অনুভূতিতে অভিরুচি

অনুভূতিতে অভিরুচি

১)
-“তুই দিন দিন এত অসভ্য হয়ে যাচ্ছিস কেন?
নিলু আপার মুখে এমন কথ শুনে আমি হেসে দেই।নিলু আপার কাছে আমি দিন দিন অসভ্য হয়ে যাচ্ছি।
আমি এর কারণ জানতে চাইলে নিলু আপা আমার মাথায় আলতো করে চড় দিয়ে বলে,
-“এই যে তুই আমার দিকে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকিস,আমি কিছু বুঝি না মনে করিস?
আমি নিলু আপার এমন প্রশ্নের কি উত্তর দিবো ভেবে পাই না।আমি যে দীর্ঘসময় নিয়ে নিলু আপার দিকে তাকিয়ে থাকি এটা সত্যি।
-“শুন,আগামীকাল আমার জন্য তিনটা কবিতা লিখবি।ঠিকাছে?
কলেজের একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এক বড় ভাই আমার লিখা কবিতা আবৃতি করেছিলেন।সেই থেকেই নিলু আপা কীভাবে যেনো জেনে যায় আমি কবিতা লিখি।আমার কবিতা নাকি নিলু আপার কাছে অনেক ভালো লাগে।

২)
আমাকে ক্লাশ থেকে নিলু আপা ডেকে নিয়ে যায়।আমি মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো দাড়িয়ে থাকি।নিলু আপা ধমক দিয়ে বলে,”চশমা খোল,চশমা খুলে সামনের চেয়ারটায় বোস।”
আমি ভয়ে ভয়ে সামনের চেয়রটার দিকে এগিয়ে যাই।
নিলু আপা যাদের ডাকেন তাদের সহজে ছাড়েন না।কিছুদিন আগে আমার ডিপার্টমেন্টের একজন কে ডেকেছিলেন।তারপর থেকে ছেলেটাকে এক সপ্তাহ নাগাদ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি।আমি চেয়ারটায় চুপচাপ বসে থাকি।নিলু আপা ফ্লোর থেকে ক্রিকেট স্ট্যাম্প টা তুলতে তুলতে বললো,
-“তোর লিখা চিঠি দিয়ে মেয়ে পটিয়েছে ভার্সিটি তে এমন ছেলের সংখ্যা কুড়ি প্লাস।তোর মিষ্টি মিষ্টি কবিতা দিয়ে মেয়েদের ইম্প্রেস করেছে সেসব ছেলের সংখ্যাও নেহাত কম হবে না।অথচ সেসব ছেলে গুলোর বেশির ভাগই বখাটে টাইপের।তুই কি বুঝতে পারছিস আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি?
নিলু আপার এমন প্রশ্ন শুনে আমি থমকে যাই।ভয়ে ভয়ে আমি বলি,
-“গত দুইমাস ধরে আমার টিউশনি নেই।এই দুই মাসেই আমি এসব চিঠি কবিতা লিখেছি।
চোখ দুটো সরু করে নিলু আপা আমার দিকে তাকায়।আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
-“তার মানে এসবের জন্য তুই টাকা নিয়েছিস?
আমি চুপ করে থাকি।এক পাহাড় সম অপরাধ বোধ আমার ভিতর ছুঁয়ে যায়।
-“আচ্ছা এবার তোর শাস্তির পরিমাপ টা বল।মেরে হাত পা ভেঙে দেই?
আমি এমন প্রশ্নের কি উত্তর দিবো বুঝতে পারি না।নিলু আপা হাত ভাঙ্গতে চাইলে অনুমতি নিবে না।সোজা হাত পা ভেঙ্গে দিবে।
-“আচ্ছা আমি তোকে কিছু করব না।এসব কবিতা,চিঠি ফিটি লিখা আজ থেকে বাদ দিবি।মনে থাকবে?
আমি হু” বলে সেদিনের মতো চলে আসি।

৩)
নিলু আপার জন্য আমি প্রতিদিন একটা একটা করে কবিতা লিখি।আজ হঠাৎ তিন টা লিখতে হবে।আমি মাথা চুলকে বলি,
-“কি ব্যাপার আজ তিনটা কেন?
নিলু আপা আমার দিকে চুপচাপ চেয়ে থাকে।আমি বিব্রতকর পরিস্থিতি তে পরে যাই,
-“আমি তিন দিনের জন্য গ্রামে যাচ্ছি।তোর কবিতা না পড়লে ত আবার আমার পুরো দিন টা খারাপ কাটে।
নিলু আপার এমন কথায় আমি হেসে দেই,মৃদু বাতাসে মুখের উপর আপচে পড়া চুল গুলোর দিকে আমি সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকি।
-“হাসবি না।এই যে তিন দিন যে আমি এই শহরে থাকবো না আমার জন্য তোর খারাপ লাগবে না?
নিলু আপার জন্য আমার খারাপ লাগবে কিনা তা নিয়ে আমি গম্ভীর হয়ে ভাবতে থাকি।আমার এমন গম্ভীরতা দেখে নিলু আপা বলে,
-“আর শুন,এই তিন যদি কারো জন্য চিঠি ফিটি কবিতা লিখিস,খবর করে ছেড়ে দিবো।
নিলু আপার এমন হুমকিতে আমি ভয়ার্ত কন্ঠে বলি,
-“লিখবো না।

৪)
সময় যায় অথচ আমার আর চিঠি লিখা হয় না।কোনো টিউশনিও যোগাড় হয় না।অনেকেই এসে বলে,চিঠি লিখে দে আদনান।আমি অনেক কষ্টে তাদের ম্যানেজ করি।বিষন্ন মন নিয়ে ক্যাম্পাসে বসে থেকে আমি সময় পাড় করি।
চায়ের বিলটা দিয়ে যেই উঠতে যাবো তখনি নিলু আপা আমার সামনে উপস্থিত হয়, আমার হাতে ছোট্ট একটা কাগজ দিয়ে বললো,
-“এই ঠিকানায় সন্ধ্যার দিকে চলে যাবি।তোর জন্য একটা টিউশনি আছে।
মাথা নিচু করে কাগজটা টা আমি হাতে নিই।
সন্ধ্যার দিকে আমি টিউশনি করিয়ে হোস্টেলে ফিরি।
পড়ার টেবিলে বসে আমি নিলু আপার কথা ভাবতে থাকি।শত বিরক্তির মাঝেও নিলু আপাকে ভাবতে গিয়া আমার মাঝে একটা ভালো ছুঁয়ে যায়।আমার হঠাৎ করে ইচ্ছে করে নিলু আপার জন্য চিঠি লিখতে।আমার ভাবনা গুলো যখন বড় হতে থাকে তখনি আমার ফোনটা কেপে উঠে,আমি ফোন তুলে বুঝতে পারি এটা নিলু আপার কন্ঠ।
-“কি কেমন হলো টিউশনি?
আমি খানিকক্ষন চুপ থেকে বলি,ভালো হয়েছে।
-“থ্যাংক্স তো দিবি নাকি?
আমি ছোট্ট করে নিলু আপাকে ধন্যবাদ জানাই।
-“চুপচাপ পড়িয়ে চলে আসবি।মেয়ে গায়ে পড়ে কথা বলতে আসলেও পড়াশুনা ছাড়া কোন কথা বলবি না।মনে থাকবে?
-“মনে থাকবে।

৫)
তিন দিন পর নিলু আপার ফিরে আসার কথা ছিলো।কিন্তু নিলু আপা ফিরলো পুরো এক সপ্তাহ পর।এই এক সপ্তাহ কেটেছে আমার ভয়াভয় রকমের অস্থিরতায়।আমি এই অস্থিরতার মানে খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করি আমি নিলু আপাকে ভালোবেসে ফেলেছি।

