মীরা আমাকে দেখে খানিকটা অবাকই হলো। কিছুক্ষন কেবল আমার দিকেই চেয়ে থাকল। আমি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। ওর দিকে থেকে চোখ সরিয়ে সোজা ক্লাসে চলে এলাম। মেয়েটা হয়তো এই সময়ে আমাকে এখানে আশা করেনি। আমার কয়েকজন বন্ধুও আমার দিকে তাকিয়ে থাকল অবাক নেত্রে। তারাও হয়তো ব্যাপারটা ঠিক ভাবে নিতে পারেনি। সবাই হয়তো এটাই ভাবছে যে আমার তো এখন রুম বন্ধ করে কান্না করা উচিৎ। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়ে একা একা থাকার কথা। রিলেশন ব্রেকাপের চারদিনের মাথায় আমার মতো একটা ইমোশনাল ছেলেকে এভাবে ভার্সিটিতে দেখাটা আসলেই মানান সই নয়। আমিও তেমন কিছুই ভাবতাম। আসলে মীরার সাথে ব্রেকাপ হওয়ার পর আমি একদমই ভেঙ্গে পড়েছিলাম। আমার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। একা একা লাগছিল। বিষণ্ণতায় ভুগছিলাম। হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম। মেয়েটাকে আমি এমন ভাবে বিশ্বাস করলাম অথচ সে আমায় এভাবে ধোকা দিল। আমার সাথে ব্রেকাপ করল। কারণটাও তেমন জটিল না। তার নাকি আমার উপর থেকে আস্থা উঠে গিয়েছে। আমাকে আর তার সহ্য হয় না। সত্যি বলতে এই কথা গুলো খুব আঘাত দিয়েছিল আমার হৃদয়ে। আমার মনে হলো আমি এই মীরাকে চিনি না। আমি মীরাকে প্রপোজ করিনি। যাকে করেছি সে অন্য মীরা ছিল। হয়তো আমি নিজে গিয়ে প্রপোজ করার তার দাম একটু বেড়ে গেল। যাই হোক, তার দেয়া ব্যাথা আসলেই আমায় জঘন্য ভাবে আঘাত করে। আমি মন-টন খারাপ করে একা একা পড়েছিলাম। ঠিক তখনই আমার বন্ধু সোহানের ফোন আসে। আমি ওর ফোনও ধরিনি। চুপচাপ বসে ছিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় ও আমার বাসায় চলে আসে। তারপর আমাকে অনেকক্ষন বুঝায়। বলে,
-দেখ, তোকে ছাড়া মীরা বেশ ভালোই আছে। ইভেন ব্রেকাপের পরের দিনও ও ক্লাস করেছে। সবার সাথে মজা মাস্তি করেছে। এখনও করছে। আর এদিকে তুই কি না সেই পুরনো যুগের মতো রুমে একা একা পড়ে কাঁদছিস। তোকে পুরুষ বলতেও আমার লজ্জা হচ্ছে। আরে ও মেয়ে হয়েও কী দারুণ মুডে আছে, আর তুই ছেলে হয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে কাঁদছিস। ধুরর বেটা!
সোহানের কথা গুলো আমার কাছে প্রথমে খুব অসহ্য লাগল। ফিকে ফিকে লাগছিল। তেমন গায়েও মাখলাম না। কিন্তু সেদিন রাতে যখন আমার ফেইক একাউন্ট দিয়ে মিহিনের আইডি ঘাটছিলাম তখন আমার মন যেন তীব্রভাবে আন্দোলন করে উঠল। মেয়েটা বেশ আয়োজন করে ব্রেকাপ পার্টিও দিয়েছে? আগের মতো নিত্য পোষ্টও করছে? আমার গা জ্বলে গেল একদম। রাতেই সিদ্ধান্ত নিলাম ভার্সিটি আসবো আজ। তাই আজ চলেই এলাম। ফার্স্ট বেঞ্চে বসলাম। স্যারের লেকচারটা বেশ ভালো করে শুনলাম। মীরা কে দেখলাম আড় চোখে আমায় দেখছিল। আমি বেশ ফ্রেশ মাইন্ডেই থাকলাম। যে চলে গিয়েছে তাকে নিয়ে এতো ভাবার সময় কোথায়? সেকেন্ড ক্লাসে স্যার আসতে খানিকটা দেরি করলেন। আমি সে সময়ে বন্ধুদের সাথে মজা করলাম। তারপর আমার পাশে বসা রীতার সাথে কিছুক্ষন গল্প করলাম। ওকে বললাম ও যেন ওর নোটস গুলো আমায় দেয় যেগুলো আমি এ কদিনে মিস করেছিলাম। আড় চোখে মীরাকেও দেখলাম কয়েকবার। প্রথমে আমার দিকে এতো বেশি তাকায়নি। এখন দেখি খানিক পর পরই তাকাচ্ছে। আমি রীতার সাথে কথা বলেই গেলাম। কিছু সময় পর স্যার এলেন। ক্লাসটা মনযোগ দিয়ে করলাম। আমার কেন জানি ভালো লাগতে থাকল। সোহানকে একটা থ্যাংক্স দেয়া উচিৎ। ছেলেটা আমার মস্তবড় উপকার করল। থার্ড পিরিয়ডে স্যারের আসবেন না বলে জানিয়েছেন। ভাবলাম ক্লাসে না বসে থাকি। বাইরে গিয়ে একটু ঘুরে আসি। সোহানের ডিপার্টমেন্টে গেলে কেমন হয়? সাদিককে নিয়ে বের হলাম। তখন রীতা বলে উঠল,
-কই যাচ্ছিস?
আমি বললাম,
-সোহানদের ডিপার্টমেন্টে যাবো।
-দাঁড়া, আমিও আসছি।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলাম। বিপরিতে সে রহস্যময় হাসি দিল। বুঝি না যখনই সোহানের সাথে কথা হয় কিংবা ওর ডিপার্টমেন্টে যাই তখনই কোনো না কোনো ভাবে রীতা হাজির হয়ে যায়। ব্যাপারটা আমার কেমন জানি লাগল। একটু ঘেটে দেখতে হবে। আমি, সাদিক আর রীতা সবে ক্লাস থেকে বের হলাম ঠিক তখনই দেখলাম আমাদের ডিপার্টমেন্টের দ্বিতীয় বর্ষের মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখতেই হাসল একজন। আরেকজন হাসল না। সে কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার চোখ ফুলে আছে। চোখের নিচে কালি পড়ে আছে। আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকল যেন আমায় আস্ত খেয়ে ফেলবে। আশ্চর্য তো! আমার দিকে এভাবে তাকানোর কী আছে? ওরা আমার দিকে এগিয়ে এলো। ঠিক তখনই ক্লাস থেকে মীরা তার বান্ধুবিদের নিয়ে বেরিয়ে এলো। মেয়ে দুটো আমার কাছে এর আগেও এসেছিল। ওর কয়েকটা জায়গায় বুঝতো না। তাই সেগুলো বুঝতে আমার কাছে আসতো। যদিও পড়া গুলো তেমন জটিল না। এরা বুঝে না কেন কে জানে। যাই হোক সেই সুবাদে মীরাও ওদের চিনে। আমার সামনে মেয়ে দুটোকে দেখতেই ও ভ্রু কুচকে তাকালো। বলল,
-তোমরা এখানে কী করছো?
যে মেয়েটি প্রথমে আমাকে দেখে হেসেছিল সে বলল,
-ভাইয়ার কাছে এসেছিলাম কিছু প্রব্লেম নিয়ে।
মীরা খানিকটা কড়া স্বরে বলল,
-সব সমস্যা নিয়ে ভাইয়ার কাছে আসা লাগে নাকি? আমরা আছি না? মেয়ে মানুষ মেয়ে আপুদের কাছেই তো আসবা!
যে মেয়েটির চোখ ফোলা ছিল, পাশ থেকে সে বলে উঠল,
-উনি বুঝালে আমার সহজে বুঝে যাই। তাইই বারবার উনার কাছে আসছি। তা আমরা যার কাছে ইচ্ছে তার কাছে যাবো, তাতে আপনার কী?
মীরা রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো মেয়েটার দিকে। যেন আস্ত খেয়ে ফেলবে। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমি বললাম,
-তোমরা লাইব্রেরীতে আসো।
ওদের এই কথা বলে সাদিকের দিকে তাকিয়্র বললাম,
-তোরা যা। আমি আসছি।
এই বলে আমি লাইব্রেরীর দিকে যেতে থাকলাম। মেয়ে দুটোও আমার পেছন পেছন আসছি। মীরার কী করল কে জানে। যাওয়ার পথে আমি ওদের বললাম,
– তোমাদের নামটা জানি কী বলেছিলে?
গম্ভির করে থাকা মেয়েটা বলে উঠল,
-আপনার আমাদের নামও মনে নেই?
-আসলে ভুলে গিয়েছিলাম। আমার মস্তিষ্কের নিউরন গুলো ভালো করে ক্যাচ করতে পারেনি নাম গুলো।
মেয়েটা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকালো। আমি বললাম,
-এবার বলে দাও। আর ভুলব না। প্রমিস।
হাসি মুখ করে থাকা মেয়েটা বলে উঠল,
-আমার নাম ইরা। ইরা চৌধুরী।
গম্ভির করে থাকা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-তোমার নাম কী?
মেয়েটা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,
-থাক, শুনা লাগবে না।
তার কণ্ঠে অভিমান ঝরে পড়ল। বললাম,
-আহা! বলো না?
-বললাম তো,শুনা লাগবে না। লাইব্রেরীতে এসে গিয়েছি। চলুন, ভেতরে যাওয়া যাক।
আমি বললাম,
-দেখো তো কেউ আছে কী না?
মেয়েটা ভেতরটা দেখে বলল,
-না কেউ নেই।
যাক। তাহলে বুঝানো যাবে। অন্যান স্টুডেন্টরা থাকলে শব্দ করে কথা বলা যেত না। তাদের ডিস্টার্ব হতো। অল্প সময়ের মধ্যেই ওদের পড়াটা বুঝিয়ে দিলাম। তবে গম্ভির করে রাখা মেয়েটা কিছু বুঝল কি না জানি না। সে সেই কখন থেকে কেবল আমার দিকেই তাকিয়ে থাকল। আশ্চর্য আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকার কী হলো? মীরার কাছে এর জন্যে অনেক বকা খেয়েছিল মেয়েটা। তবে বকা খেয়ে আমাকে দেখা ছাড়েনি। কেবল ভয়ে ভয়ে দেখত আমায়। আজ যেন রাগ নিয়ে দেখছে। কোনো ভয় নেই। কেবল চোখে মুখে রাগ আর তীব্র অভিমান ভাসছে। বললাম,
-তুমি কিছু বুঝলে? সারাক্ষণ তো আমার দিকেই তাকিয়ে থাকলে।
-কী করব বলুন। আপনি তো আর দেখেন না। তাই আমাকেই দেখতে হয়।
-কীহ?
ইরা মেয়েটা চোখ গোল গোল করে তাকালো ওর দিকে। কনুই দিয়ে গুঁতো দিল ওর গায়ে। মেয়েটার যেন হুস ফিরে এল। বলল,
-কিছু বলছিলেন নাকি?
খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে প্রশ্নটা করল ও। বললাম,
-হ্যাঁ, বলেছিলাম তুমি কি পৃথিবীতে আছো? নাকি উপরে চলে গিয়েছো?
মেয়েটা খানিকটা লজ্জা পেল। মুখ লাল হলো তার। অদ্ভুতরকম মায়াবী লাগল ওকে। ঠিক তখনই মীরা কয়েকটা ছেলেকে নিয়ে এলো। ওর মেয়ে বন্ধু গুলোও ছিল। ও এসে সোজা ওই মেয়েটাকে দেখিয়ে বলল,
-এই মেয়েটা। ও তখন আমার সাথে তর্ক করেছিল।
ছেলেটাকে আমি চিনি। আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই। রাজনীতির সাথে জড়িত। নাম রোহান। রোহান বলল,
-কী ব্যাপার? তুমি ওর সাথে তর্ক করেছো কেন? আর তুমি তো এই ডিপার্টমেন্টেরো না। এখানে কী করছো?
পাশ থেকে মীরা বলে উঠল,
-কী আর করবে? এদের তো ছেলে দেখলেই মাথা ঠিক থাকে না!
মেয়েটা রেগে গিয়ে বলল,
-মুখ সামলে কথা বলুন। বড় বড়ের মতো থাকেন। মুখ ছুটাইয়েন না আমার।
-কী বলবি তুই? চিনিস আমায়? আমি কে জানিস?
-কে আপনি? প্লে গার্ল। মানুষের মন নিয়ে খেলেন আপনি। আস্ত একটা ডাইনি! আপনি তাসফির মতো এমন ভালো ছেলের সাথেও প্রেম চালিয়ে গেলেন আবার এই যে এই রোহান ভাইকে নিয়ে এলেন, উনার সাথেও রুমে যেতেন। আপনি কেমন মেয়ে সেটা নিশ্চয়ই আর বিস্তারিত বলা লাগবে না?
আমি কেবল অবাক হয়ে মীরার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ও একবার আমার দিকে দেখল। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল,
-কককী বলছিস এগুলো? মাথা ঠিকাছে তোর? মুখে যা আসছে বলে দিচ্ছিস?বেয়াদব মেয়ে মুখে কথা আটকায় না?
মীরা রেগে গিয়ে চেঁচামিচি করতে থাকল। ঠিক তখনই আরেকটা ছেলে এলো এবং সে রোহানের কানে কিছু একটা বলল। কী বলল সেটা আমি জানি না, তবে কথাটা শুনেই রোহানের মুখ শক্ত হয়ে গেল। ততক্ষনে মীরা অনেকটা
চেঁচামেচি করে ফেলেছিল। এক সময় মীরা ওই মেয়েটাকে মারতে এগিয়ে গেল। ঠিক তখনই রোহান মীরাকে টেনে সরিয়ে দিল। তারপর গম্ভির মেয়েটার সামনে এসে বলল,
-সরি বোন,আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে। ক্ষমা করে দাও। প্লিজ।
গম্ভির মেয়েটা হাসল। বলল,
-হাহাহা। তাহলে আমার বাবার কথা জেনে গিয়েছিস?
মীরা তখনও চিল্লাচিল্লি করছিল। রোহান ছেলেটা ওকে এক চড় দিয়ে থামিয়ে দিল। তারপর মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল রোহান। গম্ভির মেয়েটা বলল,
-তোর এই মীরার উপর আমার অনেক রাগ। ওকে খুন করতাম আমি। কত বড় সাহস তাসফিকে চিট করে ও?
আশ্চর্য ব্যাপার মেয়েটা হদ্দমে আমাকে তাসফি তাসফি বলে যাচ্ছে। মানে কী? আমি যে ওর বড় সেটা কী ও ভুলে গিয়েছে? গম্ভির করে মেয়েটা বলল,
-রোহান ভাই,ওকে বলেন তাসফির কাছে ক্ষমা চাইতে!
রোহান মীরার দিকে ফিরতেই আমি বললাম,
-তার প্রয়োজন নেই। রোহান তোরা চলে যা এখান থেকে ভাই। ক্ষমা-টমা চাওয়া লাগবে না। ওকে আমি অনেক আগেই ক্ষমা করে দিয়েছি। যা।
ওরা চলে গেল। আমি চুপচাপ বসে থাকলাম। গম্ভির করে মেয়েটা এতোক্ষন রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল। এখন মোটামুটি ঠিক আছে। কেবল ছোট ছোট করে শ্বাস নিচ্ছে। আমি ইরার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-কোন ডিপার্টমেন্টের ও?
গম্ভির করে মেয়েটাকে দেখিয়ে বললাম। ইরা বলল,
-ইংরেজি ডিপার্টমেন্ট।
-তো ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের মেয়ে এখানে ক্যামিস্ট্রি বুঝতে আসে কেন?
ইরা কিছু বলল না। চুপ করে থাকল। ওই মেয়েটাও! আমি আবার বললাম,
-তোমরাও আমাকে বোকা বানালে? চিট করলে? মিথ্যা বললে?
ইরা তখনও কিছু বলল না। আমি বহু কষ্টে নিজের রাগটাকে সংযত করলাম।বললাম,
-আর যদি কখনও আমার সামনে আসো তো খবর আছে দেইখো। দুজনের একজনও আমার সামনে আসবা না আর। তোমাদের মুখ দেখতে চাই না আমি। ইডিয়ট!
একটু থেমে বললাম,
-এখান থেকে যাও? যাও?
ইরা উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু মেয়েটা উঠে দাঁড়ালো না। সে কেবল আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি বললাম,
-যাচ্ছো না কেন? চলে যাও। আমাকে রাগাবা না আর।
মেয়েটা বসে বসে মুচকি হাসল কেবল। বলল,
-আপনি রাগলে আপনাকে বোকা বোকা লাগে। হিহিহি।
রাগে আমার গা গিজগিজ করছিল। কোনো মতে সেখান থেকে উঠে এলাম। ব্যাগ নিয়ে সোজা বাসায় চলে এলাম। টানা এক সপ্তাহ ভার্সিটি গেলাম না। এরা সবাই পেয়েছে কী? সবাই দেখি আমাকে বোকা বানাচ্ছে। আমি কি এতোই বোকা? মেজাজ গরম ছিল ক’দিন। তারপর খানিকটা স্থির হলো। সব ভুলে গেলাম। এখন থেকে ঠিকভাবে ক্লাস করব। কোনো মেয়ের সাথে এতো বেশি মিশব না। নির্দিষ্ট দুরত্ব বজায় রাখব। এমনটাই ভাবছিলাম আমি। সন্ধ্যার দিকে এসব ভাবতে ভাবতেই বাসায় ফিরছিলাম। ঠিক তখনই আমাকে কিডন্যাপ করা হয়। কয়েকটা ছেলে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গাড়িতে উঠায়। দুজনে আমার দু হাত ধরে রাখে। আরেকজন মুখে ট্যাপ মেরে দেয়। আমি বোকার মতো চেয়ে থাকি কেবল। শেষমেশ হয়তো এটাই হবার ছিল আমার সাথে। আমি মন খারাপ করে বসে থাকলাম। একটা সময় আমার মুখের ট্যাপ খুলে দেয়া হয়। একটা রেস্টুরেন্ট এর সামনে থামে গাড়ি। গাড়ি থেকে আমাকে বেশ সম্মানের সহিত নামায়। যে জন মুখের উপর ট্যাপ মেরেছিল সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-সরি ভাইয়া। আমাদেরকে বাধ্য হয়ে এমনটা করতে হয়েছে। মেডামের আদেশ। এখন আপনি ভালো ছেলের মতো রেস্টুরেন্ট এর পাঁচ নাম্বার কেবিনে চলে যান। মেডাম আপনার জন্যে ওখানে অপেক্ষা করছেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
-মেডাম? কোন মেডাম?
-মিহিন মেডাম। গেলেই চিনতে পারবেন। আপনি যান এখন। আপনার সাথে ওরা দু’জন যাবে। যাতে আপনি আবার পালিয়ে না যান।
-কী সব বলছেন ভাই। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
-গেলেই টের পাবেন। এই তোরা ভাইকে নিয়ে যা।
দু’টো ছেলের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলল ছেলেটা। ছেলে দুটোর দিকে তাকিয়েই আমি খানিকটা ভয় পেয়ে গেলাম। কী খেয়ে এমন বডি বানিয়েছে কে জানে। আমি পালিয়ে যাওয়ার কথা আর ভাবলামও না। পাঁচ নাম্বার কেবিনের উদ্দেশ্যে হাঁটতে থাকলাম। পেছন পেছন ছেলে দুটো আসতে থাকল। সত্যি বলতে নিজেকে তখন সেলিব্রিটি মনে হচ্ছিল। আশপাশের সবাই কেমন করে জানি তাকাচ্ছিল। কেউ কেউ অবাকও হচ্ছিল। আমার কেমন জানি ভালো লাগতে থাকল। পাঁচ নাম্বার কেবিন আসতেই আমি ওখানে ঢুকে গেলাম। যেহেতু আমাকে এতো সম্মান দেয়া হচ্ছে সেহেতু আর যাই হোক আমাকে খুন করা হবে না। এটা আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু ভেতরে ঢুকে আমার মনে হলো আমাকে খুন করাই ভালো ছিল। অন্তত এখানে এদের দেখতে হতো না। ইরা এবং মিহিন, দুজনেই আমাকে দেখে হাসল। বলল,
-কেমন আছেন ভাইয়া?
-তোমরা? তোমরা এখানে কী করছো?
ইরা বলল,
-সরি ভাইয়া,আপনাকে এভাবে এখানে নিয়ে আসতে হলো। আসলে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। আপনাকে এমনিতে বললে আপনি কখনই আসতেন না। তাই এভাবে নিয়ে আসলাম। আসলে আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। এই যে, দেখেন ওকে। ওর নাম মিহিন। মিহিন চৌধুরী। আমার কাজিন। এই যে এক সপ্তাহ ক্লাসে এলেন না আপনি, মেয়েটা দিন রাত কেঁদেছে। কিচ্ছু খাওয়াতে পারিনি ওকে। খেলেও অল্প। চোখের নিচে কালি দেখেন। চোখ ফুলে কী একটা অবস্থা। ওকে এভাবে দেখে আমার ভালো লাগেনি। তাই এমনটা করেছি।
এতটুকু বলে ইরা মাথা নিচু করে ফেলল। মিহিন আগ থেকেই মাথা নিচু করে ছিল। মাঝে মাঝে নাক টানছিল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তারপর ওদের সামনে বসে পড়লাম। কিছু বললাম না। ইরা মাথা নিচু করেই বলল,
-আসলে ভাইয়া ও আপনাকে খুব পছন্দ করে।
-ইরা, তুমি একটু তোমার দিকে থেকে ভেবে দেখো তো, এই মূহুর্তে আমাকে এসব বলা ঠিক? তোমরা জানো আমি কোন সিচুয়েশনের মধ্যে দিন পার করছি? মীরা…
পুরোটা আর বলতে পারিনি। তার আগেই মিহিন খানিকটা শব্দ করে বলে উঠল,
-ওই মেয়েকে নিয়ে এখানে কোনো আলোচনা হবে না। ওর নামও যেন আমি কারো মুখে না শুনি।
আমি বললাম,
-বললে সমস্যা কী? মী…
-আমার সহ্য হয় না। ওর নাম নিলেও সহ্য হয় না।
কী মেয়েরে বাবা। এই মেয়ে যাকে বিয়ে করবে তার জীবন তচনচ হয়ে যাবে। আমাকে তার আগেই কেটে পড়তে হবে। আমি কিছু বলব তার আগেই ইরা বলল,
-ভাইয়া, আসলে মিহিন আপনাকে অনেক আগ থেকেই পছন্দ করে। তাই তো বারবার পড়া বুঝার বাহানা নিয়ে আপনার কাছে আসে। ও আসলে আপনার কাছাকাছি থাকতে চাচ্ছিল। আপনাকে কাছ থেকে দেখতে চাচ্ছিল। তাই আমি বাধ্য হয়ে মিথ্যাটা বলি। আপনি যেদিন মীরা আপুকে প্রপোজ করেছিলেন, সেটা শুনার পর ও অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। কান্না করতে থাকে। একটা সময় ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ডাক্তার বলে ওর প্রেশার নাকি হুট করেই লো হয়ে গিয়েছিল। তাই মাথা ঘুরে পড়ে যায়। চিন্তা করেন, কী একটা ধকল গিয়েছে। তারপরও আমি ওকে নিষেধ করতাম। কিন্তু যখন দেখতাম ওর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছে, ও মন খারাপ করেছে তখন আসলে আমি আর থাকতে পারতাম না। নতুন কোনো বাহানা বানিয়ে সেই আবার আপনার কাছে আসতে হতো।
আমি কেবল স্থির হয়ে বসে থাকলাম। কিছু বললাম না। ইরা থেমে গেল। অনেকটা সময় কেউ কিছু বলল না। কেবল মিহিনের নাক টানার শব্দ ছাড়া আর তেমন শব্দ হলো না। ইরা হুট করেই বলে উঠল,
-আচ্ছা, আপনারা থাকেন তাহলে। আমি আসি।
তারপর মিহিনের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসি দিয়ে বলল,
-অল দ্য বেস্ট।
মেয়েদের বন্ধুত্ব গুলো বড় অদ্ভুত হয়। এদের ফ্রেন্ডশিপে কতো আবেগ থাকে, কতো কেয়ারনেস থাকে। এরা জীবনে একটা ফ্রেন্ডকেই আপন করে নেয় এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাদের ফ্রেন্ডশিপ থাকে। এর মাঝে এদের কতো ঝগড়া কতো রাগারাগি হবে, কিন্তু অল্প সময়ের মাঝে তাদের বন্ধুত্ব সেই আগের মতোই হয়ে যাবে। ইরা চলে গিয়েছে। আমি বসে থাকলাম। মিহিনও বসে থাকল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খানিকটা আপসোস হলো। এই মেয়েটাকে আমি আগে দেখলাম না কেন? দেখলে হয়তো আজকে সন্ধ্যাটা আমরা খুব আনন্দের সাথে কাটাতাম। মিহিন মাথা উঁচিয়ে আমাকে দেখল একবার। আবার মাথা নামিয়ে নিল। আমি ওর দিকে তাকিয়েই থাকলাম। কিছু সময় পর নিচের দিকে তাকিয়ে থেকেই খানিকটা ধরে আশা গলায় বলল,
-কেবল নিজের ডিপার্টমেন্টেই যেন সুন্দরী মেয়ে আছে। আর যেন কোথাও নেই। কতো হাঁটলাম সামনাসামনি, নিজেকে নানান ভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করলাম, তবুও আমাকে দেখল না। দেখল কাকে? ফালতু একটা মেয়েকে। আবার গিয়ে বোকার মতো প্রপোজও করে দিল। এদের তো খুন করা উচিৎ।
আমি মনে মনে হাসলাম। বললাম,
-আর যারা মিথ্যা বলে আমাকে দেখতে আসে? তাদের কী করা উচিৎ?
-হুহ! নিজে মনে হয় মিথ্যা বলে না।
-আমি তোমার মতো না।
-জানি তো কেমন। ছ্যাঁকা খেয়ে মর্মর অবস্থা।
আমি কিছু বললাম না আর। চুপচাপ থাকলাম। কিছু সময় পর বললাম,
-মীরাই ভালো ছিল। ডেটিং এর সময় এমন ফালতু কথা বলতো না। যাই আমি।
মিহিন উঠে দাঁড়ালো। দৌড়ে এসে আমার পাশে বসল। হুট করেই যেন সে রেগে গেল। রাগে লাল টমেটোর মতো হয়ে গেল ও। বলল,
-বলেছি না ওই ডাইনীর কথা আর বলবেন না। সমস্যা কী আপনার? কথা শুনেন না কেন?
আমি হাসলাম খানিকটা। বললাম,
-তোমাকে রাগলে অনেকটা টমেটোর মতো লাগে। হাহাহা।
-লাগুক। আপনার কী? আচ্ছা ওই ডাইনীর সাথে যখন ডেটিংয়ে যেতেন কী কী করতেন?
আমি মনে মনে হাসলাম। ভাবলাম আরেকটু রাগিয়ে দেই ওকে। একে রাগিয়ে বেশ মজা পাওয়া যাবে। বললাম,
-অনেক কিছু করেছি। অনেক কিছু।
-অনেক কিছু? কী কী করেছেন? বলেন না?
ও আমার পাশে আরেকটু সরে এল। আমি বললাম,
-বলব না তোমায়?
ওর চোখে জল জমে গেল। ভারী কণ্ঠে বলল,
-বলুন না। সত্যি করে বলুন। প্লিজ। কিস করেছেন?
আমি অনেকটা সময় চুপ থাকলাম। কেবল ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটা কেঁদে দিল হুট করেই। ঠোঁট উল্টিয়ে বাচ্চাদের মতোন কাঁদে ও। অসাধারণ লাগে ওকে। আমার কী হলো জানি না। আমি হুট করেই ওর ঠোঁটে চুমু খেলাম। গভীর অনুভূতি সম্পন্ন আমার জীবনের প্রথম চুমু। ও তখন কেবল অবাক হয়েছিল। তারপর হুট করে নিজ থেকেই আমার ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। আমি আমার মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
-জীবনে প্রথম কোনো মেয়ের ঠোঁটে চুমু খেলাম।
ও কিছু বলল না। চট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং কান্না শুরু করে দিল। তখন আমার কাছে মনে হলো সুখ আছে এই পৃথিবীতে। অবশ্যই আছে। সবাই ভালোবাসতে জানে না। যে জানে সে ছাড়তে জানে না। যদি ছেড়ে দেয় তবে জেনে নিও, তাদের কখনও প্রেম ছিল না। ভ্রম ছিল। আকর্ষণ ছিল কেবল। অবশেষে আমাকেই হার মানতে হলো। মিহিনের মতো মেয়ের জিত হওয়াটাই আসলে সবার কাম্য। আমারও।