মিথিলার বয়স যখন বারো,তখন প্রথম সেই অদ্ভুত ঘটনা টা ঘটে।ও ওদের সদ্য বানানো অসম্পূর্ণ বাড়ির চারতলার বারান্দায় খেলছিল।হুট করেই বারান্দা থেকে অসাবধানতার জন্য নিচে পড়ে যায়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো,নিচে পড়তে পড়তেই মিথিলার মনে হলো কেউ যেন শূন্য থেকে ওকে ধরে ফেললো!তারপর খুব আস্তে করে নিচে নামিয়ে দিয়ে গেল!মিথিলা ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।জ্ঞান ফেরার পর বাড়ির অনেকেই জানতে চায় কি হয়েছিল!কিন্তু মিথিলা তাদের কিছুই বলে না!
এরপর ই ঘটতে থাকে অদ্ভুত ঘটনাগুলো। আস্তে আস্তে মিথিলা বড় হতে থাকে।আর যখন ই ও কোন বিপদে পড়েছে, তখন ই ও বুঝতে পারে অদৃশ্য এক শক্তি ওকে সেই বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিচ্ছে।আরো অবাক করা ঘটনা হলো,যে কোন ছেলের সাথে ও যদি বন্ধুর মতও মেশে,অবধারিত ভাবে সেই ছেলের কোন না কোন ক্ষতি হয়।এই তো,রিয়াজের বাইক এক্সিডেন্ট হলো অইদিন!রিয়াজ আর মিথিলা ক্লাশমেট।একই কলেজে পড়ে দুজন।রিয়াজকে যখন দেখতে গেল মিথিলা তখন রিয়াজ বললো–জানিস,কোত্থাও কিছু নেই।তবু কিসের সাথে যেন ধাক্কা খেয়ে বাইক নিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেলাম!মিথিলা বুঝলো এই ঘটনার পেছনেও সেই অশরীরী ছায়া আছে।
একদিন মিথিলা স্বপ্নে দেখতে পেলো তাকে!অনেক লম্বা,সুদর্শন একটা মানুষ। স্বপ্নের ভেতরই কেমন এক ভয় পাওয়া অনুভব মিথিলার।তারপরও ও তাকিয়ে রইলো সেই মানুষটার চোখের দিকে।এরকম মায়াময় চোখ বাস্তবে কোন ছেলের দেখেনি ও।ছেলেটা ও কিচ্ছু বলছে না! শুধু এক পৃথিবী সমান ভালবাসা চোখে নিয়ে তাকিয়ে আছে মিথিলার চোখে!স্বপ্ন টা দেখার পরই ধুম জ্বর এলো মিথিলার।ওর বাবা মা ভিষণ চিন্তিত হয়ে পড়লেন মেয়েকে নিয়ে।যদিও তারা তেমন কিছুই জানেন না!কিন্তু এইটুকু বোঝেন মিথিলার কোন সমস্যা আছে!ও আর দশ টা মেয়ের চেয়ে যেন একটু আলাদা!
সেই জ্বরের ঘোরে মিথিলা মাঝেমধ্যেই টের পেতো তার অস্তিত্ব! হয়তো একা ঘরে চুপচাপ মাথার কাছে বসে আছে সে,এরকম মনে হতো।কেউ কাছে থাকলে সে কখনো আসতো না।আর যখন আসতো বা চলে যেতো একটা ঠান্ডা বাতাস ছুঁয়ে যেত মিথিলাকে।প্রথম প্রথম ভয় পেলেও মিথিলা এখন আস্তে আস্তে কেমন অভ্যস্ত হয়ে যেতে থাকে যেন!যেন এরকম অশরীরী এক ছায়ার প্রেমেই পড়ে যায় ও!কোন ভয়,কোন দ্বিধা আর নেই মিথিলার।মাঝেমাঝেই এখন মনে মনে তার সাথে কথাও বলে ও।না,সে কিচ্ছু বলে না।চুপ করে শুনে যায় আর মৃদু হাসে।মিথিলার মনে হতে থাকে,এরকম সুন্দর করে আর কেউ কোনদিন কি হেসেছে!?কই,দেখেনি তো ও।
এরপর একদিন মিথিলার বিয়ে হয়ে যায়।সেটাও যেন একদম ই হুট করে।মিথিলার বাবার হার্ট এট্যাক হয়।তারপর ই ওর বাবা একটু সুস্থ হয়ে উঠেই তার দীর্ঘদিনের ব্যবসায়ী পার্টনারের ছেলের সাথে মিথিলার বিয়ে ঠিক করে।মিথিলা এরকম ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে যায়।অনেক কান্নাকাটি করে।কিন্তু লাভ হয় না।ওর মা ওকে বুঝিয়ে রাজী করান।বাবার অসুস্থতার দোহাই দিয়ে মেয়েকে বিয়ে করে নিতে বলেন।
বিয়ের রাতেই মিথিলা যখন কনের বেশে বসে আছে ঘরে,হুট করেই লোডশেডিং হয়।আর তখনই একটা ঠান্ডা বাতাস এসে মিথিলাকে ছুঁয়ে যায়।মিথিলা বোঝে কে এসেছে!তখন ও চারদিক অন্ধকার। আর এই প্রথমবার সে মিথিলাকে সরাসরি কিছু বলে!এই প্রথমবার মিথিলা তার কন্ঠ শোনে।ভারী আর ভরাট গলায় সে শুধু বলে,তুমি আমার সাথে যাবে?তোমাকে অনেকদূরে নিয়ে যাবো আমি।আর কাউকে পেতে দেবো না।তুমি শুধু আমার।এরপর ই মিথিলার বর ঘরে ইমারজেন্সি লাইট এনে দেখে,মিথিলা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পড়ে আছে!
আস্তে আস্তে শ্বশুরবাড়ির সবাই কম বেশি বোঝে,মিথিলার কোন সমস্যা আছে।সবচেয়ে বেশি বোঝে মিথিলার স্বামী মাসুদ।বিয়ের প্রায় একমাস হয়ে গেছে।অথচ মিথিলা তাকে কাছে আসতে দেয়নি।এমন কি আলাদা ঘরে থাকা শুরু করেছে।মাসুদ অনেকবার চেষ্টা করেছে সহজ হতে।মিথিলার সাথে বন্ধুত্ব করতে।কিন্তু মিথিলার কাছে গেলেই ও যেন কেমন কাঠ কাঠ আচরণ করে।ভদ্রতাসূচক দুই একটা কথা বলে।আর সবসময় কি যেন ভাবে।একা একা মিথিলাকে কথাও বলতে শুনেছে মাসুদ।ও কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।এরকম অসহনীয় দাম্পত্য জীবন আর কারো হয় কিনা জানেনা মাসুদ!
মাসুদের মা অনেক বলে কয়ে মিথিলাকে নিয়ে এলেন পরীবাগের মাজারে।হুজুরের সাথে আলাদা করে কথা বললেন উনি।হুজুর কে খুলে বললেন এতদিনের সব ঘটনা।যদিও ঠিক জানেন না,মিথিলার সমস্যা টা কি।তারপরে ও তার মনে হয়েছে,হয়তো হুজুরের কাছে নিয়ে এলে সমস্যার কোন সমাধান পাবেন।হুজুর আলাদা করে মিথিলার সাথে কথা বললেন।বুঝতে চেষ্টা করলেন সমস্যা টা।এও বুঝলেন,মিথিলা নিজেই এই সমস্যা টা থেকে বের হতে চায় না!হুজুর মিথিলার আশেপাশে একটা ছায়ার অস্তিত্ব টের পেলেন!
দেখতে দেখতে মিথিলার বিয়ের ছয়মাস পেরিয়ে গেছে।এর ভেতর সেই হুজুরের দেয়া তাবিজ মিথিলার গলায়।আর একদিন হুজুরের ওখানেই সেই ছায়ার সাথে কথা হয় মিথিলার!আসলে হুজুর ই ওকে বোঝান।অবশ্য প্রথমেই রাজি হয়নি মিথিলা।প্রায় দশ বারোবার হুজুরের কাছে যাওয়া আসার পর ওকে হুজুর বোঝাতে পারেন।ও নিজেও বোঝে,এভাবে আসলে জীবন চলে না।থমকে থাকে।সেই ছায়াকে যখন মিথিলার কাছে নিয়ে এলেন হুজুর,তখন সন্ধ্যা হবো হবো করছে।হুজুরের ওখানেই একটা ঘরে মিথিলা একা বসে ছিল।
একটা দমকা হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে মিথিলা বুঝলো,সে এসেছে।ও একটু চুপ থেকেই মনে মনে বললো,তুমি আমাকে মুক্তি দাও।আমি আর পারছিনা।এভাবে চলতে থাকলে আমি পাগল হয়ে যাবো,নইলে মারা যাবো!তুমি কি তাই চাও!?কান্নায় ভেঙে পড়লো মিথিলা।এরপরই শুনতে পেলো,যেন অনেক দূর থেকে কেউ বলছে,তুমি ভেবো না।এতদিন তুমি চাও নি আমি চলে যাই,সেজন্য ই আমি তোমার সাথে ছায়ার মত ছিলাম।আজ তুমি নিজে মুক্তি চাচ্ছো,আমি চলে যাচ্ছি।চিরদিনের মত,অনেক দূরে।মিথিলা চোখ বুজলো।স্পষ্ট দেখতে পেলো,একটা কান্নাভেজা অদ্ভুত সুন্দর চোখ।আস্তে আস্তে যেন মিলিয়ে যাচ্ছে।আকুল হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো মিথিলা!
মিথিলার মেয়ের আজ জন্মদিন। চার শেষ করে পাঁচে পড়লো তিতলি।সুন্দর করে মেয়েকে সাজিয়ে দিচ্ছিলো মিথিলা।হ্যা,এখন পুরোই সুখি গৃহিনী ও।স্বামী, সন্তান নিয়ে সুখেই আছে বেশ।কোন অশরীরী সান্নিধ্য আর টের পায় না এখন।আজকে মেয়েকে সন্ধ্যা বেলার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে র জন্য সাজাতে গিয়ে মেয়ের চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো মিথিলা!
একদম যেন সেই চোখ!সেই ছায়ার মত!কই, এতদিন তো দেখেনি ও।আজ কিভাবে চোখ টা তার মত হয়ে গেল!কতদিন কতজায়গায় এই চোখ টাই তো খুঁজেছে মনে মনে!অবশেষে বুঝলো মিথিলা!ও এত্ত ব্যাকুল হয়ে তাকে খুঁজেছে বলেই,মেয়ের জন্মদিনে এই চোখ,এই দৃষ্টি মেয়েকে উপহার দিয়ে গেল।ও হ্যা,এতদিন অন্ধ ছিল তিতলি!অনেক ডাক্তার দেখিয়েও চোখ সারাতে পারে নি।আজ সবকিছু দেখতে পেয়ে তিতলি বিস্ময়ে কাঁদছে আর তিতলির মা আনন্দে কাঁদছে!সে এক অন্যরকম সুন্দর দৃশ্য!