ভীতু আমি অনেক বড় একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম,হুট করে চলে গেলাম নিলু আপার বাসার সামনে।দীর্ঘ একটা সময়ের অপেক্ষার পর নিলু আপা বেরিয়ে আসলো।আমি তখনো টং এর টুল টায় বসে।নিলু আপা আমার চোখ থেকে চশমা তার চোখে দিতে দিতে আমার পাশে বসলো।টুথপেস্ট আর ব্রাশ টা আমার হাতে দিয়ে,নিলু আপা আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একবার দেখে নিলো,
চোখটাকে বড় বড় করে বললো-,”আমায় সাত দিন না দেখেই তোর এই অবস্থা?তিন সপ্তাহ না দেখলে ত কবরে চলে যাবি।
আমি নিলু আপার হাতে চারটা কবিতার খাম গুজে দিতে দিতে বলি,
-“তোমায় ছাড়া আমার সময় গুলো কতোটা বিষন্ন,কতোটা স্বাদহীন,কতোটা ক্লান্তিময় তা আমি তোমায় কি করে বুঝাবো বলো?তুমি না হয়,মধ্যরাতে কবিতা গুলো পড়ে নিও।”
আমার এমন কথা শুনে নিলু আপা মাথা হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি আরেকটা সাহসের কাজ করে ফেলি।একটু টুথপেস্ট ব্রাশে মাখাতে মাখাতে বলি,
-“এই যে সাত টা দিন তুমি আমার থেকে দুরে ছিলে,তোমার কি একটু খরাপ লাগে নি?আমার অনেক খারাপ লেগেছে।আচমকা তুমি ফোনটা বন্ধ রেখেছো।আমি তোমায় কতো কল দিয়েছি।

৬)
আমার প্রত্যেক টা বিকাল কাটে নিলু আপার পাশে বসে থেজে।বিরামহীন ভাবে কথা বলে যায় নিলু আপা।নিলু আপা হাসলে আমিও হাসি।একসময় নিলু আপার চোখের জলে আমার ভিতরটা মুচড়ে উঠে।আমি ভেবে পাই না নিলু আপার জন্য আমার এমন হয় কেনো?
আকাশের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিলু আপা বলতে শুরু করে,
-“আমার বাবা যখন মারা যায় আমার বয়স তখন পাঁচ বছর।মা নতুন বিয়ে করে।নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরে মা।আমায় তখন স্থানীয় একটা স্কুলে ভর্তি করানো হয়।ক্লাশ সিক্সে যখন উঠি মা তখন নতুন বাবার সাথে লন্ডনে পাড়ি জমায়।আমি বিভিন্ন ভাবে অবহেলিত থাকি সবার কাছে।এসএসসি দিই খুব কষ্ট করে।রেজাল্ট টাও আশানুরুপ হয় নি।শহরে চলে আসি।এইচএসসি পরীক্ষা টা দেই দাদুর কাছে থেকে।ভার্সিটিতে উঠে পরিচয় হয় আদনানের সাথে।আদনান তখন ভার্সিটির ছাত্র কমিটির সভাপতি ছিলো।আমার বিভিন্ন বিপদে একমাত্র ওকেই পাশে পেতাম।একটা সময় এসে আমি ভেবে বসি এই মানুষ টাকে আমার দরকার।খুব করে দরকার।সারাজীবনের জন্য দরকার।ভালোবাসার কথা আমিই প্রথম আদনানকে বলেছিলাম।আদনান জানায় সেও আমাকে সারাজীবনের জন্য পেতে চায়।কিন্তু সমস্যাটা বাঁধলো সম্পর্কের ছয় মাসের মাথায়।আদনান হঠাৎ করেই বদলে যেতে শুরু করে।আমি কারণ জানতে চাইলে সে জানায় তার বিভিন্ন মিটিং মিছিলে ব্যস্ত থাকতে হয়।আমি বুঝতে পারি আদনান আমার সাথে আর সম্পর্ক রাখতে চাইছে না।হুট করেই একদিন আমার কাছে খবর আসে,আদনানের ব্রেইন টিউমার।উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যায়।আমি সেদিন বুঝতে পারি ওর অবহেলার কারণ।একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে পথ চলতে শুরু করি।আমি ওর সবচে’ কাছের ছিলাম বলে আমাকেই সভাপতি করা হয়।কিছুদিন পরে আদনানের হুট করে চিরতরে চলে যাওয়ার খবর টা চলে আসে।

পরিশিষ্ট:-
সুয়েটারের হাতা টা ভাজ করতে করতে নিলু আপা আমার দিকে রাগ রাগ চোখে তাকায়।আমি মুখে হাসি এনে বলি,
-“আমি আর কোনো মেয়ের দিকে একবারের বেশি তাকাবো না।”
-“একবারো তাকাবা না।
আমি হেসে দেই।নিলুর অনামিকা আঙ্গুল টা স্পর্শ করে বলি,
-“চোখে না হয় কালো পর্দা বেধে দিও।আমি তোমার কাঁধে ভর করে করে হাঁটবো।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত