞ্চিতে বসে মিরার গমন পথের দিকে চেয়ে থাকলাম। মিরা হাত উঁচিয়ে কাউকে ডাকছে। আমি স্পষ্ট দেখলাম এক সুদর্শন যুবক মিরার দিকে এগিয়ে আসছে৷ তার মুখ ভর্তি হাসি। আমার কষ্টটা যেন আরো বেড়ে গেল৷ তাহলে কি এই কারণ? এর জন্যে আমাদের ব্রেকাপ হয়েছে? আমি স্পষ্ট অনুভব করলাম বুকের ভেতর প্রচণ্ড বেদনা করছে আমার। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। অথচ আমি কান্না করতে পারছি না। আমার চোখে জল জমে না। বুকের ভেতরটা কি এক চাপা কষ্টে জ্বলতে থাকে৷ আমি চুপচাপ বসে থাকি৷ অনেকটা সময় বসে থাকি। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বেজে যায়। একজন গার্ড এসে আমাকে ডাকতেই আমার চেতনা ফিরে৷ আমি অনেকটা উন্মাদের মতো হয়ে যাই৷ ধীর পাঁয়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসি। সমস্ত শরীরের সকল শক্তি যেন লোপ পেয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। হাঁটতেও যেন বড় অনিহা জাগে৷ আমি ফুটপাতের উপর বসে পড়লাম। মনের ভেতর কেমন জানি করছে। আমার দম নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে৷ গাঁ কাঁপতে থাকে। কেমন জানি লাগতে থাকে আমার। তবুও আমার কান্না আসে না৷ আমি কান্না করতে পারি না৷ কান্না করলে একটু যা হালকা লাগত! আমি কোনো মতে বাসায় গিয়ে পৌঁছালাম। নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানার উপর পড়তেই আমার বুক ফেটে কান্না এলো। আমি বালিশে মুখ গুঁজে কান্না করতে থাকলাম৷ আমার সকল যন্ত্রণা যেন আমার চোখের জল হয়ে বেরিয়ে এল। বুকটা ফেটে যাচ্ছিল আমার। বুকের কাছে কেবল ধপ ধপ করছিল৷ আমি নিজের হাত দিয়ে বুকের বাঁপাশটায় হাত বুলাতে থাকলাম। ব্যাথা কমে না আমার। ব্যাথা যেন আরো বাড়তে থাকে৷ জ্বলতে থাকে বুকটা। কী অসহনীয় যন্ত্রণা। আমার গা কাঁপতে থাকে৷ আমি কান্না করি ভীষণ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। অসহ্য যন্ত্রণা আমায় গ্রাস করে নেয়৷ আমি প্রেম যন্ত্রণায় ডুব দিতে থাকি। আমার জীবনটা একটু একটু করে নিঃশেষের দিকে যেতে থাকে। আমি আস্তে আস্তে কষ্ট নামক গভীর খাদের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে থাকি৷

এরপরই আমার মনে হলো আমার বেঁচে থাকার কোনো মানেই হয় না৷ আমার মরে যাওয়া উচিত। এই পৃথিবীতে আমার কিছুই নেই৷ সব শূন্য। শূন্যতা খেলা করে চারপাশে। এখানে থাকলে আমি বেঁচে থেকেও মরে থাকব। এরচে ভালো আমি মারাই যাই।”
এরপর খানিকটা ফাঁকা। কিছুই লেখা নেই৷ মিহিনের বুকের ভেতরটা ধক ধক করছে৷ সে পৃষ্ঠাটা ঘোল দেখছে। সে কান্না করছে। কোনো ভঙ্গিমা ছাড়াই তার চোখের কোণা বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল পৃষ্ঠাটার উপর। সে কাঁপা কাঁপা হাতে পরের পৃষ্ঠাটা উঠালো৷ সেই পৃষ্ঠাটাও খালি। পরের পাতা উল্টাতেই সে একটা লেখা দেখল। মিহিন সেটা পড়তে থাকল।

“আমি হয়তো এই মূহুর্তে এখানে এই লেখা গুলো লিখতে পারতাম না৷ এই যে গুটি গুটি শব্দ করে লিখে যাচ্ছি তা হয়তো হতো না। এতক্ষণে আমাকে হয়তো কবর দিয়ে দেয়া হতো৷ অথচ তেমন কিছুই হয়নি। আমি বেঁচে আছি৷ লিখছি। এসব তার অবদান। যে আমাকে বাঁচিয়েছে৷ আমাকে নতুন প্রাণ দিয়েছে৷ আমাকে একটা ভুল থেকে উঠিয়ে এনেছে। সেই মেয়েটা। ক্লাসের সবচে গম্ভীর পড়াকু মেয়ে। যাকে আমি আমি প্রায়ই দেখি বই হাতে৷ ট্রেনেও দেখি৷ সে বই পড়ছে। বেশ মনযোগ দিয়ে৷ আমাদের ক্লাসেরই। কিন্তু কোনোদিনই কাছে গিয়ে পরিচয় হবার আগ্রহ জাগেনি। আমার আগ্রহটা তখন পর্যন্ত মৃত ছিল। কিন্তু হঠাৎই এই মেয়েটা আমার জন্যে দেবদূত হয়ে আসবে তা আমি কখনোই ভাবিনি৷ সেদিন ভার্সিটি থেকেই ফিরছিলাম৷ চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রতিটি মূহুর্ত কাটছিল চরম কষ্টে৷ আমি শেষমেশ সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম আমি সুইসাইড করব৷ আমার আর বেঁচে থাকার প্রয়োজন নেই৷ আমি দ্রুত ট্রেনের দরজার কাছে চলে গেলাম। ট্রেন লোহার ব্রিজটার কাছে আসলেই আমি ঝাপ দিব। লোহার সাথে প্রতি আঘাতে আমি ধীরে ধীরে মৃত্যুকে নিজের করে নিব। আমি মনে মনে তৈরিই ছিলাম। ব্রীজটা প্রায় চলেই এসেছিল৷ ঠিক তখনই কী বুঝে জানি পেছনে তাকালাম। দেখলাম মিহিন নামের সেই গম্ভীর মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে৷

কী হাস্যজ্বল চেহারায় তাকিয়েছিল সে৷ যেন আমাকে এভাবে মরতে দেখে সে বেশ খুশি হচ্ছে। নাকি এমনিই খুশি৷ কি জানি? মিহিন আরেকটু কাছে চলে এল। বলল,
-ঝাপ দিবে? আত্মহত্যা করবে?
আমার হৃদয়টা যেন গলগল করে উঠল। ট্রেনের দরজার হাতলে থাকা হাতের শক্ত মুষ্ঠিটা সরল হয়ে হলো৷ গা ময় আত্মহত্যার উন্মাদনা যেন লুটিয়ে পড়ল। আশ্চর্য এতো কোমল কণ্ঠ কারো হয়? হয় কারো? সম্ভব? আমি কি ভুল শুনছি? আমার অবাক হাওয়ার সীমা থাকল না৷ আমি তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটাত দিকে। মেয়েটা আবার বলল,
-কী? কথা বলো না কেন? বলতে লজ্জা পাচ্ছো? আরে লজ্জার কি আছে? ঝাপ দাও না। আমি দেখব একটু অনেকদিনের সখ কাউকে আত্মহত্যা করতে দেখার৷ দাও না?
আমি যেন নড়ার শক্তিটুকু পেলাম না। কিছু একটা যেন সেই শক্তিটুকু কেড়ে নিলো। আমরা দুজনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম সেখানে৷ অনেক্ষন। একটা সময় মিহিন বলল,
-পুরুষদের এভাবে চলে যাওয়াটা কাপুরুষতা৷ ঘুরে দাঁড়ানোটা বীরের। আর বীরকে সকলেই পছন্দ করে৷ আমিও৷

এই বলে মিহিন চলে গেল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। নিজের স্টেশন থেকে পরের দুই স্টেশন অব্দি চলে গেলাম অথচ টেরই পেলাম না। কি অদ্ভুত এক ঘোরে আমি হারিয়ে যাচ্ছিলাম। মেয়েটার কথায় বিশেষ কিছু ছিল না। তবে আমার কেন জানি পুরুষ হতে ইচ্ছে জাগল। বীর হতে মন চাইলো। বীরকে সকলেই পছন্দ করে। মিহিনও। আমি বীর হবো৷ মীরাকে একটা জটিল উপহার দেওয়ার ইচ্ছে আছে।”

মিহিন থামল৷ এ পৃষ্ঠায় আর লেখা নেই৷ আপাতত মিহিন কান্না করছে না। তবে সে কান্না করবে না হাসবে সেটাই বুঝতে পারছে না৷ মানুষটার ডায়েরিতে নিজের নাম দেখে সে খুবই খুশি হলো। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিরশিরে অনুভূতি হলো। মিহিন পরের পৃষ্ঠা উল্টালো। নতুন লেখার মতো লাগছে। এরপর অনেকদিন লেখা হয়নি হয়তো। পরশুর তারিখ দেয়া। তার মানে সেদিনই লিখেছে। মিহিন পড়তে থাকল,

“আমি মীরার ঘোর থেকে বের হতেই পারছি না। অদ্ভুত ভাবে সেটা আঁটকে আছে আমার মাঝে। এই মূহুর্তে আমার মীরাকে ভুলে থাকা উচিৎ। অথচ আমি তা পারছি না। এদিকে মিহিন মেয়েটার প্রতি আমার হঠাৎই একটা আকর্ষণ জেগে উঠল যেন৷ খানিকটা কৌতূহল হলো৷ মেয়েটার সন্ধান করতে গিয়েই আমি আবিষ্কার করলাম মেয়েটা ক্লাসে প্রায় অনেকটা সময় আমার দিকেই তাকিয়ে থাকে। আড় চোখে দেখে। একদিন, দুদিন, প্রায় প্রতিদিনই৷ আমি বুঝতে পারিনা আসলে কেন ও আমায় দেখে। সত্যিই প্রথম প্রথম বুঝতে পারিনি৷ এমনটা যখন প্রতিদিন হতে থাকল তখনই মনে হলো…”

মিহিনের ফোন বেজে উঠল৷ ও ধরল না৷ আবার বেজে উঠল। ও স্ক্রিনে চোখ বোলালো এবার। অচেনা নাম্বার৷ হঠাৎই শেষের ডিজিটার দিকে চোখ যেতেই ওর বুকটা কেঁপে উঠল। গা কেঁপে উঠল। চোখে জল এল যেন। ও দ্রুত ফোন ধরল। মোবাইলটা কানের পাশে চেপে ধরে রাখল। যেন ক্ষুদ্র নিঃশ্বাসটাও সে মিস না করে। ওপাশ থেকে সেই চিরচেনা কণ্ঠটা ভেসে এল।
-মিহিন?
মিহিনের গলাটা ধরে এল। বলল,
-হু!
-আমার ডায়েরিটা ফেরত দিবে? ওটাকে খুব মিস করছি আমি। রাতে ঘুম হবে না আমার।
-আপনি জানেন কীভাবে যে ডায়েরিটা আমি নিয়েছি।
-আমি আপনাকে নিতে দেখেছি৷
-তাহলে তখন চেয়ে নিলেন কেন?
-জানি না। আপনি যদি নিচে এসে ওটা দিয়ে যেতেন৷ খুব উপকার হতো৷
-আপনি আমাদের বাসার নিচে? সত্যিই? সত্যিই এসেছেন?

মিহিন দৌড়ে এসে বারান্দার দরজা খুলল। বারান্দায় গিয়ে দেখল ল্যাম্পপোস্ট এর নিচে পাঞ্জাবি পরা একটা মর্মাহত যুবক দাঁড়িয়ে আছে৷ মিহিন আর একটা মুহুর্তও অপেক্ষা করল না। দৌড়ে চলে গেল। তাড়াহুড়োর মাঝে ডায়েরিটা নিতে ভুলে গেল। কিছুদূর যেতেই আবার মনে পড়ল। বিরক্তি জাগল নিজের উপর। এত মন ভোলা কেন ও? ডায়েরিটা নিয়ে দৌড়ে গেল। গেট দিয়ে বের হতেই সেই কাঙ্ক্ষিত জনের চেহারা দেখতে পেল ও। ওর সমস্ত শরীরে যেন রাজ্যের প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল। কী ভীষণ ভালো লাগা তাকে ঘীরে ধরল! তাসফি একটু এগিয়ে এল। বলল,
-দাও। ডায়েরিটা দাও।
-দিব না। এটা আমার কাছে থাকবে। আমি এটা পুড়ে ফেলব।
-এমনটা করো না৷ ডায়েরিটা আমার লাগবে। প্লীজ৷
-উহু। আমি শুনবো না৷ দিবও না৷
-প্লীজ৷ দাও না৷ ওটার খুব প্রয়োজন আমার।
-ছাই প্রয়োজন। ওই মেয়েটা এত কষ্ট দিল তবুও তার পেছনে পড়ে রইলেন৷ কী লাভ হলো বলুন তো?
মিহিনের মনের কোনে লুকিয়ে থাকা কথা গুলো যেন আপনা আপনিই বের হয়ে আসছে। ও নিজেও খানিকটা অবাক হলো। ভাবল বেশি বেশি করে ফেলছে না তো? পরক্ষণে ভাবল নাহ এটাই উপযুক্ত সময়। এখন না হলে পরে আর কখনই বলা হবে না৷ তাসফি বলল,
-এত কথা বলতে পারব না আমি৷ তুমি ওটা দাও আমাকে।
-দিব না বলছি দিব নাহ। শেষ৷ পারলে আমার কাছ থেকে নিয়ে দেখাও।
তাসফি এগিয়ে এল। মিহিন দুহাত পেছনে নিয়ে গেল। তাসফি পেছনে চলে গেল। পেছনে আসতেই মিহিন হাত সামনে নিয়ে এল। তাসফি বলল,
-প্লীজ! এমন করো না৷
-না। আমি এমন করব। এটা দিব না আপনাকে।

তাসফি সামনে চলে এল। মিহিনের অনেক কাছে চলে এসেছে ও৷ মিহিন হাত পেছনে নিয়ে গেল আবার৷ তাসফি এবার সে হাত বরাবর নিজের হাত বাড়িয়ে দিল। তার জন্যে ওকে একটু ঝুঁকতে হলো৷ ঠিক সেই মুহুর্তেই মিহিন ওর গালে একটা চুমু খেয়ে নিল। তাসফি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। সে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, অবাক দৃষ্টিতে মিহিনের দিকে তাকিয়ে থাকল৷ তারপর ধীরে ধীরে তার দৃষ্টি সরল হয়ে এল। হয়তো মিহিনের গোল গোল চোখ দুটোর মাঝে অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখে৷ মিহিন বলল,
-একটা মেয়ের জন্যে সবচে কষ্টের ব্যাপার কি জানো? সে এমন একজনকে ভালোবাসে যে অন্য আরেকজনকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাদের দু’জনের মাঝে তখনও কী চমৎকার প্রেম চলছি। এটা যে কত কষ্টের তা কিঞ্চিত হলেও তুমি বুঝতে পারবে। ভার্সিটির প্রথম থেকে আমি তোমাকে চেয়ে এসেছি৷ প্রতিটি মূহুর্ত আমার কী ভীষণ যন্ত্রণায় কাটত সেটা তোমাকে বলে বোঝানো যাবে না। আমি সেই কষ্টটা গিলে নিয়েছিল। দিব্যি গোমড়া মুখো, পড়াকু মেয়ে হয়ে তোমার মাঝে থেকেছি। অথচ তা কেউ জানতেই পারল না৷ তারপর হঠাৎই তুমি কেমন জানি হয়ে গেলে। ভার্সিটিতেও ঠিকভাবে আসতে না৷ কষ্টে আমার বুক ফাটতো। অথচ তা কেউই বুঝত না। এমনকি তুমিও না। মুখে মুখে শুনি তোমার ব্রেকাপ হয়েছে। তখন আমার সমান তালে ভালো এবং কী তীব্র খারাপ লেগেছিল সেটা যদি তুমি বুঝতে! আমি সেই প্রথম থেকে প্রতিটি মুহূর্ত তোমাকে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছি। তোমাকে চেয়েছি৷ পাব না অনেকটা বিশ্বাসও করে নিয়েছিলাম। অথচ দেখো, ভাগ্য আমায় একটা সুযোগ দিয়েই দিল৷ যার জন্যে আমি এতকাল অপেক্ষা করেছিলাম। তাসফি, প্লীজ! একটাবার। অন্তত একটাবার আমাকে সুযোগ দাও। তোমাকে আমি গড়ে তুলবো৷ নতুন পথ দেখাব৷ প্লীজ গিব মি এ চান্স! প্লীজ!

তাসফির চোখটা যেন ভিজে এল। ভারী গলায় বলল,
-সে আমার ভুল ছিল। সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু আমি তো ভুল ছিলাম না। নাহলে কেন আমার সাথে এমন হলো? কেন?
তাসফি কান্না করে দিল। হাঁটু ভেঙ্গে রাস্তার পাশে বসে পড়ল৷ মুখে হাত দিয়ে কান্না করতে থাকল। মিহিন নিজেও দ্রুত বসে পড়ল। তাসফির মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। চোখে জল মুছে দিয়ে বলল,
-খবরদার কান্না করবে না৷ আমি তোমাকে কাঁদতে দেখতে পারি না৷ সহ্য হয়না।
তাসফির কান্না তবুও থামে না৷ মিহিন কি করবে ভেবে পেল না। তাসফির ঠোঁটে হুট করেই একটা চুম খেল। একটাই। তবে তার ব্যাপ্তিকাল ছিল সুদীর্ঘ। কী গভীর প্রেম ময়। মিহিন তাসফির গলাটা আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। এবার আরো গভীর ভাবে চুমু খেল৷ কী চমৎকার অনুভূতির চুমু। যেটি তাদের জীবনের প্রথম কিস বলে স্মৃতির পাতায় লিখে রাখা হলো৷

নিজেদের কোম্পানি অনেক ডেভেলপ করছে। আজ বেশ বড় এমাউন্টের একটা ডিল সাইন হয়েছে। সাথে আজ এমডি স্যারের আজ বিবাহ বার্ষিকী। তাদের বিয়ের প্রথম বছর পূর্ণ হলো৷ তাই সন্ধ্যায় একটা পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। আয়োজক জনাব শাকের আহমেদ তাসফি এবং তার স্ত্রী মিহিন চৌধুরী। দুজনকে দেখে প্রায় জনেরই হিংসে হয়৷ প্রেমিক প্রেমিকা বুঝি এমনও হয়? এত ভালোবাসা হয়? রিসিপশনে তাসফি আর মিহিন দাঁড়িয়ে। গেস্টদের সাথে কথা বলছে। হ্যান্ডশেক করছে। তাদের ভেতরে গিয়ে বসতে বলছে। ঠিক এমন সময় সোহান এসে হাজির হলো। সোহান তাসফিদের অফিসের একজন স্টাফ। ছেলেটা ভালো৷ সোহান এসে আমার সাথে হাত মিলালো৷ তারপর বলল,
-বস! এ হচ্ছে আমার স্ত্রী৷ মীরা আক্তার।
তাসফি যেন থমকে দাঁড়ালো। মিহিন স্বব্ধ হয়ে দেখছে মেয়েটাকে৷ মিহিনের মেজজটা যেন একটু গরম হয়ে গেল৷ সে তাসফির হাতটা ধরে ফেলল শক্ত করে৷ তাসফি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-আচ্ছা। তো মিস মীরা কেমন আছেন?
মীরা মাথা নিচু করে ভারী গলায় বলল,
-জ্বী ভালো।
-তা মীরা আপনি কী করেন?
কথাটা খানিকটা হেসেই বলল সে। অমনি মিহিন তাসফির হাত ছেড়ে দিল। তারপর হন হন করে হেঁটে চলে গেল৷ তাসফি বুঝতে পারলো যে তার মহারানীর সহ্য হচ্ছে না আর৷ তাই চলে গেল। মীরা মাথা তুলছে না৷ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার লজ্জাবোধ কিংবা অপরাধবোধ হয়তো তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে৷ সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,
-আমি ডাক্তারী পড়েছিলাম। কিন্তু শেষ করতে পারিনি।

-আচ্ছা আচ্ছা। এসব বাদ দিন এখন। আমিও না। কিসব বলছি। সোহান সাহেব। আসুন৷ ভেতরে আসুন। মীরা আপনিও আসুন৷
এই বলে তাসফি দৌড়ে এল নিজেদের ঘরে। এসে দেখল মিহিন মন খারাপ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে৷ মেয়েটাকে আজ কী দারুণই না লাগছে। একদম লাল টকটকে শাড়িটা পরেছে৷ ফর্সা মানুষদের লালে বেশ মানায়। তাসফি এগিয়ে গেল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখল। কানের কাছে চুমু খেয়ে বলল,
-কী হয়েছে? নাকের ডগায় এতো রাগ কেন হু?
-তোমাকে এখানে আসতে বলেছে কে? যাও এখান থেকে। ঢং করতে হবে না।
-আমি কি দোষ করলাম আবার।
-কিছু না। সব দোষ আমার। তুমি কিছু করোনি৷
-আরে আমি কি জানতাম নাকি যে ও সোহানের স্ত্রী। জানতাম?
মিহিন এবার তাসফির দিকে ফিরল। বলল,
-সত্যিই জানতে না?
সত্যিই?
তাসফি মাথা নিচু করে নিল। খানিকটা চুপ থাকল। বলল,
-হু। জানতাম।
-আচ্ছা, ডেকেছো ডেকেছো। হাসি দেওয়ার কী প্রয়োজন ছিল? এতো কথা বলারও কী দরকার ছিল? উফফ! মনে হতেই আমার গা জ্বলে যায়। তুমি মানুষটা একদমই ভালো না৷ তোমাকে খুন করব আমি।
আমি ওকে টেনে নিলাম বুকের কাছে। ও বলল,
-আসছে এখন ঢং দেখাতে৷ ছাড়ো?
তাসফি এবার ওকে বারান্দার কাছ থেকে টেনে নিয়ে এল এপাশের দেয়ালের কাছে। দুহাত চেপে ধরল দেয়ালের সাথে। মুখটা একদম ওর মুখের কাছে নিয়ে বলল,
-আমি খারাপ তাই না? দেখবে,আমি কেমন খারাপ। দেখবে?
-পারোই তো এসব করতে। হুহ! এত ঢং জানো তুমি?
তাসফি এবার ওকে ছেড়ে দিল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
-আমি ঢং করি?
-একটু বেশিই করো। এই এই, চোখ মুখ লাল করে লাভ নেই। আমি সত্যিই বলছি। রেগে লাল হলেও কাজ হবে না।
-ঠিকাছে৷ থাকো তুমি। আমি গেলাম।
মিহিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। হুট করেই বলে ফেলল,
-কীহ? গেলাম মানে? চুমু খাবে না তুমি?
-লাগবে না চুমু৷ হুহ!
কথাটা বলে তাসফি চলে যেতে চাইল৷ মিহিন তার আগেই ওর হাত ধরে ফেলল। এক টানে দেয়ালে কাছে নিয়ে এল ওকে। এবার সে নিজে তাসফিকে দেয়ালের সাথে চেপে ধরে রাখল। বলল,
-খুব সাহস হয়েছে না৷ এত সাহস কই পাও তুমি? পুরনো প্রেমিকা ফিরে এসেছে বলে?
-তোমার মাথা৷ আমি আগ থেকেই সাহসি। তোমার মতো ভিতু না৷ ছাড়ো? ছাড়ো আমায়? আমি তো ঢং করি৷ হুহ!
মিহিন ফিক করেই হেসে ফেলল৷ বলল,
-গাধা, রাগ করতেও পারে না৷ হিহিহি৷
-এই,হাসবা না বলে দিলাম।
মিহিন হাসতেই থাকল। তাসফি এবার ওকে জড়িয়ে নিল নিজের বুকের কাছে। বলল,
-এবার হাসো।
মিহিন হাসি থামিয়ে নিল৷ তারপর বলল,
-ওকে আমার সহ্য হয় না তাসফি৷
-আচ্ছা, আমি তাহলে ওখানে যাবো না আর৷
-আরে আরে কী বলো। তুমি না গেলে হবে৷ আচ্ছা আমরা এক সাথে যাব। দুজন এক সাথেই যাব৷ আমি তোমার পেছন আঠার মতো লেগে থাকব৷ দেখো৷
তাসফি হাসল খানিক। মিহিনও। তারপর সে মুখটা বাড়িয়ে নিল তাসফির কাছে। তাসফি তা সাদরেই গ্রহণ করে নিল। তাসফি মিহিনের মুখটা আরেকটু ভালো করে চেপে ধরল। খানিকক্ষণ চুমুতেই কেটে গেল। তাসফি এবার মুখ তুলে বলল,
-ঠিকাছে? এখন ভালো লাগছে? রাগ কমেছে?
মিহিন কেবল ‘উহু’ শব্দ করল। তারপর নিজেই আরেকটা চুমু খেল। কিছু সময় বাদে যখন মিহিন মুখ তুলল তখন তাসফি খানিকটা হেসে উঠল। মিহিন চোখে মুখে রাগ এনে বলল,
-হাসো কেন?
-তোমার ঠোঁটের লিপস্টিক লেপ্টে গেছে৷ তোমাকে এখন অনেকটা পেত্নীর মতো লাগছে।
-কিহ?
-কিছুনা৷ কিছুনা৷ চলো৷ তোমার লিপস্টিক ঠিক করে দেই।
-না। আমি নড়ব না এখন থেকে৷ আগে বলো তুমি কী বলেছিলে?
আমি চট করেই ওকে কোলে তুলে নিলাম। বললাম,
-বলেছি আমি তোমাকে ভালোবাসি৷ এই তো৷
-না তুমি অন্য কিছু বলেছিলে।
-না৷ আমি এটাই বলেছি।
-না…
-না…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত