বোবা ছেলেটি

বোবা ছেলেটি

ইতি টের পেল তার ওড়নাটা ধরে কেউ টান দিয়েছে। সে পিছনে ফিরে দেখল একটা অচেনা যুবক তার ওড়নাটা ধরে রিকশার পেছন পেছন আসছে। ইতির মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল প্রচন্ড রাগে ছেলেটাকে বলল “আশ্চর্য ব্যাপার আপনার সাহস তো কম না। অসভ্য লোক কোথাকার। দিনদুপুরে লুচ্চামি করেন।” ছেলেটা কিছুই না বলে হাতে যেন কি সব বুঝিয়ে অল্প করে হেসে যাচ্ছে।

ইতি ঝাড়ি দিয়ে তার হাত থেকে ওড়না টা নিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করলো। ইতির চেঁচামেচি শুনে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আশেপাশে ৫-৬ জন যুবক ছেলে জড়ো হয়ে গেল।

আমাদের যুবকদের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যদি কখনো আমাদের কোন সুন্দরী যুবতী মেয়ের উপকার করার সুযোগ হয় তাহলে আমরা তীব্রভাবে আকর্ষিত হয়ে সেই সুযোগটুকু নেওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু করি।

কয়েকটা ছেলে একসাথে ইতি কে জিজ্ঞেস করল ” আপু আপু আপনার কি হয়েছে? কোন সমস্যা? ”
এবার ইতি তাদেরকে ব্যাপারটা খুলে বলল কি হয়েছিল আর কি করেছিল এই ছেলেটা কতক্ষণ আগে।
আগুনের মধ্যে শুকনো খড় ঢেলে দিলে যেমন খুব সুন্দরভাবে আগুনের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে ঠিক তেমনভাবে মেয়েটার নালিশও ওইসব যুবকদের শরীরের জোর বাড়িয়ে তুলল কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই। ছেলেগুলা খুব আবেগী এবং খুব দয়ালু ও প্রতিবাদী হয়ে ছেলেটার কলারে ধরল আর তীব্র কন্ঠে বলল “কি বলে? এসব করছিস?”

ছেলেটা মনে হয় মোটেও প্রস্তুত ছিলনা এই ব্যাপারটার জন্য সে কখনো ভাবতেই পারেনি এই সামান্য ব্যাপারটুকু একটা মুহূর্তের মধ্যেই এতোটুকু বড় হয়ে যাবে।

সে অনেক বেশি ভয় পেয়ে যায়। তার শরীরটা যেন বরফ হয়ে আসে। সে আর কিছুই বলতে পারেনা।
উত্তর না পেয়ে যুবকগুলো ঝাপিয়ে পড়ে ছেলেটার ওপর। কিল, ঘুষি, থাপ্পড়। কয়েকজন অফিসগামী ভদ্রলোক তেমন কিছুই করলো না ছেলেটার পাছায় দুচারটা লাথি দেয়া ছাড়া।

কয়েকজন রিকশা চালক এসে বলে, ” ভাইসব ছাইড়া দেন। মইরা যাইবো। আর মাইরেননা।”
পাশ থেকে আরেক ভদ্রলোক চেচিয়ে উঠে, ” মিয়া কথা কম বলো। এই সব হারামির বাচ্চাদের জন্য আমাদের মেয়েরা ঠিক মতো স্কুল কলেজে যেতে পারেনা। শালার পুতেরে পুলিশে দিতে হবে।”

ছেলেটার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। এটা দেখে তারা মার থামালো। এক স্থানীয় দাড়িওয়ালা মুরব্বি বলল, ছাইড়া দেন পুলিশে দেয়া লাগবে না।

আবার আরেক ভদ্রলোক বলল, “আচ্ছা যা ছোটলোকের বাচ্চা দিলাম না এবার পুলিশে, তবে আবার যদি কখনো এমন করিস সরাসরি পুলিশে ঢোকামু।”

হাতপায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়ে ছেলেটা উঠতে পারছিল না রাস্তা থেকে। অনেক কষ্ট করে সে উঠল আস্তে আস্তে। লোকজন ততক্ষণে যে যার মত চলে গিয়েছে। আপুটা অনেক তৃপ্তি পেল। যাক একটা অসভ্যকে কিছুটা শিক্ষা দিতে পেরেছে এবং সেখানে তার অবদানটা ছিল মুখ্য। এই ভেবে তার বেশ ভালো লাগলো। রিক্সাতে চলতে চলতে আপুটা বিশাল বড় একটা পোস্টে লিখছে ফেসবুকে “আজকে আমার সাথে ঘটে যাওয়া এই এই এই ইত্যাদি ”

পোস্ট দেয়ার পর সেখানে শত শত মানুষের হাহাকার। আর ছেলেটার প্রতি অকথ্য ভাষায় গালি। “আপু গুড জব” ” আপনি অগ্নীকন্যা ” আরো কত কি লিখা হচ্ছে।

ছেলেটা ধীরে ধীরে ওঠে কিছু একটা খুঁজতে লাগল। তার পিছনে লুঙ্গিতে গুঁজে থাকা টাকাটা আছে কিনা খোঁজ করলো। সে তৃপ্ত হলো কারণ তার টাকাটা হারায়নি। ছেলেটার মা হসপিটালের বারান্দায় শুয়ে আছে। আপেল কিনতে এসে এই ঝামেলায় পড়ে যায় সে। সামনের দোকান থেকে আপেল কিনে মায়ের কাছে যায়। মা ঘুমোচ্ছে। মায়ের পাশে আপেলগুলো রাখে। সে ওয়াস রুমে যায়। যাওয়ার পথে একটা নার্স তাকে দেখতে পেয়ে এসে বলে “এই ছেলে তোমার নাক দিয়ে রক্ত পরছে আসো আসো এদিকে আসো একটা ব্যান্ডেজ করে দিই। ”

নার্স অবশ্য এই ছেলেটাকে আরো কয়েকবার দেখেছে। গ্রাম থেকে আসা এই সহজ সরল ছেলেটির মার ঔষধপত্র কিনার ব্যাপারটা ইনিই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন গত পড়শু। ব্যান্ডেজ করে জিজ্ঞেস করলো খেয়েছে কিনা। ছেলেটা হাত দিয়ে বুঝালো খেয়েছে মায়ের সাথে।

রাত নয়টা বাজে। মায়ের পা টিপছে ছেলেটা। মা ধীরে ধীরে ঘুমিয়েছে। ছেলেটা জীবনে এরকম অনেকবার ভুল বুঝাবুঝির শিকার হয়েছে। তার কোনো কষ্ট নেই তাতে। কিন্তু সে তো হাত দিয়ে আজ খুব সুন্দর ভাবেই মেয়েটিকে বুঝিয়েছিল, “যে আপু আপনার ওড়নাটা রিকশার চাকায় লেগে যাচ্ছিল আর তাই আমি ওড়নাটা তুলে আপনাকে দিয়েছি। ” কিন্তু কী কারণে যে সে আপুটা তাকে ভুল বুঝলো সেটা তার মাথায় আসছেনা।

ছেলেটা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে, আজ যদি সে অন্যসকল মানুষদের মতো কথা বলতে পারতো এমনটা হয়ত কখনওই হতোনা।

(সমাপ্ত)

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত