রক্ত

রক্ত

আমার স্ত্রী তিনদিন ধরে হসপিটালে। তার অপারেশন হবে। প্রতিদিন অফিস শেষ করে এসে রাতে তার সাথে আমি থাকি। নার্স রাতে ঘুমের ওষুধ দিয়ে যায়। আমার স্ত্রী বেঘোরে ঘুমায়। কিন্তু আমার চোখে ঘুম আসে না। এটা-ওটা ভাবি। হাসপাতালের করিডরে পায়চারি করি। ক্লান্তিতে শেষ রাতের দিকে একটু ঘুম আসে। কাল দুপুরে আমার স্ত্রীর অপারেশন। সারাদিন বেশ ধকল যাবে। তাই আজকে একটু আগে-আগে ঘুমানোর প্রিপারেশন নিচ্ছি। আগে হলেও বেশ রাত হয়েছে বলা যায়। সব ওয়ার্ড আর কেবিনের আলো নিভে গেছে। একটু দূরে-দূরে করিডরে আলো জ্বলছে। তারপরেও কিছুকিছু জায়গা একবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

খাবার পানি আর কিছু ওষুধ আনতে নিচে যেতে হবে আমাকে। লিফটে একা আমি। আসতে-আসতে লিফট নিচে নামছে। কিন্তু কিছুতেই যেন সময় যাচ্ছে না। সাততলা থেকে নামতে সাত বছর লেগে যাচ্ছে এমন মনে হচ্ছে।

চারিদিকে কেমন একটা নিস্তব্ধতা। আমার হাতঘড়ির সেকেন্ডের কাটার লাফিয়ে চলার শব্দটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। বুক কেমন ধকধক করছে। নিজের হৃদপিন্ডের আওয়াজ নিজেই যেন শুনতে পাচ্ছি। তিনতলায় এসে লিফট থামলো। কেউ উঠবে বোধহয়। লিফটের দরজা খোলতে না খোলতেই মধ্যবয়স্ক একজন লোক আমার কাছে এসে আকুতি করে বলতে লাগলো, “ভাই আমারে এক ব্যাগ রক্ত দেন।” আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিসের রক্ত, কাকে দিবো? কোন গ্রুপ?” লোকটা তাড়াহুড়ো করে বলল, “ও-নেগেটিভ ভাই। আমার লাগবে, রক্ত আমার লাগবে।”

“আমার ও-নেগেটিভ। কিন্তু আগামীকাল আমার স্ত্রীর অপারেশন। আমায় রক্ত দিতে হবে।” কথাটা বলা শেষ করে লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে আমি লিফটের দরজার দিকে কয়েক পা সরে দাঁড়ালাম। তারপর অনেকটা দৌড়ের মতো করে সিড়ি ঘরের দিকে চলে গেলাম।

কী বীভৎস দেখাচ্ছিল লোকটাকে। মাথা বেয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে। রক্তের সাথে যেন মাথার ভেতরের সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। সারা শরীরে রক্ত। চোখগুলো যেন বাইরে বেরিয়ে আছে। কিন্তু প্রথম যখন লিফটের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল তখন তো লোকটাকে এমন দেখায়নি। সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আমি প্রথমে ঢকঢক করে এক বোতল পানি খেলাম। গলা একদম শুকিয়ে গেছে। ভীষণ ভয় পেয়েছি।

ওষুধ আর পানি নিয়ে সিড়ি বেয়ে উঠছি। লিফটে উঠার আর সাহস পেলাম না। জানি কিছু নেই, তারপরেও বারবার কেন যেন পিছনে ফিরে তাকাচ্ছি। অস্তে-আস্তে উপরে উঠছি। কিন্তু কীসের যেন একটা শোরগোল পাওয়া যাচ্ছে। তিন তলায় একটু মানুষের আনাগোনাও দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এত রাতে তো এমন মানুষ থাকার কথা না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল ঘন্টাখানেক আগে এই ওয়ার্ডে একজন মারা গেছে। মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট। প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। রক্তের গ্রুপও রেয়ার, ও-নেগেটিভ। কিন্তু হাসপাতালে আনার প্রায় সাথে সাথেই মারা যায়। রক্ত যোগাড় করার আর সময়ও পাওয়া যায়নি। আমি সাধারণত কোনোসময় কারো মৃতদেহ দেখি না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। কিন্তু আজকে কী মনে করে যেন লাশটার মুখ খোলা পেয়ে একবার তাকালাম।

কিন্তু এই তাকানোই যেন ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এই তাকানোর ফলেই আমি দেখে ফেললাম আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকরতম দৃশ্যটা। লাশ হিসেবে শুয়ে থাকা ঐ মানুষটা আর কেউ নয়, একটু আগে লিফটের সামনে আমার কাছে রক্ত চাওয়া সেই ব্যক্তি।

এই লোক ঘন্টাখানেক আগে মারা গেলে আমার কাছে গেল কিভাবে! কথা বলল কিভাবে? আমার মাথা আর কাজ করছে না। আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। কেবল দুইহাত দিয়ে নিজের কানজোড়া চেপে ধরে রাখলাম। কেউ যেন বিকট চিৎকার করে বারবার বলছে, “ভাই, আমারে এক ব্যাগ রক্ত দেন, রক্ত। শুধু এক ব্যাগ রক্ত।” আর সেই বীভৎস চিৎকারে যেন আমার কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত