রোজাদার জামাই

রোজাদার জামাই

আমার শ্বশুর এতো পরিমাণে বুদ্ধিমান ও কৃপণ কেউ সেটা নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারবে না। প্রতিবারই আমাকে রমজান মাসে দাওয়াত দেয়, যাতে করে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারে। জামাই দাওয়াত দেওয়াও হল সাথে খাওন ও কম লাগলো। এই অঞ্চলের প্রতিটা মানুষ আমার শ্বশুরের বুদ্ধির কাছে ফেল মারে। গতবছর রমজান মাসে দাওয়াত দিয়ে আমাকে ৩০টা রোজ রাখতে বাধ্য করছিল ৷ প্রতিদিন সেহরী করার সময় শ্বশুর আব্বা আনাকে মধুর সুরে ডাকে….

বাবা তুহিন, ওঠো বাবা ঐ দেখ সেহরীর আযান দিচ্ছে। আমি যতই ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকিনা কেন শেষমেশ আমার গায়ে হাত দিয়ে ডেকে তুলবেই। মেয়ে আর জামাই যে এক রুমে শুয়ে আছে সেটা জেনেও না জানার ভান করে ডাকতে থাকে। অবশেষে প্রতিদিন আমাকে শ্বশুরের কাছেই হার মানতে হয়। এবার রমজানেও দাওয়াত দিছে। কিন্তু আজ নয়টা রোজা হয়ে গেল তবুও আমি যাচ্ছি না। প্রতিদিন নানান রকম অজুহাত দেখিয়ে পার করছি। কিন্তু এমনি ভাবে আর কয়দিন!!

আজ বাসায় আসার সাথে সাথে তিথি রাগী কণ্ঠে বলল কি ব্যাপার! আমার বাবা বারবার ফোন দেওয়ার সত্বেও তুমি তার ফোন রিসিভ করছো না কেন! আমি কোন কথা না বাড়িতে সোজা ওয়াশরুমে গেলাম। ফ্রেস হচ্ছিলাম। তিথি গটগট করে এসে পিছন থেকে বলল কি হলো উত্তর না দিয়ে চলে আসলে যে! আমি বললাম তোমার বাবা ফোন দেয়নি তিনি ১৭ বার মিসকল দিছে বাসায় আসার পথে গাড়ির মধ্যে থেকে দেখলাম।

— তার মোবাইলে টাকা ছিল না বলেই হয়তো মিসকল দিছিলো, তা তুমি কল ব্যাক করতে পারতে! বড় কোন সমস্যাও তো হতে পারতো!
— তোমার বাবা কি গরীব নাকি যে মোবাইলে সামান্য টাকাও থাকে না।
— তা তুমি যে এতো বড় লোক তুমিই তো কল ব্যাক করতে পারতে।
— আমি কল ব্যাক করব সেই সময়টা পেলাম কই! বললাম তো গাড়ির মধ্যে ছিলাম।

তিথি আর কোন কথা না বলে মুখ ভেংচিয়ে চলে গেল। রাতে ডিনার করার সময় ফোনের স্পিকার অন করে শ্বশুরকে ফোন দিলাম। তা নাহলে তো রাতে বউয়ের সাথে এক ঘরে ঘুমানো হবে না। ফোন দিয়েই শ্বশুর আব্বাকে সালাম দিলাম।

— আব্বা কেমন আছেন! শরীর স্বাস্থ্য ভালো আছে তো?
— ভালো আর কেমনে থাকি! একটা মাত্র জামাই তারপরও তোমার কোন খোঁজ পাই না। কোথায় থাকো বলো তো! সারাদিন ফোন দিয়েও খোঁজ মেলেনা।
— আব্বা আর বলেন না কাজের যা এতো পরিমাণে চাপ, কোন রকম সামলে উঠতে পারছিনা।
— হ্যাঁ কাজ থাকলে তো কিছু করার নেই। তা তোমার অফিস ছুটি হয়ে গেছে শুনলাম তো এখনও কিসের কাজ! আমার সাথে ঢপ মারো নাকি?
— ছিঃ আব্বা আপনার সাথে ঢপ মারবো কেন!
— প্রতিবার পহেলা রোজা থেকে তুমি আমার বাসায় থাকো,

আর এবার নয়টা রোজা হয়ে গেল তবুও তোমার দেখা নেই। আগামীকালই তুমি তিথি মামণীকে নিয়ে আমাদের এখনে আসবে। তোমার শ্বাশুড়ি কেমন রাগ করে আছে জানো! আমি কথা বলার আগেই পাশ থেকে তিথি বলল আব্বু আমরা আগামীকাল সকালেই আসছি। আম্মুর চিন্তা করতে বারণ করো।

এরপর তিনি আমার নাম ধরে বলল কি ব্যাপার তুমি কোন কথা বলছো না কেন? সত্যি আগামীকাল আসছো তো! আমি বললাম আব্বা মিথ্যার কি আছে! আপনার মেয়ে যখন বলছে তখন আগামীকালই আসছি। এরপর তিনি হঠাৎ করে বলে উঠলো দেখ বাবা তুমি আমাকে আব্বা বলে ডাকবে না৷ আব্বু বলবে নয়তো ড্যাডি বলে ডাকবে। আব্বা ডাকটা শুনলে নিজেকে কেমন যেন বয়স্ক বয়স্ক লাগে। এর চেয়ে বরং তুমি আব্বুই ডেকো। জামাই শ্বশুরের কথা শুনে বউ পাশ থেকে মিটমিট করে হাসছে। আমি মনে মনে বলছি শালা নিজের বাপকে কখনো আব্বু বলিনি আর শ্বশুরকে বলব আব্বু!! বুইড়া শ্বশুরের ঢং দেখে বাঁচি না। আব্বা বলে ডাকছি এতেই শুকরিয়া জানাও। আমার কাছে ওতো ডিজিটাল সাজতে এসো না। এরপর বললাম আচ্ছা তাহলে রাখি আমরা আগামীকাল আসছি। ফোনটা রেখেই একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললাম।

ডিনার শেষ করার পর ২০ দিনের টেনশন নিয়ে রুমে ঢুকলাম। “এই ২০ দিন রোজা তো থাকতে হবে সাথে আমাকে না খাইয়ে রাখার প্লানিং করছে শ্বশুরমশাই। গতবার রমজানের পর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাসায় এসেছিলাম চিকন আলীর মতো নাজানি এবার কার মতো করে পাঠায়। এসব চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমের ঘোরেও স্বপ্ন দেখছি রোজা রাখিনি বিধায় শ্বশুর আমাকে তাড়া করছে। তাড়া করতে করতে এক পর্যায়ে হোচট খেয়ে পড়ে গেছি। হঠাৎ করে তখন ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে দেখি সকাল হয়ে গেছে তিথি সংসারের কাজ গোছাচ্ছে। আজ আর অফিসের নাম করে ফাঁকি দিয়ে বাইরে যেতে পারলাম না। এই যাহ্ সেহরী তো খাওয়া হয়নি তাহলে রোজা রাখবো কেমন! এখন শ্বশুর যদি শোনে রোজা নেই তাহলে কি যে হবে আল্লাহ জানে!!

বউ কিছু বলার আগেই ফ্রেস হয়ে গুছিয়ে নিলাম শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার জন্য। মুখটা শুকনো হয়ে আছে। যেতে ইচ্ছে করছে না তবুও পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে যাচ্ছি নয়তো তুলকালাম বেঁধে যাবে। ঘর থেকে বাহির হবার আগে ভালোবাসা দেখিয়ে তিথিকে সোফায় বসালাম। বললাম শুনো কয়েকদিন ধরে তোমাকে একটা কথা বলব ভাবছি কিন্তু বলা হচ্ছে না। আমার এমন আচমকা ভালোবাসা দেখে সেও বলল আচ্ছা কি বলবা বলো।

— আসলে তোমাকে বলব না তো কাকে বলব! তুমিই তো আমার সব।
— এতো ঢং না করে কি বলবে বলো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
— কই ঢং করলাম! সত্যি কথা বলতে
— থাক তোমাকে আর সত্যি কথা বলতে হবে না। কোন কথা হবে না, সোজা চলো।

আমার কথাগুলো আর বলা হলো না। বউটাও যেমন ঠ্যাটারু তার বাপও তেমন ঠ্যাটারু। অবশেষে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম। শ্বশুর ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করার আগেই আমাকে জিজ্ঞাস করলো বাবা রোজা আছো তো? বাড়িভর্তি মানুষের সামনে কেমনে বলি রোজা নেই! তাই মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বললাম হ্যাঁ রোজা আছি। অবশেষে শ্বশুর বলল এই নাহলে চৌধুরী বাড়ির জামাই! বাবা সবগুলো রোজা থাকতে হবে কিন্তু। আমি বললাম অবশ্যই থাকবো, আমি তো প্রতিবার সবকয়টা রোজা রাখি।

শেষমেশ বুঝলাম আমি গ্যাড়া কলে পড়ছি গতবারের মতো এবারও রেহাই নেই। রাতে ঘুমানোর আগে লুঙ্গী পরার জন্য ব্যাগ থেকে লুঙ্গী বের করছিলাম। হঠাৎ করে দেখলাম একটা ওষুধের টুপলা। মেডিসিন গুলো নিশ্চয়ই তিথির হবে। সাথে সাথে মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। মেডিসিনগুলো নিয়ে সোজা শ্বাশুড়ির ঘরে ঢুকলাম। শ্বাশুড়িকে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথাই বললাম। আম্মু আপনি তো আমার আম্মুর মতই আপনার সাথে আমি সব কথা শেয়ার করি। আজকেও একটা কথা শেয়ার করতে এসেছি। তবে….

তিনি বলল বাবা তুমি নির্ভয়ে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। আমার কিন্তু কোন ছেলে নেই তুমিই আমার ছেলে। কোন সমস্যা হলে আমাকে বলবে! তিথি কি তোমার সাথে বেয়াদবী করছে? আমি বললাম না আম্মা। আসলে ডাক্তার বলছে আমার শরীরে নাকি ছোট ছোট কিছু রোগ দেখা দিয়েছে। এই দেখেন আম্মা ডাক্তার ওষুধ দিয়েছে কতগুলো। এখন আমি রোজা থাকি কেমনে! আর আব্বা যদি শোনে আমি রোজা নেই তখন লজ্জায় পড়ে যাবো। আপনি কিছু একটা ব্যাবস্থা করেন আম্মা। তিনি বলল তুমি কোন চিন্তা করো না বাবা, আমি সব দেখছি। আমি আবারও বললাম আম্মা তিথিও যেন না জানে। ওর মুখ কিন্তু পাতলা।

আরে বাবা তুমি চিন্তা করো নাতো। তুমি শুধু ইফতার আর সেহরীর সময় আমাদের সাথে তাল মিলিয়ে খাবে আর যা করার আমিই করব। তোমার শ্বশুর ও তিথি মামণী কিছুই জানবে না। আমি বললাম সন্তানদের দরদ আম্মা ছাড়া আর কে বুঝবে। আপনিই তো আমার আম্মা। পরের দিন পাশের বাড়ি থেকে শ্বাশুড়ি আম্মা একটা মোরগ এনে আমাকে বলল বাবা এটা জবাই দাও তো। তোমার শ্বশুর বাইরে গেছে আর তিথিও পাশের বাড়ির আন্টির কাছে বসে আছে এই ফাঁকে মোরগটা জবাই দাও। জবাই দেওয়ার পর শ্বাশুড়ি আম্মা সেটা রান্না করে আমাকে খেতে ডাকলো। এক ঘরের মধ্যে বসিয়ে আমাকে খাওয়াচ্ছে যাতে করে কেউ দেখতে না পায়।

খাওয়া প্রায় শেষ এমন সময় হঠাৎ করে শ্বশুর তার এক বন্ধুকে নিয়ে বাড়িতে আসলো। শ্বশুর আব্বা আমাকে ডাকছে আমি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসলাম। শ্বশুরের পাশে থাকা লোকটি বলল মাশাল্লাহ জামাই তো শাপিপ খানের চেয়ে সুন্দর। খাওয়ার পর পানি না খেয়ে আসাতে বারবার আদ উঠছিল। আমার এই অবস্থা দেখে তিনি বলল কি ব্যাপার তুমি রোজা নেই নাকি বাবা? এমন করছো কেন? খাওয়ার পর পানি না খেলে তো এমন হয়। আমি কিছু বলার আগেই শ্বশুর আব্বা বলল আরে কি বলছিস! জামাই রোজা আছে। রাতে আমার সাথেই তো সেহরী করলো। জামাই মনেহয় রাতে পানি কম খেয়েছিল যার এ্যাকশন এখন ধরা করছে। চলো বাবা ইফতারির আর ১৫ মিনিট বাকি আছে। আজ তোমার আংকেলসহ আমরা সবাই একসাথে ইফতার করব। আমি হঠাৎ করে বলে ফেললাম আব্বা আমি কেবল মাত্র খেয়ে আসলাম এখন আর খাবো না। না না আব্বা আমি কিছু খাইনি, আমি কিন্তু রোজ আছি বাকিটা ইতিহাস…

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত