বেলা ১১ টার দিকে মামা এসে বললেন, আপা তোমার স্বামী তো বিশাল কাণ্ড করে ফেলেছে।‘ আম্মা কৌতূহলী কন্ঠে বললেন, ‘কি করেছে?’
-আজকে সকালেই দেখলাম একটা মেয়ের হাত ধরে কাজি অফিসে ঢুকছে। আমি বাজারে যাচ্ছিলাম। মোড়ের কাজি অফিসটায় দেখলাম মহা আনন্দে বিয়ে করতে যাচ্ছে। ছি ছি ছি।‘ এই কথা শোনার সাথে সাথেই আম্মা মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। ভাজ্ঞিস তিনি বিছানার কাছেই ছিলেন। কোথাও ব্যথা পাননি। জ্ঞান ফিরেই আম্মা জিজ্ঞেস করলেন , ‘হারামজাদাটা কোথায়?’ মামা সামনের সোফাতেই বসা ছিলেন। আম্মার প্রশ্ন শোনার জন্যই হয়ত প্রস্তুত ছিলেন। সাথসাথ বলে উঠলেন, ‘দুলাভাই তো নাই হয়ে গেছে আপা। তাকে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। সুইচ অফ।‘
আম্মা দ্বিতীয়বার জ্ঞান হারালেন। আপা সকাল থেকে আম্মার মাথায় পানি ঢালছেন। আম্মার জ্ঞান ফিরেছে। রক্তবর্ণ চক্ষু নিয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। কারো সাথে কথা বলছেন না। মামা কিছুক্ষণ পরপর আক্ষেপের সুরে বলে উঠছেন, ‘তোমার ভাগ্যটাই খারাপ আপা। আমাদের বংশের কোন মেয়ের কপাল তোমার মত খারাপ না। মেয়েটার বিয়ের বয়স হয়েছে। একটা ছেলে ভার্সিটিতে পড়ছে। আরেকটা দুইদিন পড়েই কলেজে পা রাখবে। এই বয়সে কেউ দ্বিতীয় বিয়ে করে। ছি ছি ছি‘
বলেই মামা এদিক ওদিক তাকিয়ে সবার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেন। বাবার দ্বিতীয় বিয়েতে তিনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন।
ভাইয়া এসেছেন অফিস থেকে। ভাইয়াকে দেখেই মনে হল তিনি ব্যাপারটাতে অনেক আনন্দিত। বেশ হাসিখুশি চেহারা। মামা খুব যত্ন সহকারে বাবার কাহিনী ভাইয়াকেও বলেছেন। ভাইয়া খুব গম্ভীরভাবে বলেছে, ‘আমার দ্বিতীয় মা দেখতে কেমন? বাবার রুচিবোধ কেমন জানা দরকার!’
ভাইয়ার এমন কথা শুনে মামা যার পর কম আছে বিষ্ময় নিয়ে ভাইয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়েছিলেন। এই ছেলে বলে কি! মাথা কি পুরাই গেছে নাকি! মামা আমাকে বলেছেন , ‘বুঝলি রাসেল! তোর ভাইয়া অধিক শোকে পাগল হয়ে গেছে। বাপের দ্বিতীয় বিয়া কি কেউ সহ্য করতে পারে বল?’ আমি হ্যাঁ না কিছুই বলি নি। বাবার বিয়ে সহ্য করার মত কি না এটা নিয়ে আমি এখনো চিন্তিত না। বাবা যে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এই বিষয়ে আমার কোন ভাবান্তর নেই। তবে ভাইয়া অনেক খুশি এটা তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সে আম্মাকে বলেছে, ‘শোন মা! বাবা দুটো বিয়ে করেছে। আমার জন্য উপকার হয়েছে। আমিও দুটো বিয়ে করব ভাবছি। বাবা সেই সুযোগ করে দিলেন। এই মানুষটাকে মনের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ। থ্যাংকস বাবা।‘
বাবার ফোন সকালথেকেই বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মা’র ধারণা বাবা আর এই বাড়িতে আসবেন না। পালিয়ে গেছেন। সিম কার্ডও চেঞ্জ করেছেন। বাবার চিন্তা আমাদের না করাই ভাল। এদিকে আপু সকাল থেকে কেঁদেই যাচ্ছে। তার প্রধান দায়িত্ব চোখের পানি মোছা আর আম্মার মাথায় পানি ঢালা। ভাইয়া সোফায় হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে। তার কাছে ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করতেই পারেন। চাইলে আরো তিন চারটা করতে পারেন। এসব নিয়ে আমাদের মানে ছোটদের মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। আমাদের উচিৎ বাবাকে স্মরণ করা।
আম্মা খুব শান্তভাবে আমাদের বলেছেন, ‘শোন তোর বাবা যদি তার সেকেন্ড ওয়াইফকে নিয়ে এই বাসায় চলেও আসে আমরা মেনে নিব না। আমি সতীনের সংসার করতে পারব না। দুইজন গেটে থাকতেই তোরা তাড়িয়ে দিবি। পারবি না?’ সবাই চুপ। মামা খুব আহ্লাদী কন্ঠে বললেন, ‘অবশ্যই পারব আপা। তুমি চিন্তা করিও না।‘ এদিকে আমি আছি মহা দুশ্চিন্তায়। বাবা পাঁচ সাতটা বিয়ে করেছেন এটা দেখার বিষয় না। আজকে জনিদের সাথে আমাদের ক্রিকেট ম্যাচ আছে। এই ম্যাচে জিতলেই সেমি ফাইনালে উঠব আমরা। বাবা এমন একদিন বিয়ের জন্য কেন বেছে নিলেন বুঝলাম না। বাবার উপর ভারী অভিমান হল আমার। সকাল থেকে বাসার যে অবস্থা এই অবস্থায় বাসার বাইরেও যাওয়া যাচ্ছে না।
আম্মার যতক্ষণ জ্ঞান ছিল ততক্ষণ যাকে যাকে পেরেছেন তাকে তাকে বাবার দ্বিতীয় বিবাহ সম্পর্কে বলেছেন। বর্ণনায় কোন ভুল নাই। ‘আরে শফিকুল দেখেছে। নিজ চোখে দেখেছে অল্প বয়সী একটা মেয়ের হাত ধরে কাজি অফিসে ঢুকেছে। এত বড় একটা লোক। কিভাবে পারল! আর মেয়েটাই বা কেমন! বাপের বয়সী একটা লোকের সাথে! ছিহ!।‘ বাবা ফিরলেন বিকেলে। অফিস শেষ করে যে সময়ে ফেরেন ঠিক সেসময়েই। বাবার পাশে কোন মেয়েকে দেখা গেল না। আমি গেট খুলে দিলাম। আম্মা হুংকার দিয়ে বললেন, ‘মেয়েটা কোথায়?’ বাবা আকাশ থেকে পড়া পরিমাণ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন মেয়ে?’
-কোন মেয়ে মানে? যাকে আজকে বিয়ে করেছ!
-কাকে বিয়ে করলাম?
-দেখলি শফিকুল! দিনেদুপুরে কিরকম অস্বীকার করে যাচ্ছে ব্যাপারটা! কেমন মিথ্যাবাদী লোক।
মামা এগিয়ে এসে বললেন, ‘দুলাভাই এখন এসব গোপন করে লাভ নাই। আমি নিজ চোখে দেখেছি আপনি মোড়ের কাজি অফিসটায় একটা মেয়ের হাত ধরে ঢুকেছেন। কাজি অফিসে কেউ তেহেরী খাইতে যায় না।‘ বাবা একটু হেসে বললেন, ‘আমি কি মেয়েটার হাত ধরে ছিলাম?’
-না তা থাকেন নাই। পাশে ছিলেন। একসাথে কাজি অফিসে ঢুকেছেন!
বাবা এবার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসা শুরু করলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘লেইট মি এক্সপ্লেইন। হা হা হা! কিরে অনীক তুইও ভাবছিস আমি আরেকটা বিয়ে করেছি?’ আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। আমার আর সময় নাই। খেলতে যেতে হবে। বাবা এবার হাসি থামিয়ে বললেন, ‘ওটা আমাদের কলিগের মেয়ে। কলিগের মেয়ের সাথে আরেক জুনিয়র কলিগের বিয়ে হল আজ। আমরা ছিলাম সাক্ষী। ওখানে তো আরও অনেকে ছিল শফিকুল। ছিল না বল? চুপ করে আছিস কেন?’ মামা থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বাবা মিটিমিটি হাসছেন। আমরা সবাই আম্মার রিএকশন দেখার জন্য তাকালাম। আম্মা আবার জ্ঞান হারিয়েছেন। সোফায় পড়ে আছেন।